পুনরায় ওহীসহ জিবরাঈল (আঃ)-এর আগমন (جِبْرِيْلٌ يَنْزِلُ بِالْوَحْيِ مَرَّةً ثَانِيَةً):

হাফেয ইবনে হাজার বলেন যে, নাবী (ﷺ) -এর উপর প্রথম ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় তিনি কিছুটা ভয়-ভীতির সঙ্গে বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েন। তাঁর মানসিকতার ক্ষেত্রে কিছুটা বিহবলতার ভাবও পরিলক্ষিত হতে থাকে। এ প্রেক্ষিতেই আল্লাহ রাববুল আলামীন কিছুদিন ওহী নাযিল বন্ধ রাখেন, যাতে তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ লাভ করেন।[1] ঠিক তাই হলো, নাবী কারীম (ﷺ) প্রথম ওহী নাযিলের অসুবিধা থেকে মুক্ত হয়ে যখন মন মানসিকতার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক হয়ে উঠলেন, তখন তাঁর এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেল যে, তিনি আল্লাহর বার্তা বাহক বা রাসূল মনোনীত হয়েছেন। এবং তাঁর নিকট যিনি ওহী নিয়ে আগমন করেছিলেন তিনি হচ্ছেন আসমানী দূত বা ওহীবাহক। এভাবে রহস্যাবৃত ব্যাপারটি যখন তাঁর নিকট পরিস্কার হয়ে গেল তখনই তিনি পরবর্তী ওহীর জন্য উন্মুখ হয়ে উঠলেন। ওহী গ্রহণের জন্য মানসিকভাবে যখন প্রস্তুত হয়ে গেলেন, তখন জিবরাঈল (আঃ) পুনরায় ওহী নিয়ে আগমন করলেন। সহীহুল বুখারীর মধ্যে জাবির বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট থেকে ওহী নিয়ে আগমন বন্ধের ঘটনা শ্রবণ করেন। ঘটনার বর্ণনা প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,

(‏جَاوَرْتُ بِحِرَاءٍ شَهْرًا فَلَمَّا قَضَيْتُ جَوَارِىْ هَبَطْتُّ ‏[‏فَلَمَّا اِسْتَبْطَنْتُ الْوَادِيَ‏]‏ فَنُوْدِيْتُ، فَنَظَرْتُ عَنْ يَّمِيْنِيْ فَلَمْ أَرَ شَيْئًا، وَنَظَرْتُ عَنْ شِمَالِيْ فَلَمْ أَرَ شَيْئًا، وَنَظَرْتُ أَمَامِيْ فَلَمْ أَرَ شَيْئًا، وَنَظَرْتُ خَلْفِيْ فَلَمْ أَرَ شَيْئًا، فَرَفَعْتُ رَأْسِىْ فَرَأَيْتُ شَيْئًا، ‏[‏فَإِذَا الْمَلَكُ الَّذِيْ جَاءَنِيْ بِحِرَاءٍ جَالِسٌ عَلٰى كُرْسِيٍّ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ، فَجُئِثْتُ مِنْهُ رُعْبًا حَتّٰى هَوِيْتُ إِلَى الْأَرْضِ‏]‏ فَأَتَيْتُ خَدِيْجَةَ فَقُلْتُ‏:‏ ‏[‏زَمِّلُوْنِيْ، زَمِّلُوْنِيْ‏]‏، دَثِّرُوْنِىْ، وَصُبُّوْا عَلَىَّ مَاءً بَارِدًا‏)‏، قَالَ‏ :‏ (‏فَدَثَّرُوْنِىْ وَصَبُّوْا عَلَىَّ مَاءً بَارِدًا، فَنَزَلَتْ ‏:‏ ‏(‏يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ قُمْ فَأَنذِرْ وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ‏)‏ ‏[‏المدثر‏:‏ 1‏:‏ 5‏]‏‏)‏

‘‘আমি পথ ধরে চলছিলাম এমন সময় হঠাৎ আকাশ থেকে একটি আওয়াজ আমার শ্রুতিগোচর হল। আকাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই আমি সেই ফিরিশতাকে দেখতে পেলাম যিনি আমার নিকট হেরা গুহায় আগমন করেছিলেন। তিনি আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যস্থানে কুরশীতে উপবিষ্ট ছিলেন। ভয়ে বিস্ময়ে আমার দৃষ্টি অবনত হয়ে এল। তারপর আমার সহধর্মিণীর নিকট এসে বললাম, ‘আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও।’ তিনি আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘ওহে বস্ত্র আবৃত (ব্যক্তি)! ২. ওঠ, সতর্ক কর। ৩. আর তোমার প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। ৪. তোমার পোশাক পরিচ্ছদ পবিত্র রাখ। ৫. (যাবতীয়) অপবিত্রতা থেকে দূরে থাক। [মুদ্দাসসির (৭৪) : ১-৫] পর্যন্ত ওহী অবতীর্ণ করেন এরপর থেকে অবিরামভাবে ওহী অবতীর্ণ হতে থাকে।[2]

এ ক'টি আয়াত নবুওয়াতের প্রাথমিক অবস্থায় ওহী বন্ধ হওয়ার কয়েকদিন পর অবতীর্ণ হয়। তার উপর দায়িত্ব অর্পনের দুটি স্তর রয়েছে যা ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হলো-

প্রথমত : রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর নবুওয়াতের প্রচার ও ভীতি প্রদর্শনের দায়িত্ব অর্পন।

এ মর্মে আল্লাহর বাণী : (قُمْ فَأَنذِرْ) অর্থাৎ মানবমণ্ডলী অজ্ঞতা, পাপাচার, পথভ্রষ্টতা, মহান আল্লাহর ব্যতীত বাতিল উপাস্যের ইবাদত করা, তাঁর সত্ত্বা, গুণাবলী, তাঁর হক ও কর্মসমূহের সাথে শিরক বা অংশীস্থাপন করা থেকে যদি বিরত না হয় তবে তাদেরকে আল্লাহর কঠিন আযাব সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করো।

দ্বিতীয়ত ; রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর আল্লাহর নির্দেশিত বিষয়সমূহের সাথে তার সত্ত্বার সমন্বয় সাধন করা এবং তার উপর স্বয়ং অটল থাকা। ঐসব বিষয়কে কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই সযত্নে সংরক্ষণ করা। আর যারা আল্লাহ তা’আলার উপর বিশ্বাস স্থাপর করবে তাদের জন্য একটি উত্তম আদর্শ বনে যাওয়া। যথা পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করছেন, (وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ) অর্থাৎ একনিষ্ঠভাবে তার বড়ত্ব ঘোষণা করে এবং তার সাথে আর কাউকে শরীক করো না। এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেন, (وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ) এর বাহ্যিক অর্থ : শরীর ও কাপড়-চোপড়ের পবিত্রতা অর্জন। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হবে তার জন্য এটা শোভনীয় নয় যে, সে অপবিত্র ও নোংরা অবস্থায় দণ্ডায়মান হবে। আর এখানে প্রকৃতপক্ষে যে পবিত্রতা উদ্দেশ্য তা হচ্ছে, যাবতীয় শিরক ও পাপকৰ্ম থেকে বিরত থাকা এবং উত্তম চরিত্রে ভূষিত হওয়া। (وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ) অর্থাৎ আল্লাহর অসন্তোষ ও শাস্তি অবধারিত হওয়ার কারণসমূহ থেকে নিজেকে বিরত রাখো। অধিকন্তু তার আনুগত্যকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে এবং পাপকৰ্ম পরিহার করো। আল্লাহ বলেন, (وَلَا تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ) অর্থাৎ তুমি যেসব উত্তম আমল কর না কেন মানুষের নিকট তার প্রতিদান কামনা করো না অথবা এর বিনিময়ে দুনিয়াতে আল্লাহর কাছে এর চেয়ে কোন ভাল ফলাফল আশা করো না।

পরবর্তী আয়াতসমূহে মানুষদেরকে এক আল্লাহর দিকে আহ্বান করা, তাদেরকে তার শাস্তি ও পাকড়াও থেকে ভীতি প্রদর্শন এবং দীনের কারণে মানুষের পক্ষ থেকে যে বিরোধিতার সম্মুখীন হবেন, তাদের দ্বারা অত্যাচারিত-নির্যাতিত হবেন ঐ সব বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, (وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ) অর্থাৎ আপনি আপনার পরওয়ার দিগরের সন্তষ্টি অর্জনার্থে ধৈর্য্যধারণ করুন।

উল্লেখিত আয়াতসমূহের প্রারম্ভিক সুরে মহান আল্লাহ তা’আলার এক উদাত্ত আহবান সুস্পষ্ট, যে আহবানে নাবী কারীম (ﷺ)-কে নবুওয়াতের মহা মর্যাদাপূর্ণ কাজের জন্য ঘুম থেকে জাগ্রত হতে এবং ঘুমের আচ্ছাদন ও বিছানার উষ্ণতা পরিত্যাগ করে আল্লাহর একত্ববাদের বাণী প্রচারে লিপ্ত হওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে :

يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ قُمْ فَأَنْذِرْ

ওহে বস্ত্র আবৃত (ব্যক্তি)। ২. ওঠ, সতর্ক কর। (আল-মুদাসসির ৭৪ - ১-২)

বলা হয়ে থাকে যে, যে নিজের জন্যই বাঁচতে চায় সে আরাম আয়েশে গা ভাসিয়ে চলতে পারে। কিন্তু আপনাকে এক বিরাট ও মহান দায়িত্বে আত্মনিয়োগ করতে হচ্ছে তখন ঘুমের সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক? আরাম আয়েশের সঙ্গে আপনার কি সম্পর্ক? আপনার গরম বিছানার কী প্রয়োজন? কী প্রয়োজন আপনার সুখময় জীবন যাপনের? আপনি উঠে পড়ুন এবং ঐ মহানকাজে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। আপনার ঘুম এবং আরাম আয়েশের সময় এখন অতিক্রান্ত। এখন আপনাকে অবিরাম পরিশ্রম করে যেতে হবে এবং দীর্ঘ ও কষ্টদায়ক সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতে হবে।

আল্লাহর পথে আহবান এবং কালেমার দাওয়াত ও তাবলীগী নেসাবের কাজ হচ্ছে অতীব উঁচু দরের কাজ। কিন্তু এ পথে চলার ব্যাপারটি হচ্ছে অত্যন্ত ভয়ভীতিজনক এবং বিপদ-সংকুল। এ কাজ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে শান্তির নীড় ঘর-বাড়ি, সুখময় পারিবারিক পরিবেশ, আরাম-আয়েশ স্নিগ্ধ শয্যা থেকে টেনে বের করে এনে দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা এবং দুঃখ কষ্টের অথৈ সাগরে নিক্ষেপ করে দিল। এনে দাঁড় করিয়ে দিল মানুষের বাহ্যিক পোষাকী আচরণ এবং শঠতাপূর্ণ আভ্যন্তরীণ প্রকৃতিগত দ্বিধা-দ্বন্দ্বের দারুণ টানা-পোড়েনের মাধ্যমে।

তারপর, নাবী কারীম (ﷺ) তার অবস্থা এবং দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ হয়ে গেলেন এবং বিশ বছরেরও অধিককাল যাবৎ সেই জাগ্রত অবস্থার মধ্য দিয়েই অতিবাহিত করলেন। এ দীর্ঘ কাল যাবৎ সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ বলতে তার আর কিছুই রইল না। সব কিছুকেই তিনি করলেন বিসর্জন। তার জীবন নিজের কিংবা পরিবার পরিজনদের জন্য আর রইল না। তার জীবন রইল আল্লাহর কাজের জন্য দায়বদ্ধ। তার কাজ ছিল আল্লহির প্রতি বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানানো। বিশ্বের বুক থেকে সর্বপ্রকার অসত্য, অন্যায় ও মিথ্যার মূলোৎপাটন এবং ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষকে পথ-পদর্শন।

‘আল্লাহর পথে আহ্বান’, ‘সত্যের প্রতিষ্ঠা’ ইত্যাদি কথাগুলো আপাতঃ দৃষ্টিতে ততটা কঠিন কিংবা দুঃসাধ্য মনে নাও হতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর চেয়ে কঠিন এবং কষ্টসাধ্য কাজ পৃথিবীতে আর কিছুই হতে পারে না। রেসালাতের আমানত হচ্ছে বিশ্বের বুকে সব চেয়ে দায়িত্বপূর্ণ এবং দুর্বহ আমানত। এ আমানত হচ্ছে এক পক্ষে বিশ্বময় মানবের চরম উৎকর্ষ ও বিকাশের আমানত এবং অন্য পক্ষে যাবতীয় বাতিল এবং গায়রুল্লাহর প্রভাব প্রতিহত করে তাকে ধ্বংস করার আমানত। কাজেই তার কাধে যে বোঝা চাপান হয়েছিল তা ছিল সমগ্র মানবতার বোঝা । সমস্ত মতবাদের বোঝা এবং ময়দানে ময়দানে জেহাদ ও তা প্রতিহত করার বোঝা। বিশ বছরেরও অধিক কাল যাবৎ অবিরামভাবে তিনি ব্যাপক ও বহুমুখী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন। সেই দীর্ঘ কাল যাবৎ, অর্থাৎ যখন তিনি আসমানী আহবান শ্রবণের মাধ্যমে অত্যন্ত কঠিন ও কন্টকময় দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন, তখন থেকেই তাকে কোন এক অবস্থা অন্য কোন অবস্থা সম্পর্কে বিন্দুমাত্রও গাফেল কিংবা উদাসীন রাখতে পারে নি। আল্লাহ তা’আলা তাকে আমাদের এবং সমগ্র মানবতার পক্ষ হতে উত্তম বিনিময় প্রদান করুন।[3]

[1] ফাতহুলবারী ১ম খন্ড ২৭ পৃঃ।

[2] সহীহুল বুখারী- ‘কেতাবূত তাফসীর, বাবু অর রুজযা ফাহজুর’’ (অশালীন কাজ পরিহার করন) অধ্যায় ২য় খন্ড ৭৩৩ পৃঃ। এ প্রসঙ্গে অন্যান্য কিছু অধিক বর্ণিত হয়েছে। নাবী (সাঃ) বলেন, ‘আমি হেরায় এতেক্বাফ করি। যখন আমার এতেক্বাফ সম্পূর্ণ হয় তখন আমি নীচে অবতরণ করি। সে সময় আমি বাতনে ওয়াদী অতিক্রম করি তখন আমাকে ডাক দেয়া হয়। আমি তাকাই ডানে, বামে, সামনে, পিছনে কিন্তু কিছুই দেখতে পাই না। এর পর যখন উপরে দৃষ্টিপাত করি তখন এ ফিরিশতাকে দেখতে পাই।’’

যেবছর রামাযান মাসে গারে হেরায় এতেক্বাফ করেছিলেন এবং যে রমাযান মাসে তাঁর উপর ওহী অবতীর্ণ হয় তা ছিল ৩য় রমাযান, অর্থাৎ শেষ রমাযান। তাঁর নিয়ম ছিল যখন তাঁর রমাযানের এতেক্বাফ পূর্ণ হত তখন তিনি প্রথম শাওয়ালে প্রত্যুষেই মক্কা প্রত্যাবর্তন করতেন। উপরি উল্লে­খিত বর্ণনার সঙ্গে এ কথাটি জুড়ে দিলে এটা দাঁড়ায় যে, ইয়া আইউহাল মোদ্দাস্সির (হে বস্ত্রাবৃত ব্যক্তি) ওহীটি প্রথম ওহীর দশ দিন পরে প্রথম শাওয়ালে অবতীর্ণ হয়েছিল। অর্থাৎ ওহী বন্ধের পূর্ণ সময়কাল কাল ছিল ১০ দিন।

[3] ফী- যিলালিল কুরআন (সূরাহ মুযযাম্মিল ও মুদ্দাসসির, পারা ২৯, পৃষ্ঠা নং ১৬৮-১৭১।