وَكُلُّ مَا لَمْ يَتَّصِلْ بِحَالِ |إسْنَادُهُ مُنْقَطِعُ الأوْصَالِ

“আর প্রত্যেক হাদিস, যার সনদ কোনো অবস্থায় মুত্তাসিল হয় না, তাই মুনকাতি‘”। এ কবিতায় বর্ণিত ক্রমানুসারে হাদিসের অষ্টাদশ প্রকার মুনকাতি‘। হাদিসের এ প্রকারের সম্পর্ক সনদের সাথে।

‏مُنْقَطِعُ‏‏ এর আভিধানিক অর্থ: কর্তিত ও বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন অংশ, যেমন বলা হয়: العضو المنقطع عن الجسد ‘শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন অঙ্গ’। ইনকিতা‘র কারণে সনদের দু’প্রান্তে ছেদ ঘটে, এক অংশ থেকে অপর অংশ বিচ্ছিন্ন হয়, তাই ইনকিতা‘ বিশিষ্ট সনদকে মুনকাতি‘ বলা হয়।

‘মুনকাতি‘’র পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রসঙ্গে লেখক বলেন: ‘আর যে সকল হাদিসের সনদ কোনো অবস্থাতে মুত্তাসিল হয় না তাই মুনকাতি‘’।

সনদে বিভিন্ন প্রকার ছেদ বা ইনকেতা ঘটে, তবে বিশেষ প্রকার ছেদকে পরিভাষায় ইনকিতা‘ বলা হয়, অন্যান্য ইনকিতার বিভিন্ন নাম রয়েছে। একটি হাদিসকে সামনে রেখে আমরা বিভিন্ন প্রকার ‘ইনকিতা’র অনুশীলন করি:

قال الإمام البخاري- رحمه الله- حَدَّثَنَا إِبْرَاهِيمُ بْنُ الْحَارِثِ، حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ أَبِي بُكَيْرٍ، حَدَّثَنَا زُهَيْرُ بْنُ مُعَاوِيَةَ الْجُعْفِيُّ، حَدَّثَنَا أَبُو إِسْحَاقَ، عَنْ عَمْرِو بْنِ الْحَارِثِ، خَتَنِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَخِي جُوَيْرِيَةَ بِنْتِ الْحَارِثِ، قَالَ: «مَا تَرَكَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عِنْدَ مَوْتِهِ دِرْهَمًا، وَلَا دِينَارًا، وَلَا عَبْدًا، وَلَا أَمَةً، وَلَا شَيْئًا إِلَّا بَغْلَتَهُ الْبَيْضَاءَ، وَسِلَاحَهُ، وَأَرْضًا جَعَلَهَا صَدَقَةً»

ইমাম বুখারি রাহিমাহুল্লাহ বলেন: আমাদেরকে বলেছেন ইবরাহিম ইব্‌নুল হারেস, [তিনি বলেন:] আমাদেরকে বলেছেন: ইয়াহইয়া ইব্‌ন আবু বুকাইর, [তিনি বলেন:] আমাদেরকে বলেছেন: যুহাইর ইব্‌ন মুয়াবিয়াহ আল-জু‘ফি, [তিনি বলেন:] আমাদেরকে বলেছেন: আবু ইসহাক, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের শ্যালক উম্মুল মুমিনিন জুওয়াইরিয়াহ বিনতে হারেসের ভাই আমর ইব্‌নুল হারেস থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন: ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুর সময় দিরহাম, দিনার, গোলাম, বাঁদি ও কোনো বস্তু রেখে যাননি, তবে তার সাদা খচ্চর, হাতিয়ার ও একটুকরো জমি, যা তিনি সদকা করে গেছেন’।[1]

এ হাদিসে ইমাম ‘বুখারি’র উস্তাদ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পাঁচজন রাবি আছেন। এ সনদের শুরু ইবরাহিম ইব্‌নুল হারিস এবং শেষ সাহাবি আমর ইব্‌নুল হারেস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু।

সনদের শুরুতে যদি ইনকিতা‘ হয়, অর্থাৎ গ্রন্থকার যদি স্বীয় উস্তাদকে বাদ দেন তাহলে মু‘আল্লাক। বায়কুনি এ প্রকার উল্লেখ করেননি। আমরা সম্পূরক হিসেবে ইনকিতার পর মু‘আল্লাক উল্লেখ করব, ইনশাআল্লাহ।

সনদের শেষে যদি ইনকিতা‘ হয়, অর্থাৎ তাবে‘ঈ যদি সাহাবিকে বাদ দিয়ে সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন তাহলে মুরসাল। এ সনদে আমর ইব্‌নুল হারেস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু উল্লেখ না থাকলে হাদিস মুরসাল হত। লেখক রাহিমাহুল্লাহ্ মানযুমার ষোড়শ পঙক্তির প্রথমাংশে মুরসালের বর্ণনা দিয়েছেন, সেখানে আমরা সবিস্তার আলোচনা করেছি।

সনদের মাঝে ইনকিতা‘ হলে দু’অবস্থা: একজন রাবির ইনকিতা‘ অথবা দু’জন রাবির ইনকিতা‘। একজন রাবির ইনকিতা‘ হলে মুনকাতি‘। দু’জন রাবির ইনকিতা‘ হলে দু’অবস্থা: লাগাতার দু’জন রাবির ইনকিতা‘ অথবা বিচ্ছিন্নভাবে দু’জন রাবির ইনকিতা‘। লাগাতার দু’জন রাবির ইনকিতা‘ হলে মু‘দ্বাল। লেখক রাহিমাহুল্লাহ্ (১৮)নং পঙক্তিতে মু‘দ্বালের বর্ণনা দিয়েছেন। বিচ্ছিন্নভাবে দু’জন রাবির ইনকিতা‘ হলে মুনকাতি‘। লেখক এ পঙক্তিতে তার সংজ্ঞা দিয়েছেন।

সারাংশ: ইনকিতা‘ চার প্রকার: ১. সনদের শুরুতে ইনকিতা‘ হলে মু‘আল্লাক। ২. সনদের শেষে ইনকিতা‘ হলে মুরসাল। ৩. সনদের মাঝ থেকে ক্রমান্বয়ে দু’জন বা অধিক রাবির ইনকিতা‘ হলে মু‘দ্বাল। ৪. সনদের মাঝে একজন বা একাধিক রাবির বিচ্ছিন্নভাবে ইনকিতা‘ হলে মুনকাতি‘।

লেখক রাহিমাহুল্লাহ্ মুনকাতি‘ হাদিসের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তাতে ইনকিতার সবক’টি প্রকার দাখিল হয়। হোক সে ইনকিতা‘ শুরুতে, কিংবা শেষে কিংবা মাঝে। একজনের মাধ্যমে হোক কিংবা দু’জনের মাধ্যমে। ক্রমান্বয়ে হোক কিংবা বিচ্ছিন্নভাবে, অর্থাৎ মুরসাল, মু‘দ্বাল ও মু‘আল্লাক সকল প্রকার মুনকাতি‘ সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হয়, তাই লেখকের সংজ্ঞা যথাযথ হয়নি।

মুনকাতি‘র বিশুদ্ধ সংজ্ঞা: ‘যে সনদের মধ্য ভাগ থেকে একজন রাবি বা বিচ্ছিন্নভাবে একাধিক রাবি বাদ পড়ে তাই মুনকাতি‘’। ‘সনদের মধ্যভাগ থেকে’ বলার কারণে মু‘আল্লাক ও মুরসাল বাদ পড়ল, ‘বিচ্ছিন্নভাবে একাধিক রাবি’ বলার কারণে মু‘দ্বাল বাদ পড়ল। এক হাদিসে কখনো একাধিক ইনকিতা‘ জমা হয়।

একজন রাবির ইনকিতা‘র উদাহরণ:‌

حَدَّثَنَا سُلَيْمَانُ بْنُ دَاوُدَ الْمَهْرِيُّ، أَخْبَرَنَا ابْنُ وَهْبٍ، عَنْ يُونُسَ بْنِ يَزِيدَ، عَنِ ابْنِ شِهَابٍ، أَنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ وَهُوَ عَلَى الْمِنْبَر: «يَا أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ الرَّأْيَ إِنَّمَا كَانَ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُصِيبًا لِأَنَّ اللَّهَ كَانَ يُرِيهِ وَإِنَّمَا هُوَ مِنَّا الظَّنُّ وَالتَّكَلُّفُ»

“... ... ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু মিম্বারে দণ্ডায়মান অবস্থায় বলেন: হে লোক সকল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল, কারণ আল্লাহ তাকে বাতলে দিতেন। আর আমাদের সিদ্ধান্ত ধারণা ও চেষ্টা করা”।[2]

ইমাম মুনযিরি রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “এ হাদিস মুনকাতি‘, কারণ ইব্‌ন শিহাব যুহরি রহ. ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সাক্ষাত পাননি, তাই সনদ মুত্তাসিল নয়”।

দু’জন রাবির ইনকিতা‘র উদাহরণ:

حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ حُجْرٍ، حَدَّثَنَا مُعَمَّرُ بْنُ سُلَيْمَانَ الرَّقِّيُّ، عَنْ الْحَجَّاجِ بْنِ أَرْطَاةَ، عَنْ عَبْدِ الْجَبَّارِ بْنِ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: «اسْتُكْرِهَتِ امْرَأَةٌ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَدَرَأَ عَنْهَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْحَدَّ، وَأَقَامَهُ عَلَى الَّذِي أَصَابَهَا، وَلَمْ يُذْكَرْ أَنَّهُ جَعَلَ لَهَا مَهْرًا»

“... ... রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে এক নারীকে জোরপূর্বক (ব্যভিচারে) বাধ্য করা হয়েছিল, ফলে তিনি তার থেকে শাস্তি অপসারণ করেন। আর যে তাকে স্পর্শ করেছিল তার উপর তিনি হদ/শাস্তি কায়েম করেন। তিনি তার জন্য মোহর ধার্য করে ছিলেন এটা উল্লেখ করা হয়নি”। ইমাম তিরমিযি রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: ইমাম বুখারি বলেছেন: হাজ্জাজ ইব্‌ন আরত্বাত আব্দুল জাব্বার ইব্‌ন ওয়ায়েল থেকে শ্রবণ করেননি। আব্দুল জাব্বার তার পিতা থেকে শ্রবণ করেনি, তার পিতার মৃত্যুর পর সে জন্ম গ্রহণ করেছে।[3]

মুনকাতি‘ হাদিসের হুকুম:

ইমাম যুহলি রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “মুত্তাসিল হাদিস ব্যতীত মুনকাতি‘ দ্বারা দলিল দেওয়া বৈধ নয়”।[4] ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “আমাদের ও আহলে ইলমের নিকট মুরসাল দলিল নয়”। এখানে মুরসাল দ্বারা উদ্দেশ্য ছেদ বিশিষ্ট সনদের হাদিস, পারিভাষিক অর্থে মুরসাল উদ্দেশ্য নয়।[5] ইমাম বায়হাকি রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “মুনকাতি‘ হাদিস কোনো দলিল নয়”।[6] কারণ অনুল্লেখ ব্যক্তির হালত অজ্ঞাত।

মুরসাল ও মুনকাতি‘র পার্থক্য:

১. ইনকিতা‘র বিবেচনায় মুরসাল ও মুনকাতি‘ উভয় সমান, তবে ইনকিতা‘ সনদের শেষে হলে মুরসাল, আর মাঝে হলে মুনকাতি‘।

২. একদল আলেম মুরসালকে দলিল মানেন, পক্ষান্তরে মুনকাতি‘ কারো নিকট দলিল নয়।

৩. সকল মুনকাতি‘কে শাহেদ হিসেবে পেশ করা যায় না, তবে মুরসালকে শাহেদ হিসেবে পেশ করা যায়।

৪. একসময় মুরসাল হাদিসের প্রচলন ছিল, মুহাদ্দিসগণ সেকাহ রাবিও বাদ দিতেন। পক্ষান্তরে কাউকে উল্লেখ করে কাউকে ত্যাগ করা অনুল্লেখ রাবির দুর্বলতা প্রমাণ করে, তাই মুনকাতি‘ হাদিসের প্রচলন কখনো ঘটেনি।

৫. মুনকাতি‘ মুরসাল থেকে অধিক দুর্বল, আর আহলে ইলম মুরসালকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেননি। দ্বিতীয়ত মুনকাতি‘ হাদিসে অনুল্লেখ রাবির মিথ্যা বলার সম্ভাবনা অধিক, কারণ সে উত্তম যুগের নয়। পক্ষান্তরে মুরসাল হাদিসে অনুল্লেখ রাবি উত্তম যুগের, যখন মিথ্যার প্রসার ঘটেনি, তাই তার মিথ্যা বলার সম্ভাবনা কম।

[1] বুখারি: (২৭৩৯), মুসলিম: (১৬৩৭), তিনি আয়েশা রা. থেকে হাদিস বর্ণনা করেন, তার সনদে রাবির সংখ্যা ছয়জন।

[2] আবু দাউদ: (৩১১৫),

[3] ‘ইলালুল কাবির: (২/৬১৮), হাদিস নং(৬৫০)

[4] কিফায়াহ: (পৃ.৫৬)

[5] আল-জাওয়াহির: (২৪৪)

[6] সুনানুল কুবরা: (৮/৯৮)