আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী মুহাজিরগণের বিরুদ্ধে কুরাইশ ষড়যন্ত্র (مَكِيْدَةُ قُرَيْشٍ بِمُهَاجِرِي الْحَبْشَةِ):

জান-মাল ও ঈমান রক্ষার্থে মুসলিমগণ দেশত্যাগ করে আবিসিনিয়ায় গিয়ে সেখানে শান্তি স্বস্তি লাভ করায় কুরাইশগণের দারুণ গাত্রদাহ সৃষ্টি হয়ে যায়। এ প্রেক্ষিতে ‘আমর বিন আস এবং গভীর জ্ঞানগরিমার অধিকারী আব্দুল্লাহ বিন রাবী’আহকে (যিনি তখনো ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নি) নাজ্জাশীর নিকট প্রেরণ করার জন্য দূত মনোনীত করা হয়। তারপর সম্রাট নাজ্জাশী এবং বেতরীকগণের (খ্রীষ্টান ও অগ্নিপূজকদের পুরোহিত) জন্য বহু মূল্যবান উপঢৌকনসহ দূত দ্বয়কে দৌত্যকর্ম সম্পাদনের উদ্দেশ্যে আবিসিনিয়ায় প্রেরণ করা হয়।

আবিসিনিয়ায় পৌঁছে তারা সর্বপ্রথম বেতরীক পুরোহিতগণের দরবারে উপস্থিত হয়ে উপঢৌকন প্রদান করেন। তারপর তাঁদের নিকট সেই সকল বিবরণ ও প্রমাণাদি উপস্থাপন করেন যার ভিত্তিতে তারা মুসলিমগণকে হাবশ হতে বাহির করার উদ্যোগ নিয়েছিল। যদি সেই সকল বিবরণ ও প্রমাণাদির তেমন কোন ভিত্তিই ছিল না, তবুও উপঢৌকনের সুবাদে বেতরীকগণ (পাদ্রীগণ) এ ব্যাপারে একমত হলেন যে, মুসলিমগণকে হাবশ হতে বহিস্কার করার ব্যাপারে সম্রাট নাজ্জাশীকে তাঁরা পরামর্শ দিবেন। বেতরীকগণের নিকট থেকে সহযোগিতা লাভের আশ্বাস পেয়ে কুরাইশ দূতেরা সম্রাট নাজ্জাশীর দরবারে উপস্থিত হয়ে উপঢৌকন প্রদান করে আরজি পেশ করেন। তাঁদের আরজির বিবরণ হচ্ছে এরূপঃ

‘‘হে মহামান্য সম্রাট! আমাদের দেশের কিছু সংখ্যক অবোধ ও অর্বাচীন যুবক আমাদের দেশ থেকে পলায়ণ করে আপনার দেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। তাঁরা তাঁদের পূর্ব পুরুষগণের নিকট থেকে বংশপরম্পরা সূত্রে চলে আসা ধর্মমত পরিত্যাগ করেছে। আপনার দেশে আশ্রয় গ্রহণ করে আপনার ধর্মমতও গ্রহণ করেন নি। এ হচ্ছে তাঁদের চরম ধৃষ্টতার পরিচায়ক। শুধু তাই নয়, এরা নাকি একটা নতুন ধর্মমতও আবিস্কার করেছেন। এর চাইতে আজগুবি ব্যাপার আর কী হতে পারে বলুন। আমাদের গোত্রীয় প্রধান এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ, এ সকল অর্বাচিনের পিতামাতা, মুরুববী ও আত্মীয়-স্বজনগণ তাঁদেরকে স্বদেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে আমাদের দু’জনকে দূত হিসেবে দরবারে প্রেরণ করেছেন। আপনি অনুগ্রহ করে আমাদের সঙ্গে ওঁদের ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। আমাদের প্রধানগণ এদের ভালমন্দ সম্পর্কে ভালভাবে বোঝেন এবং তাদের অসন্তোষের কারণ সম্পর্কে ওয়াকেবহাল রয়েছেন।’

কুরাইশ দূতেরা সম্রাটের নিকট যখন এ আরজি পেশ করলেন তখন পুরোহিতগণ বললেন, ‘মহামান্য সম্রাট! এরা উভয়েই খুব যুক্তিসংগত এবং সঠিক কথা বলেছেন। আপনি এদের হাতে ঐ দেশত্যাগী যুবকদের সমর্পণ করে দিন। আমাদের মনে হয় এটাই ভাল যে, তাঁরা তাঁদের স্বদেশে ফেরৎ নিয়ে যান।

কুরাইশ দূতগণের কথাবার্তা শ্রবণের পর সম্রাট নাজ্জাশী গভীরভাবে কিছুক্ষণ চিন্তা করে নিয়ে বললেন, ‘আলোচ্য বিষয়টির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভের পূর্বে কোন কিছু মন্তব্য প্রকাশ করা কিংবা সিদ্ধান্ত নেয়া সমীচীন হবে না। সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে বিষয়টির খুঁটি নাটি সম্পর্কে ওয়াকেবহাল হওয়া তাঁর বিশেষ প্রয়োজন। এ প্রেক্ষিতে তাঁর দরবারে উপস্থিত হওয়ার জন্য তিনি মুসলিমদের আহবান জানালেন। মুসলিমগণও আল্লাহ তা‘আলার কথা স্মরণ করে বিষয়ের খুঁটি-নাটিসহ সকল কথা সম্রাট সমীপে পেশ করার জন্য উত্তম মানসিক প্রস্ত্তটি সহকারে সম্রাটের দরবারে গিয়ে উপস্থিত হলেন।

সম্রাট নাজ্জাশী তাঁর দরবারে উপস্থিত মুসলিমদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘যে ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার কারণে যুগ যুগ ধরে পূর্ব পুরুষগণের বংশপরম্পরা সূত্রে চলে আসা ধর্ম তোমরা পরিত্যাগ করেছ এবং এমন কি আমাদের দেশে আশ্রিত হয়েও তোমরা আমাদের ধর্মের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন রয়েছে সে ধর্মটি কোন্ ধর্ম?’

প্রত্যুত্তরে মুসলিমদের মনোনীত মুখপাত্র হিসেবে জা’ফার বিন আবূ ত্বালিব অকপটে বলে চললেন, ‘হে সম্রাট! আমরা ছিলাম অজ্ঞতা, অশ্লীলতা ও অনাচারের অন্ধকারে নিমজ্জিত দুষ্কর্মশীল এক জাতি। আমরা প্রতিমা পূজা করতাম, মৃত জীব-জানোয়ারের মাংস ভক্ষণ করতাম, নির্বিচারে ব্যভিচার ও অশ্লীলতায় লিপ্ত থাকতাম, আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতাম, পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করতাম, আমানতের খেয়ানত ও মানুষের হক পয়মাল করতাম এবং দুর্বলদের সহায়-সম্পদ গ্রাস করতাম, এমন এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ জীবনে আমরা যখন মানবেতর জীবন যাপন করে আসছিলাম তখন আল্লাহ রাববুল আলামীন অনুগ্রহ করে আমাদের মাঝে এক রাসূল প্রেরণ করলেন। তাঁর বংশ মর্যাদা, সততা, সহনশীলতা, সংযমশীলতা, ন্যায়-নিষ্ঠা, পরোপকারিতা ইত্যাদি গুণাবলী এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পূর্ব থেকেই আমরা অবহিত ছিলাম। তিনি আমাদেরকে আহবান জানিয়ে বললেন যে, ‘সমগ্র বিশ্ব জাহানের স্রষ্টা প্রতিপালক এক আল্লাহ ছাড়া আমরা আর কারো উপাসনা করব না। বংশ পরম্পরা সূত্রে এ যাবৎ আমরা যে সকল প্রস্তর মূর্তি বা প্রতিমা পূজা করে এসেছি সে সব বর্জন করব। অধিকন্তু মিথ্যা বর্জন করা, পাড়া-প্রতিবেশীগণের সাথে সদ্ব্যবহার করা, অশ্ল­ীল অবৈধ কাজকর্ম থেকে বিরত থাকা এবং রক্তপাত পরিহার করে চলার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। তাছাড়া মহিলাদের উপর নির্যাতন চালানো কিংবা মহিলাদের অহেতুক অপবাদ দেয়া থেকেও বিরত থাকার জন্য তিনি পরামর্শ দেন। আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা থেকে বিরত থাকার জন্যও তিনি পরামর্শ দেন। অধিকন্তু, নামায, রোযা এবং যাকাতের জন্যও তিনি আমাদের নির্দেশ প্রদান করেন।’

এইভাবে জা’ফার অত্যন্ত চিত্তোদ্দীপক এবং মর্মস্পর্শী ভাষায় ইসলামের মূলনীতি এবং বিধি-বিধানগুলো বর্ণনা করলেন। তারপর আবারও বললেন, ‘এই পয়গম্বরকে বিশ্বজাহানের স্রষ্টা প্রতিপালক আল্লাহর (মহিমান্বিত প্রভূর) পয়গম্বর বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছি এবং তাঁর আনীত দ্বীনে এলাহীর অনুসরণে দৃঢ় প্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আল্লাহ এবং তদীয় রাসূলের পয়রবী করে চলছি। সুতরাং আমরা এক এবং অদ্বিতীয় প্রভূ আল্লাহর ইবাদত ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করি না এবং বিশ্ব জাহানে কোথাও তাঁর কোন শরীক আছে বলে আমরা বিশ্বাস করি না। পয়গম্বর যে সব কথা, কাজ ও খাদ্য আমাদের জন্য হারাম বলেছেন আমরা সেগুলোকে বিষবৎ পরিত্যাগ করেছি এবং যেগুলোকে হালাল বলেছেন আমরা সেগুলোকে বৈধ জেনে তার সদ্ব্যবহার করছি। এ কারণে আরব সমাজের বিভিন্নগোত্র ও সম্প্রদায় আমাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে। তাঁরা চান এ সত্য, সুন্দর, শাশ্বত ও সুনির্মল দ্বীপে থেকে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে অশ্লীলতা এবং অনাচারের গভীর পঙ্কে পুনরায় নিমজ্জিত করতে। কিন্তু আমরা তা অস্বীকার করায় তারা আমাদের উপর নারকীয় নির্যাতন চালিয়েছেন। এক আল্লাহর ইবাদত থেকে ফিরিয়ে নিয়ে প্রতিমা পূজায় লিপ্ত করানোর জন্য আমাদের উপর আঘাতের উপর আঘাত হেনেছে, নিদাঘের উত্তপ্ত কংকর ও বালুকারাশির উপর শুইয়ে বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর শুইয়ে দিয়ে বুকে পাথর চাপা দিয়েছে, পায়ে দড়ি বেঁধে পথে প্রান্তরে টেনে নিয়ে বেড়িয়েছে। এমনকি এইভাবে যখন তাঁরা আমাদের উপর অবিরামভাবে অন্যায় অত্যাচার চালাতে থাকলেন আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে আল্লাহর জমিনকে আমাদের জন্য সংকীর্ণ করে ফেললেন এবং এমন কি আমাদের ও আমাদের দ্বীনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে ও প্রাণনাশের হুমকি দিতে থাকলেন তখন আপনার মহানুভবতা, উদারতা ও ন্যায়-নিষ্ঠার কথা অবগত হয়ে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আমাদের নির্দেশ প্রদান করলেন দেশত্যাগ করে আপনার দেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে। হে সম্রাট! আমরা আপনার সহৃদয়, উদারতা ও মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়েছি। আমরা চাই আপনার আশ্রয়ের সুশীতল ছায়াতলে অবস্থান করতে। অনুগ্রহ করে এ সব পাষন্ড যালেমদের (অত্যাচারীদের) হাতে আমাদের সমর্পণ করবেন না।’

সম্রাট নাজ্জাশী বললেন সেই পয়গম্বর যা এনেছেন তার কিছু অংশ তোমাদের কাছে আছে কি? হযরত জা‘ফর বললেন, ‘জী হ্যাঁ’’।

নাজ্জাশী বললেন, ‘তা হলে আমার সামনে পড়ে শোনাও।

জা‘ফর (রাঃ) আল্লাহর সমীপে নিবেদিত এবং আত্মা-সমাহিত অবস্থায় ভাবগদগদ চিত্তে সুরায়ে মরিয়মের প্রথম কয়েকটি আয়াত পাঠ করে শোনালেন: (‏كهيعص‏)‏

‏নাজ্জাশী এতই মুগ্ধ হলেন যে, তাঁর চক্ষুদ্বয় হতে অশ্রুধারা প্রবাহিত হয়ে দাঁড়ি ভিজে গেল। জাফরের তিলাওয়াত শ্রবণ করে নাজ্জাশীর ধর্মীয় মন্ত্রণাদাতাগণও এতই ক্রন্দন করেছিলেন যে, ‘এ কালাম (বাণী) এবং সেই কালাম যা ঈসা (আঃ)-এর নিকট অবতীর্ণ হয়েছিল, উভয় কালামই এক উৎস হতে অবতীর্ণ হয়েছে।’

এরপর নাজ্জাশী ‘আমর বিন আস এবং আব্দুল্লাহ বিন রাবী’আহকে সম্বোধন করে বললেন, ‘তোমরা যে দূরভিসন্ধি নিয়ে আমার দরবারে আগমন করেছ তা সঙ্গে নিয়েই দেশে ফিরে যাও। তোমাদের হাতে এদের সমর্পণ করার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। অধিকন্তু, এ ব্যাপারে এখানে কোন কূট কৌশলেরও অবকাশ থাকবে না।’

সম্রাট নাজ্জাশীর নিকট থেকে এ নির্দেশ লাভের পর তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থমনোরথ হয়ে তাঁর দরবার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। আদম সন্তানদের গোমরাহ করার ব্যাপারে আযাযীল শয়তান যেমন একের পর এক কৌশল প্রয়োগ করতে থাকে এরাও তেমনি একটি কৌশল ব্যর্থ হওয়ায় অন্য কৌশল প্রয়োগের ফন্দি ফিকির সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। এক পর্যায়ে ‘আমর বিন আস আব্দুল্লাহ বিন রাবী’আহকে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আগামীকাল এদের সম্পর্কে এমন প্রসঙ্গ নিয়ে আসব যা এদের জীবিত থাকার মূল কর্তন করে ফেলবে। আর না হয়, এদের ব্যাপারে এমন মন্ত্রের অবতারণা করব যাতে এদের মূল কর্তিত হয়ে এবং সজীবতা ও সতেজতা বিনষ্ট হয়ে যায়। প্রত্যুত্তরে আব্দুল্লাহ বিন রাবী’আহ বললেন, ‘না-না, এমনটি করা সমীচীন হবে না। কারণ, এরা যদিও আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন তবুও এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, তাঁরা আমাদের স্বজাতি এবং স্বগোত্রীয় লোক এবং আত্মীয়-স্বজনও বটে।

কিন্তু ‘আমর বিন আস একথার তেমন গুরুত্ব না দিয়ে স্বীয় মতের উপর অটল রইলেন।

পরের দিন পুনরায় নাজ্জাশীর দরবারে উপস্থিত হয়ে, ‘আমর বিন আস বললেন, ‘হে সম্রাট! এরা ঈসা বিন মরিয়ম সম্পর্কে এমন একটি কথা বলেন যা কেউই কোন দিন বলেনি। আপনি ওদের কাছ থেকে এটা জেনে নিয়ে এর প্রতিকার করুন।’

একথা শোনার পর সম্রাট নাজ্জাশী পুনরায় মুসলিমদের ডেকে পাঠালেন। তাঁরা দরবারে এসে উপস্থিত হলে ঈসা (অীঃ) সম্পর্কে মুসলিমগণ কী ধারণা পোষণ করেন তা তিনি জানতে চাইলেন। সম্রাটের মুখ থেকে এ কথা শুনে মুসলিমগণ দ্বিধা দ্বন্দ্ব এবং সংশয়ের মধ্যে নিপতিত হলেন। কারণ ঈসা (আঃ) সম্পর্কে খ্রীষ্টান এবং মুসলিমদের মধ্যে তত্ত্বগত মত পার্থক্য রয়েছে। খ্রীষ্টানগণ বলেন মসীহ (জেসাস) আল্লাহর পুত্র। কিন্তু পার্থক্য হেতু মুসলিমগণ বলেন ঈসা (আঃ) হচ্ছেন আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। তত্ত্বগত এ পার্থক্য হেতু মুসলিমদের সংশয় এ কারণে যে, এ কথা বললে সম্রাট নাজ্জাশী যদি বা বিরূপ ভাব পোষণ করেন, তাহলে মুসলিমদের জন্য তা খুবই উদ্বেগের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু সেটা ছিল নেহাৎই একটা ক্ষণিকের ব্যাপার। আল্লাহর অনুগ্রহের উপর আস্থাশীল দৃঢ়চিত্ত মুসলিমগণ পরক্ষণেই মনস্থির করে ফেললেন যে, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের পক্ষ থেকে যে শিক্ষা তাঁরা পেয়েছেন সেটাই হবে তাঁদের মূলমন্ত্র এবং সেটাই হবে তাঁদের বক্তব্য তাতে ভাগ্যে যা ঘটবে ঘটুক।

নাজ্জাশীর প্রশ্নের উত্তরে জা‘ফর বললেন আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর পক্ষ থেকে আমরা যে শিক্ষা লাভ করেছি তাতে আমরা জেনেছি যে ঈসা (আঃ) হচ্ছেন আল্লাহর বান্দা এবং রাসূল। তাঁর মা মরিয়ম ছিলেন সতী-সাধ্বী এবং আল্লাহর দৃষ্টিতে উচ্চ মর্যাদার মহিলা। আল্লাহর হুকুম এবং বিশেষ ব্যবস্থাধীনে কুমারী মরিয়মের গর্ভে ঈসা (আঃ)-এর জন্ম হয়।’

এ কথা শ্রবণের পর নাজ্জাশী এক টুকরো খড় উঁচু করে ধরে বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, যা তোমরা বলেছ, ঈসা (আঃ)-এর চাইতে এ খড় পরিমাণও বেশী কিছু ছিলেন না।’ এ প্রেক্ষিতে পুরোহিতগণও ‘হুঁ’ ‘হুঁ’ বলে সমর্থন জ্ঞাপন করলেন।

নাজ্জাশী বললেন, ‘হ্যাঁ’, এখন তো তোমরা হাঁ হুঁ বলে সমর্থন জ্ঞাপন করবেই।’

তারপর নাজ্জাশী মুসলিমদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘তোমরা নির্ভয়ে, শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে আমার রাজ্যে বসবাস কর। যে কেউ তোমাদের উপর অন্যায় করবে তার জন্য জরিমানা ও শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা করা হবে। তোমাদের প্রতি অন্যায় অত্যাচারের বিনিময়ে আমার হাতে কেউ সোনার পাহাড় এনে দিলেও আমি তা সহ্য করব না।’

এর পর তিনি তাঁর পার্শ্বচরদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘এই কুরাইশ দূতদের আনীত উপঢৌকন তাদের ফিরিয়ে দাও। উপঢৌকনে আমার কোনই প্রয়োজন নেই। আল্লাহর শপথ! আল্লাহ তা‘আলা যখন আমাকে সাম্রাজ্য ফিরিয়ে দেন তখন আমার নিকট থেকে উপঢৌকন কিংবা উৎকোচ গ্রহণ করেন নি। সে ক্ষেত্রে তাঁর সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে কাজ করতে গিয়ে কিভাবে আমি উৎকোচ গ্রহণ করতে পারি। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা আমার ব্যাপারে অন্য লোকদের কথা গ্রহণ করেন নি, আমি কোন লোকের কোন কথা গ্রহণ করতে পারি না।’

এ ঘটনার বর্ণনাকারিণী উম্মু সালামাহ বলেছেন, এরপর প্রত্যাখ্যাত উপঢৌকন সহ কুরাইশ দূতগণ চরম বেইজ্জতির সঙ্গে নাজ্জাশীর দরবার থেকে বেরিয়ে এলেন এবং আমরা তাঁর ছত্রছায়ায় সম্মানের সঙ্গে তার রাজ্যে অবস্থান করতে থাকলাম।[1]

ইবনে ইসহাক্বের বর্ণনায় এ ঘটনার উল্লে­খ রয়েছে। কোন কোন চরিতকারের বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, নাজ্জাশীর দরবারে ‘আমর বিন আসের উপস্থিতির ঘটনাটি সংঘটিত হয় বদর যুদ্ধের পর। সামঞ্জস্য বিধানের জন্য বলঅ হয়েছে ‘আমর বিন আস দু’দফা নাজ্জাশীর দরবারে গিয়ে ছিলেন। কিন্তু বদর যুদ্ধের পর নাজ্জাশীর দরবারে ‘আমর বিন আসের উপস্থিতি সূত্রে সম্রাট নাজ্জাশী এবং জাফরের মধ্যে যে কথোপকথনের উল্লে­খ করা হয়েছে তার সঙ্গে আবিসিনিয়ায় হিজরতের পর নাজ্জাশী এবং জাফরের মধ্যে যে কথোপকথন হয়েছিল তার হুবহু মিল রয়েছে। অধিকন্তু ইবনে ইসহাক্বের বর্ণনায় আবিসিনিয়ায় হিজরতের পর নাজ্জাশীর দরবারে ‘আমর বিন আসের উপস্থিতির কথা বলা হয়েছে এবং ঐ একই প্রশ্নোত্তরের কথা উল্লে­খিত হয়েছে। কাজেই, উপর্যুক্ত বিভিন্ন তথ্য প্রমাণের প্রেক্ষাপটে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, মুসলিমদের ফেরত আনার জন্য ‘আমর বিন আস মাত্র একবার নাজ্জাশীর দরবারে গিয়েছিলেন এবং ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল আবাসিনিয়ায় হিজরতের পর পরই।

[1] ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড পৃঃ ৩৩৪-৩৩৮ হতে সংক্ষিপ্ত।