পথে ঘটিত কতিপয় বিচ্ছিন্ন ঘটনা (وَهَاكَ بَعْضُ مَا وَقَعَ فِي الطَّرِيْقِ):

১. সহীহুল বুখারী শরীফে আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘আমরা (গারে সওর থেকে বেরিয়ে) একটানা সারা রাত এবং পরের দিন দুপুর পর্যন্ত চলতে থাকলাম। রোদের প্রখরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ক্রমান্বয়ে পথচারীর সংখ্যা কমতে থাকল এবং ঠিক দুপুরে পথ জনশূন্য হয়ে গেল। আমরা তখন দীর্ঘ বড় পাথর দেখতে পেলাম যার ছায়ায় তখনো রোদ আসেনি। আমরা সেখানে নেমে পড়লাম। আমি নিজ হাতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শয়নের জন্য একটি জায়গা সমতল করে দিলাম এবং সেখানে একখানা চাদর পেতে দিয়ে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনি এখানে শয়ন করুন আর আমি আপনার আশ-পাশের সব কিছু দেখাশুনা করছি। তিনি শয়ন করলেন এবং আমি সামনে ও পেছনের খোঁজ খবর নেওয়া এবং দেখাশোনার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম একজন রাখাল তার ছাগলের পাল নিয়ে পাথরের দিকে চলে আসছে। সেই পাথর থেকে সেও ঐ জিনিসই চাচ্ছে যা আমরা চেয়েছিলাম। আমি তাকে বললাম, ‘হে যুবক তুমি কার লোক?’

সে মক্কা অথবা মদীনার কোন লোকের কথা বলল। আমি তাকে বললাম, ‘তোমার ছাগীর ওলানে কি কিছু দুধ আছে?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ’’। আমি পুনরায় বললাম, ‘সেটি কি দোহন করতে পারি?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ’’। তারপর সে একটি ছাগী ধরে নিয়ে এল। আমি বললাম, ‘মাটি, খড়কুটো এবং লোম থেকে ওলানটা পরিষ্কার করে নাও। পরিষ্কার করে নেয়ার পর একটি পেয়ালায় অল্প কিছুটা দুধ দোহন করল। তারপর দুধটুকু আমি একটি চামড়ার পাত্রে ঢেলে নিলাম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পানি এবং ওযুর জন্য ঐ পাত্রটি আমি সঙ্গে নিয়েছিলাম।

আমি দুগ্ধ পাত্র হাতে রাসূলুল্লাহর নিকট এসে দেখি তখনো তিনি ঘুমন্ত অবস্থায় রয়েছেন। কাজেই, তাকে ঘুম থেকে জগানোর সাহস হল না। তারপর যখন তিনি জাগ্রত হলেন তখন আমি দুধের মধ্যে কিছুটা পানি ঢেলে দিলাম যাতে দুধের তলদেশ ঠান্ডা হয়ে যায় এবং বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এ দুগ্ধটুকু পান করুন’’, তিনি পান করলেন। তাকে পান করানোর সুযোগ প্রদানের জন্য আনন্দ উদ্বেল চিত্তে আল্লাহর সমীপে শুকরিয়া আদায় করলাম।

দুগ্ধ পানের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘এখনো কি যাত্রার সময় হয়নি?’

আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল কেন হবে না, যাত্রার উপযুক্ত সময় হয়েছে,’ তারপর আমরা পুনরায় যাত্রা শুরু করলাম।[1]

২. এই প্রবাস যাত্রাকালে আবূ বাকর (রাঃ) সাধারণতঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রাদীফ থাকতেন। অর্থাৎ তিনি বাহনে নাবী (ﷺ)-এর পিছনে বসতেন। তিনি পিছনে বসতেন এ কারণে যে, তার মধ্যে বার্ধক্যের চিহ্ন প্রকাশ পেয়েছিল এবং মানুষের দৃষ্টি প্রথমেই তার উপরেই পড়তো। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মধ্যে তখনো যৌবনের চিহ্ন পরিষ্ফুট ছিল এজন্য তার প্রতি মানুষের দৃষ্টি অপেক্ষাকৃত কম যেতো। এর ফল ছিল কোন লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে সে আবূ বাকর (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করত আপনার সম্মুখের লোকটি কে? আবূ বাকর (রাঃ)-এর এক অত্যন্ত সূক্ষ্ণ উত্তর প্রদান করতেন। বলতেন, ‘এই লোকটি আমাকে পথ বলে দিচ্ছেন। এতে লোকেরা সহজভাবে পথের কথাই বুঝতেন। কিন্তু এ কথার মাধ্যমে তিনি কল্যাণের পথকেই বোঝাতে চেয়েছেন।[2]

৩. এই প্রবাস যাত্রাকালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) খুযা’আহ গোত্রের উম্মু মা’বাদের তাঁবুদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেন। ইনি একজন নামকরা স্বাস্থ্যবান মহিলা ছিলেন। হাতে হাঁটু ধারণ করে তাঁবুর অঙ্গনে বসে থাকতেন এবং গমনাগমনকারীদেরকে পানাহার করাতেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন আপনার নিকট কিছু আছে? তিনি বললেন, ‘আমার নিকট যদি কিছু থাকত তাহলে আল্লাহর ওয়াস্তে আপনাদের মেহমানদারীতে কোন প্রকার ত্রুটি হতো না। ঘরে তেমন কিছুই নেই, বকরীগুলোও রয়েছে দূরদূরান্তে। সময়টা ছিল দূর্ভিক্ষ কবলিত।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দেখলেন তাঁবুর এক কোনে একটি বকরী রয়েছে।

তিনি বললেন, ‘হে উম্মু মা’বাদ, এটা কেমন বকরী? মহিলা বললেন, ওর দুর্বলতার কারণে ওকে দলের বাহিরে রাখা হয়েছে। নাবী (ﷺ) বললেন ওর ওলানে কি কিছু দুধ আছে? তিনি বললেন, ‘দুধ দানের মতো তার কোন শক্তিই নেই।’ নাবী (ﷺ) বললেন, ‘অনুমতি দিলে আমি তাকে দোহন করি’’।

মহিলা বললেন, ‘হ্যাঁ’’, আমার মাতা-পিতা আপনার জন্য কুরবান হোক। যদি আপনি ওলানে দুধ দেখতে পান তবে অবশ্যই দোহন করবেন।’

এ কথাবার্তার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বকরীটির ওলানের উপর হাত ফিরালেন, আল্লাহর নাম নিলেন এবং দু’আ করলেন। তারপর বকরীটা তার পেছনের পা দুটি বিস্তার করল এবং তার ওলান দুধে ভরপুর হয়ে উঠল।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উম্মু মা’বাদের বেশ বড় আকারের একটি পাত্র নিলেন এবং এত পরিমাণ দুধ দোহন করলেন যে, দুধের ফেনা পাত্রের উপরে উঠে গেল। দুধ দোহনের পর উম্মু মা’বাদকে পান করালেন। তিনি দুগ্ধপানে পূর্ণরূপে পরিতৃপ্ত হলেন। তারপর সঙ্গী সাথীদের পান করালেন। পূর্ণ পরিতৃপ্তির সঙ্গে সকলকে পান করানোর পর তিনি নিজে পান করলেন। দ্বিতীয় বারেও তিনি এত পরিমাণ দুধ দোহন করলেন যে, পাত্র ভরে গেল। এ দুগ্ধ উম্মু মা’বাদের নিকট রেখে দিয়ে তিনি সঙ্গীদের সহ মদীনার পথে অগ্রসর হলেন।

অল্পক্ষণ পরেই তাঁর স্বামী আবূ মা’বাদ আপন দুর্বল বকরী যা দুর্বলতা হেতু ধীরে ধীরে পায়ে হাঁটছিল হাঁকাতে হাঁকাতে এসে পৌঁছল। পাত্রভর্তি দুধ দেখে তিনি বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়লেন। তাঁর সহধর্মিনীকে জিজ্ঞেস করলেন, এ দুধ তুমি কোথায় পেলে? সে ক্ষেত্রে দুগ্ধবতী বকরীগুলো দূর চারণ ভূমিতে ছিল এবং বাড়িতে কোন দুগ্ধবতী বকরীই ছিলনা, সেক্ষেত্রে পাত্রে এত দুধ এল কোথায় থেকে?

স্ত্রী উম্মু মা’বাদ তাঁর স্বামীকে সেই বরকতময় মেহমানের কথা জানালেন যিনি পথ চলার সময় তাঁর গৃহে আগমন করেন এবং যেভাবে যা ঘটেছিল তা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন। এ সব কথা শ্রবণের পর স্বামী আবূ মা’বাদ বললেন, ‘একে তো ঠিক সেই লোক বলে মনে হচ্ছে যাঁকে কুরাইশগণ খুঁজে বেড়াচ্ছেন।’ আবূ মা’বাদ পুনরায় তাঁর স্ত্রীকে বললেন, ‘আচ্ছা তাঁর আকৃতি প্রকৃতি বর্ণনা কর দেখি।’

স্বামীর এ কথা শ্রবণের পর উম্মু মা’বাদ অত্যন্ত জীবন্ত ও আকর্ষণীয়ভাবে তাঁর গুণাবলী ও যোগ্যতার এমন একটি নকশা অংকণ করলেন তাতে মনে হল শ্রবণকারীগণ যেন তাঁকে চোখের সম্মুখেই দেখছে (কিতাবের শেষ ভাগে সেই গুণগুলোর কথা উল্লে­খিত হবে)। মেহমানের এ সকল গুণের কথা অবগত হয়ে আবূ মা’বাদ বললেন, ‘আল্লাহর শপথ! ইনি তো কুরাইশদের সেই সাথী লোকেরা যাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার কথা বলছেন। আমার ইচ্ছা তাঁর বন্ধুত্ব গ্রহণ করি এবং যদি কোন পথ পাই তাহলে অবশ্যই তা করব। এদিকে মক্কায় একটি ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ছে যা মানুষ শুনতে পাচ্ছে কিন্তু বক্তাকে দেখতে পাচ্ছে না। কথাগুলো ছিল এরূপ :

جزى الله رب العرش خير جزائـه ** رفيقين حَلاَّ خيمــتى أم مَعْبَـدِ

هـمـا نزلا بالبِــرِّ وارتحلا بـه ** وأفلح من أمسى رفيق محمــد

فيا لقُصَىّ مــا زَوَى الله عنكـم ** به من فعال لا يُحَاذى وسُــؤْدُد

لِيَهْنِ بني كعـب مكــان فَتاتِهـم ** ومقعدُهـا للمؤمنـين بَمْرصَـد

سَلُوْا أختكم عن شاتهـا وإنائهـا ** فإنكم إن تسألوا الشاة تَشْـهَـد

অর্থঃ আরশের প্রভূ আল্লাহ ঐ দু’বন্ধুকে উত্তম পুরষ্কার দেন যারা উম্মু মা’বাদের তাঁবুতে অবতরণ করেছিলেন। তারা দুজনে কল্যাণের সঙ্গে অবতরণ করেছেন এবং কল্যাণের সঙ্গে গমন করেছেন। যিনি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর বন্ধু হয়েছেন, তিনি সফলকাম হয়েছেন। হায় কুসাই! আল্লাহ তোমাদের থেকে কত নজিরবিহীন কার্যকলাপ ও নেতৃত্ব গুটিয়ে নিয়ে তাদেরকে দিয়েছেন, অর্থাৎ বনু কা‘বদেরকে, ওদের মহিলাবর্গের অবস্থান স্থল এবং মুমিনদের সেনাচৌকী বরকতময় হোক। তোমরা নিজ ভগ্নিদেরকে তাদের পাত্র এবং বকরী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো। তুমি যদি স্বয়ং বকরীদেরকেও জিজ্ঞেস কর তবে তারাও সাক্ষ্য দেবে।

আসমা (রাঃ) বলছেন, ‘আমরা জানতাম না যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কোন্ দিকে গমন করেছেন। ইতোমধ্যে একজন মক্কার নিম্নভূমি থেকে এ কবিতা পাঠ করতে করতে এল। মানুষ তার পিছনে পিছনে চলছিল, তার কথা শুনছিল, কিন্তু তাকে কেউই দেখতে পাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত সে মক্কার উচ্চভূমি থেকে বের হয়ে গেল।’

তিনি বলেন, ‘আমরা যখন তাঁর কথা শুনলাম তখন বুঝতে পারলাম রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কোন দিকে গমন করেছেন। অর্থাৎ তিনি গমন করেছেন মদীনার দিকে।[3]

৪. সুরাক্বাহ বিন মালিক পথের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিছু ধাওয়া করে। এ ঘটনা সুরাক্বাহ নিজেই বর্ণনা করেছে। সে বলেছে, ‘আমি নিজ সম্প্রদায় বনী মুদলিজের এক সভায় বসেছিলাম। ইতোমধ্যে একজন লোক আমার পাশে এসে দাঁড়াল। সে বলল, ‘হে সুরাক্বাহ! আমি কিছুক্ষণ পূর্বে উপকূলে কতিপয় লোককে দেখলাম। আমার ধারণা এরা হবেন মুহাম্মাদ (ﷺ) এবং তাঁর সঙ্গীগণ।’

সুরাক্বাহ বলেন, ‘আমি বুঝে গেলাম যে, এরা তাঁরাই।’ কিন্তু ঐ লোকটির ধারণা পালটিয়ে দেয়ার জন্য তাকে বললাম, ‘এরা তারা নয়। বরং তুমি অমুক অমুককে দেখেছ যারা আমার চোখের সম্মুখ দিয়ে অতিক্রম করল।’

‘এরপর সভাস্থানে সামান্য সময় অপেক্ষা করে অন্দর মহলে চলে গেলাম এবং নিজ দাসীকে নির্দেশ দিলাম আস্তাবল থেকে আমার ঘোড়াটি বের করে নিয়ে গিয়ে ঢিবির পিছনে আমার জন্য অপেক্ষা করতে। এদিকে আমি নিজ তীর গ্রহণ করলাম এবং বাড়ির পিছন দরজা দিয়ে বের হলাম। এ সময় আমার হাতের লাঠিটির এক মাথা মাটির সঙ্গে ঘর্ষণ খাচ্ছিল এবং অন্য মাথা নীচু করে রাখা ছিল। এ অবস্থায় আমি নিজ ঘোড়ার নিকট গিয়ে তার উপর আরোহণ করলাম। তারপর লোকটির কথিত দিক লক্ষ্য করে ঘোড়া ছুটিয়ে চললাম।’

‘‘আমি দেখলাম সে আমাকে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে ছুটছে। এক পর্যায়ে আমি তাদের নিকটবর্তী হয়ে গেলাম, কিন্তু আকস্মিকভাবে আমাকে সমেত ঘোড়ার পা পিছলিয়ে যাওয়ায় আমি ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেলাম। আমি উঠে দাঁড়িয়ে তুনের দিকে হাত বাড়ালাম এবং পাশার তীর বের করে জানতে চাইলাম যে, তাঁকে বিপদে ফেলতে পারব কিনা। কিন্তু যে তীরটি বেরিয়ে আসল সেটা আমার অপছন্দনীয়। কিন্তু আমি তীরের সাংকেতিক অভিব্যক্তি এড়িয়ে অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করলাম। সে আমাকে নিয়ে ছুটতে লাগল এবং এক পর্যায়ে নাবী (ﷺ)-এর কণ্ঠ নিঃসৃত কুরআনের পাঠ আমার কর্ণকূহরে প্রবিষ্ট হল। তিনি কোন সময়ের জন্যও পিছনে ফিরে তাকান নি। কিন্তু আবূ বাকর (রাঃ) বার বার পিছনে ফিরে তাকাচ্ছিলেন।

আর সামান্য পথ অতিক্রম হলে তাঁদের পথ রোধ করতে পারি এমন এক অবস্থায় আকস্মিকভাবে আমার ঘোড়ার পা হাঁটু পর্যন্ত মাটিতে ঢুকে গেল। এতে আমি তার পিঠ থেকে ছিটকে পড়ে গেলাম। আমি অবস্থাটা সামলিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াবার জন্য ঘোড়াটিকে ধমকা-ধমকি শুরু করলাম। আমার ধমক খেয়ে সে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল কিন্তু সহজে তা পারল না। অবশেষে অনেক কষ্ট করে সে পা টেনে বের করল। কিন্তু সে যখন বহু কষ্টের পর উঠে দাঁড়াল তখন তার পদচিহ্ন থেকে আসমানের দিকে ধোঁয়ার মতো ধূলি প্রবাহের সৃষ্টি হয়েছিল।

আমি আবার পাশার তীর থেকে আমার ভাগ্যান্বেষণের ইঙ্গিত সম্পর্কে জানতে চাইলাম। কিন্তু আবার ঐ তীরটিই বাহির হল, যা আমার অপছন্দনীয় ছিল। এরপর আমি তাঁদের নিরাপত্তা চেয়ে আহবান জানালে তাঁরা থেমে গেলেন। আমি ঘোড়া খেদিয়ে তাঁদের নিকট পৌঁছলাম। যখন আমি তাঁদেরকে থামিয়ে ছিলাম তখনই আমার মনে এ কথাটা গেঁথে গিয়েছিল যে, মুহাম্মাদ (ﷺ)-ই শেষ পর্যন্ত জয়ী হবেন। এজন্য আমি তাকে বললাম যে, ‘আপনার সম্প্রদায় আপনার প্রাণের বিনিময়ে পুরষ্কার ঘোষণা করেছে’ এবং ঐ কথার সূত্রেই আমি তাঁকে মানুষের মনোভাব সম্পর্কে সতর্ক করে দিলাম। অধিকন্তু, কিছু খাদ্য-সামগ্রী এবং আসবাবপত্রেরও ব্যবস্থা করে দিতে চাইলাম। কিন্তু আমার কাছ থেকে কোন কিছুই গ্রহণ করলেন না এবং আমাকে কোন প্রশ্নও জিজ্ঞেস করলেন না। শুধু এ টুকুই বললেন যে, ‘আমাদের ব্যাপারে গোপনীয়তা রক্ষা করবেন।’ আমি আরয করলাম ‘আমাকে নিরাপত্তা পরওয়ানা লিখে দিন।’ তিনি ‘আমির বিন ফুহাইরাকে তা লিখে দেয়ার নির্দেশ প্রদান করায়। তিনি এক টুকরো চামড়ার উপর তা লিখে আমার হাতে দিলেন। তারপর নাবী (ﷺ)-এর দল সম্মুখে পানে অগ্রসর হলেন।[4]

এ ঘটনা সম্পর্কে খোদ আবূ বাকর (রাঃ)-এর এক রেওয়ায়েতে এর বর্ণনা রয়েছে যে, ‘আমাদের যাত্রা করার পর আমাদের স্বগোত্রীয় লোকজন অনুসন্ধান কাজে তৎপর হয়ে ওঠে, কিন্তু সুরাক্বাহ বিন মালিক বিন জু’শুম ছাড়া যারা নিজ ঘোড়ায় উঠেছিল তার কেউই আমাদের নাগাল পায়নি। আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাদের পিছনে আগমনকারীরা আমাদেরকে পেয়ে যাবে।’

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,

‏(‏لاَ تَحْزَنْ إِنَّ اللهَ مَعَنَا‏)‏ ‏[‏التوبة‏:‏40‏]

‘‘চিন্তার কোন কারণ নেই, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সঙ্গেই আছেন।(আত্-তাওবাহ ৯ : ৪০)[5]

যাহোক, সুরাক্বাহ প্রত্যাবর্তন করে দেখে যে, লোকজন সব হন্যে হয়ে অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সে তাদের বলল, ‘এ দিকের খোঁজ খবর আমি নিয়েছি। এদিকে তোমাদের যা কাজ ছিল তা যথারীতি করা হয়েছে। এভাবে সে লোকদের ফিরিয়ে নিয়ে গেল। দিনের প্রথম ভাগে যে ছিল আক্রমণকারী শত্রু, দিনের শেষ ভাগে সেই হল জীবন রক্ষাকারী বন্ধু।[6]

৫. পথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ছোট্ট কাফেলার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় বুরাইদাহ বিন হুসাইব আসলামীর। সে ছিল নিজ সম্প্রদায়ের নেতা এবং শক্তিমান পুরুষ। তার সাথে প্রায় আশি জন লোক ছিল। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তার সঙ্গী সাথীগণও ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এশার সালাত আদায় করেন এবং এসব লোকেরাও তাঁর পেছনে সালাত আদায় করেন। বুরাইদাহ তার স্বীয় গোত্রের সঙ্গেই বসবাস করেন এবং উহুদ যুদ্ধের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন।

আব্দুল্লাহ বিন বুরাইদাহ বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফাল বিশ্বাস করতেন কিন্তু ত্বিয়ারাহ (এর প্রকার ভাগ্য নির্ণয়) বিশ্বাস করতেন না। বুরাইদাহ (রাঃ) সত্তর জন লোকের এক কাফেলাসহ মদীনায় আগমন করেন। অতঃপর তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করলে তাদের জিজ্ঞাসা করেন, তোমরা কোন কওমের লোক। তারা বললো আমরা আসলাম গোত্রের। এরপর আবূ বাকরকে বললেন, আমি নিরাপদ হলাম। অতঃপর তিনি (ﷺ) কোন গোত্রের? তারা বললো বনু সাহম গোত্রের। তিনি বললেন তোমার অংশ বের হয়ে গেছে।

৬. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবূ আওস তামীম বিন হাযার আসলামী অথবা আবূ তামীম আওস বিন হাযার আসলামীর নিকট দিয়ে আরয-এর হারশা ও জুহফাহর মধ্যবর্তী কাহদাওয়াত অতিক্রম করছিলেন। তাঁর পিঠের ব্যথার কারণে ধীরে পথ চলছিলেন। সে সময় তিনি (ﷺ) এবং আবূ বাকর (রাঃ) একই উটের সওয়ারী ছিলেন। আওস লোকজন তাঁকে সওয়ার জন্য একটা উট প্রদান করলেন এবং তাদের সাথে মাস’উদ নামক এক ক্রীতদাসকে সঙ্গে দিয়ে দিলেন। ক্রীতদাসকে বলে দিলেন যে, তাঁদের সাথে সাথে পথ চলবে। কক্ষনোই তাঁদের থেকে পৃথক হবে না। ফলে সে তাঁদের সাথে চলতে থাকলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা মদীনায় পৌছে গেলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মাসউদকে তার মনিবের নিকটে ফিরত পাঠালেন। আর তাকে এ নির্দেশ দিলেন যে, সে যেন আওস গোত্রের লোকেদের বলে যে, তারা যেন তাদের এ উটের গর্দানে গাধার ন্যায় দুটো আংটা পরিয়ে দেয় এবং উভয়ের মাঝে দুরত্ব রাখে। এটাই তাদের চিহ্ন। মুশরিকরা উহুদ প্রান্তরে উপস্থিত হলে আওস তার ক্রীতদাস মাসউদ বিন হুনাইদাহকে ‘আরয হতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দরবারে গিয়ে মুশরিকদের বিষয়ে খবর দেয়ার জন্য প্রেরণ করলেন। এ ঘটনাকে ইবনু মা’কূল ত্বাবারী থেকে বর্ণনা করেছেন।

তিনি রাসূলুলাহ (ﷺ)-এর মদীনায় আগমনের পর ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তিনি আরযে বসবাস করতেন।

৭. পথ চলার পরবর্তী পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে যুবাইর বিন আওয়ামের সাক্ষাৎ হয়। মুসলিমগণের একটি বাণিজ্য কাফেলার সঙ্গে তিনি সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তন করছিলেন। যুবাইর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও আবূ বাকর (রাঃ) কে সাদা কাপড় প্রদান করেন।[7]

[1] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫১০ পৃঃ।

[2] সহীহুল বুখারী আনাসহেত ১ম খন্ড ৫৫৬ পৃঃ।

[3] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫৩-৫৪ পৃঃ। বনু খোযয়ার আবাদী অবস্থানের প্রতিদৃষ্টি রেখে এ কথাই অধিক গ্রহণযোগ্য যে, এ গটনাটি গার থেকে যাত্রা পরে ২য় দিনে সংঘটিত হয়েছিল।

[4] সহীহুল বুখারী শরীফ ১ম খন্ড ৫৫৪ পৃঃ। বনী মুদলেজদের বাড়ি রাবেগের নিকটবর্তী ছিল। সুরাক্বাহ সেই সময় নাবী (সাঃ)-এর অনুসন্ধানে রত হয়েছিলেন যখন তিনি কুদাইদ থেকে উপরে যাচ্ছিলেন। যাদুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫৩ পৃঃ। এটা অধিক গ্রহণযোগ্য এ কারণে যে, গুহা থেকে যাত্রার তৃতীয় দিবসে পিছু ধাওয়ার এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল।

[5] সহীহুল বুখারী শরীফ, ১ম খন্ড ৫১৬ পৃঃ।

[6] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫৩ পৃঃ।

[7] সহীহুল বুখারী উরওয়াপুত্র যুবাইর থেকে ১ম খন্ড ৫৫৪ পৃঃ।