وَمَا أَضَفْتَهُ إلىٰ الأَصْحابِ مِنْ |قَوْلٍ وَفِعْلٍ فَهْوَ مَوْقُوفٌ زُكِنْ

“আর সাহাবির সাথে কথা ও কর্ম যাই সম্পৃক্ত কর, তাই মাওকুফ মনে রেখ”। অত্র কবিতায় বর্ণিত ক্রমানুসারে হাদিসের পঞ্চদশ প্রকার মাওকুফ। এ প্রকারের সম্পর্ক মতনের সাথে। আমরা পূর্বে বলেছি, লেখক যদি মারফূ‘ ও মাকতুর মধ্যবর্তী মাওকুফ উল্লেখ করতেন, তাহলে ধারাক্রম ঠিক থাকত, তিনি তা করেননি।

সাহাবির সংজ্ঞা: ঈমান অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাক্ষাত লাভ করে ঈমানের উপর মৃত্যু বরণকারী ব্যক্তি সাহাবি। সাক্ষাত ক্ষণিকের জন্য হলেও সাহাবি। এটা শুধু নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বৈশিষ্ট্য, এ ছাড়া কারো সাথী হওয়ার জন্য দীর্ঘ সহচার্য জরুরি, কোথাও কিছু সময়ের সাক্ষাত সাথী হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। সাহাবি হওয়ার জন্য চোখে দেখা জরুরি নয়, সাক্ষাত যথেষ্ট, যেমন অন্ধ সাহাবি ইব্‌ন মাকতুম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সাক্ষাত। কেউ যদি ঈমান অবস্থায় সাক্ষাত করে মুরতাদ হয়, অতঃপর ইমান গ্রহণ করে মারা যায়, সে সাহাবি।

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মৃত অবস্থায় দর্শনকারী সাহাবি নয়, কারণ তিনি সাক্ষাত লাভ করেননি। অনুরূপ স্বপ্নে দর্শনকারী কিংবা কাফের অবস্থায় দেখে পরবর্তীতে ঈমান গ্রহণকারী ব্যক্তি সাহাবি নয়। কারণ সে ঈমান অবস্থায় সাক্ষাত করেনি।

موقوف এর আভিধানিক অর্থ: ক্ষান্ত, স্থগিত, আবদ্ধ ও উৎসর্গিত বস্তু। রাবি মাওকুফ হাদিসের সনদ যেহেতু সাহাবি পর্যন্ত নিয়ে ক্ষান্ত হন ও স্থগিত করেন, তাই এ প্রকার হাদিসকে মাওকুফ বলা হয়। অনুরূপ আল্লাহর রাস্তায় আবদ্ধ ও উৎসর্গিত সম্পদকে বলা হয় المال الموقوف বা ওয়াকফ্‌কৃত সম্পদ। (এ হিসেবে মারফূ‘ ও মাকতু‘কেও মাওকুফ বলা যায়, কারণ মারফূ‘র সনদ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট স্থগিত হয়, মাকতু‘র সনদ তাবে‘ঈ বা তাদের পরবর্তী কোনো মনীষীর নিকট স্থগিত হয়।)

‘মাওকুফে’র পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রসঙ্গে লেখক বলেন: “সাহাবির কথা ও কর্মকে মাওকুফ বলা হয়”। যেমন আব্দুল্লাহ ইব্‌ন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

«إِنَّ اللَّهَ نَظَرَ فِي قُلُوبِ الْعِبَادِ فَوَجَدَ قَلْبَ مُحَمَّدٍ صلى الله عليه وسلمخَيْرَ قُلُوبِ الْعِبَادِ، فَاصْطَفَاهُ لِنَفْسِهِ فَابْتَعَثَهُ بِرِسَالَتِهِ، ثُمَّ نَظَرَ فِي قُلُوبِ الْعِبَادِ بَعْدَ قَلْبِ مُحَمَّدٍ، فَوَجَدَ قُلُوبَ أَصْحَابِهِ خَيْرَ قُلُوبِ الْعِبَادِ فَجَعَلَهُمْ وُزَرَاءَ نَبِيِّهِ يُقَاتِلُونَ عَلَى دِينِهِ، فَمَا رَأَى الْمُسْلِمُونَ حَسَنًا فَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ حَسَنٌ، وَمَا رَأَوْا سَيِّئًا فَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ سَيِّئٌ».

“নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের অন্তরসমূহে দৃষ্টি দেন, এতে তিনি মুহাম্মদের অন্তরকে বান্দাদের অন্তরে সর্বোত্তম পান। ফলে তিনি তাকে নিজের জন্য মনোনীত করেন ও তার রিসালাত দিয়ে প্রেরণ করেন। মুহাম্মদের অন্তরের পর বান্দাদের অন্তরে দৃষ্টি দেন। এতে তিনি তার সাহাবিদের অন্তরকে বান্দাদের অন্তরে সর্বোত্তম পান। ফলে তিনি তাদেরকে তার নবীর সাহায্যকারী মনোনীত করেন, যারা তার দীনের খাতিরে জিহাদ করে। অতএব মুসলিমরা যা ভালো মনে করে আল্লাহর নিকট তাই ভালো। তারা যা খারাপ মনে করে আল্লাহর নিকট তাই খারাপ”।[1]

মাওকুফ কর্মের উদাহরণ:

عن عبد الله بن بريدة أن سلمان (الفارسي) كان يعمل بيديه فإذا أصاب شيئاً اشترى به لحماً أو سمكاً ثم يدعو الْمُجْذَمين (أي الذين ابتلوا بمرض الجُذام) فيأكلون معه.

“আব্দুল্লাহ ইব্‌ন বুরাইদাহ রাহিমাহুল্লাহ্ থেকে বর্ণিত, সালমান ফারসি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নিজ হাতে কাজ করতেন, যখন কিছু উপার্জন করতেন, তার দ্বারা গোস্ত অথবা মাছ খরিদ করতেন, অতঃপর তিনি কুষ্ঠরোগীদের দাওয়াত করতেন, তারা তার সাথে খেত”।[2]

হুকমান মারফূ‘:

সাহাবির কথা বা কর্ম যদি গবেষণা লব্দ ও ইজতিহাদি না হয়, তাহলে হুকমান মারফূ‘। যেমন বুখারি রাহিমাহুল্লাহ্ বর্ণনা করেন:

وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ، وَابْنُ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ يَقْصُرَانِ وَيُفْطِرَانِ فِي أَرْبَعَةِ بُرُدٍ وَهِيَ سِتَّةَ عَشَرَ فَرْسَخًا

“ইব্‌ন ওমর ও ইব্‌ন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু চার বুরদ অর্থাৎ ষোল ফারসাখ দূরত্বে কসর ও ইফতার করতেন”। এক ফারসাখ= তিন মাইল, এক মাইল= চার হাজার হাত। অর্থাৎ ইব্‌ন ওমর ও ইব্‌ন আব্বাস হাশেমিদের মাইল অনুসারে মক্কার রাস্তায় আট চল্লিশ মাইল দূরত্বে চার রাকাত সালাতকে দু’রাকাত কসর করতেন ও রমযানের সময় ইফতার করতেন।[3] এ জাতীয় আমল ইজতিহাদ বা গবেষণার ফল নয়, তাই এগুলো হুকমান মারফূ‘। হুকমান মারফূ‘ সম্পর্কে মারফূ‘ হাদিসের আলোচনায় বিস্তারিত বলেছি।

লেখক রাহিমাহুল্লাহ্ সাহাবির সমর্থন উল্লেখ করেননি। সাহাবির সমর্থন মাওকুফ কি-না মতভেদ আছে। খুব সম্ভব তার নিকট সাহাবির সমর্থন মাওকুফ নয়। কারণ কোনো কাজের প্রতি সাহাবির সমর্থন বা চুপ থাকা তার বৈধতা প্রমাণ করে না এবং সে কাজকে তার সাথে সম্পৃক্ত করা সঠিক নয়, তাই দলিল হিসেবে গ্রাহ্য নয়। কারণ সাহাবি একাধিক কারণে চুপ থাকতে পারে, যেমন:

ক. সাহাবি অন্যমনস্ক হতে পারেন, তাই তার সামনে কৃতকর্ম দলিল নয়।

খ. নিষেধ করার ক্ষমতা না থাকার কারণে কখনো সাহাবি চুপ থাকেন, যেমন হাজ্জাজ জুমার সালাতে বিলম্ব করলে আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু চুপ থাকেন, পরে তিনি বাতলে দেন।

গ. কোনো কর্মের হুকুম সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে সাহাবি কখনো চুপ থাকেন, অতএব তার চুপ থাকা দলিল নয়।

ঘ. কখনো অধিকতর ফিতনার আশঙ্কায় সাহাবি চুপ থাকেন, যেমন উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হজের সময় মিনায় যখন চার রাকাত সালাত আদায় করেন, ইব্‌ন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু চুপ থাকেন এবং বলেন: ‘ইখতিলাফ খারাপ জিনিস’।

ঙ. কখনো ইজতিহাদি বিষয় হওয়ার কারণে সাহাবি চুপ থাকেন, অথবা অপর কেউ নিষেধ করবেন হিসেবে চুপ থাকেন, অতএব তার চুপ থাকা সন্তুষ্টির প্রমাণ নয়।

এসব সম্ভাবনার কারণে সাহাবির সামনে সম্পাদিত কথা বা কর্মকে তার সাথে সম্পৃক্ত করা সমীচীন নয়। যদি জানা যায় তিনি চুপ থেকে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন, তাহলে তার সাথে তা সম্পৃক্ত করায় সমস্যা নেই। হাফেয ইব্‌ন হাজার রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “... যদি নিষেধ না করার ওযর কিংবা চুপ থাকার কারণ না থাকে, তাহলে তার সামনে কৃতকর্ম মাওকুফের হুকুম রাখে”।[4]

মাওকুফের উপকারিতা:

১. মাওকুফ হাদিসের সকল সনদ জমা করে মারফূ‘ হাদিসের ইল্লত জানা যায়।

২. মাওকুফ হাদিস কখনো হুকমান মারফূ‘ হয়।

৩. মাওকুফ শাহেদ হাদিসের ফলে দ্বা‘ঈফ মারফূ‘ হাদিস শক্তিশালী হয়। এ ক্ষেত্রে উভয়ের সনদ পৃথক হওয়া জরুরি।

৪. সাহাবিগণ আমাদের আদর্শ, তাদের কথা ও কর্ম অনুসরণ করে আমরা কুরআন ও সুন্নাহ বুঝি। কোনো বিষয়ে তাদের ইখতিলাফ জানা থাকলে অধিক বিশুদ্ধ মত গ্রহণ করব, ঐক্যমত্য থাকলে আমরা সেখান থেকে বের হব না। খতিব রাহিমাহুল্লাহ্ তাবে‘ঈদের সম্পর্কেও এরূপ মন্তব্য করেছেন, অতএব সাহাবিদের প্রসঙ্গে এ কথা অধিক যুক্তিযুক্ত।

৫. সাহাবির কথা আয়াত বা অপর সাহাবির কথা বিরোধী না হলে দলিল হিসেবে গণ্য। সালেহ ইব্‌ন কায়সান বলেন: “আমি ও যুহরি ইলম অন্বেষণের জন্য পরস্পর সাথী হয়েছি। শুরুতে আমরা শুধু হাদিস লিখতাম, তাই আমরা কেবল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত বিষয় সংগ্রহ করি। তিনি বলেন: অতঃপর যুহরি বলেন: আমরা সাহাবিদের থেকে বর্ণিত বিষয়ও লিখব, কারণ সেগুলো সুন্নত। তিনি বলেন: আমি বললাম না, সেগুলো সুন্নত নয়, সেগুলো লিখব না। তিনি বলেন: সে লিখেছে আমি লিখি নাই, তাই সে ধন্য হয়েছে, আর আমি বিস্মৃত হয়েছি”।[5]

জ্ঞাতব্য: সাহাবির কথা ও কাজ ব্যতীত কারো কথা ও কাজকে মাওকুফ বলা হয় না, তবে নির্দিষ্ট করে নিম্নরূপে বলা হয়:

وقفه فلان على الزهري أو على الشعبي، ونحوهما، أو موقوف على الزهري ونحوه.

অমুকে এ হাদিসকে যুহরি অথবা শা‘বির উপর ওয়াক্‌ফ করেছেন, অথবা হাদিসটি যুহরির উপর মাওকুফ ইত্যাদি।

মাওকুফ হাদিসের হুকুম:

কেউ বলেছেন: মাওকুফ কুরআন-সুন্নাহ কিংবা অপর সাহাবির কথা বিরোধী না হলে হুজ্জত ও দলিল। যদি মাওকুফের বিপক্ষে দলিল থাকে, তাহলে দলিল গ্রহণ করা হবে। যদি এক সাহাবির কথা অপর সাহাবির কথা বিরোধী হয়, তাহলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রাধান্য দিব।

কেউ বলেছেন: সাহাবির কথা দলিল নয়, কারণ সাহাবি মানুষ হিসেবে ইজতিহাদ ও গবেষণা করেন। ইজতিহাদ ভুল ও সঠিক উভয় হতে পারে।

কেউ বলেছেন: সাহাবিদের থেকে আবু বকর ও ওমরের কথা দলিল, কারণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

" اقْتَدُوا بِالَّذَيْنِ مِنْ بَعْدِي أَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ "

“তোমরা আমার পরে আবু বকর ও ওমরের অনুসরণ কর”।[6] অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন:

فَإِنْ يُطِيعُوا أَبَا بَكْرٍ وَعُمَرَ يَرْشُدُوا

“যদি তারা আবু বকর ও ওমরের অনুসরণ করে, তাহলে সঠিক পথ প্রাপ্ত হবে”।[7] অতএব তাদের ব্যতীত অপর সাহাবিদের কথা দলিল নয়।শায়খ উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “আমার নিকট স্পষ্ট যে, সাহাবি যদি আহলে ইলম ও আহলে ফিকহ হয়, তাহলে তার কথা দলিল, নচেৎ নয়। কারণ কতক সাহাবি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শরীয়তের কিছু বিধান শিখে প্রস্থান করেন, তারা ফকিহ নন এবং আলেমও নন, তাই তাদের কথা দলিল নয়”।[8]

[1] মুসনাদ আহমদ: (১/৩৭৯), হাদিস নং: (৩৬০০), বাজ্জার ফি “কাশফিল আসতার”: (১/৮১), হাদিস নং: (১৩০), “তাবরানি ফিল কাবির”: (৯/১১৮), হাদিস নং: (৮৫৮২)

[2] “হুলইয়াতুল আউলিয়া”: (১/২০০)

[3] বুখারি, বাব: باب في كم يقصر الصلاة

[4] আন-নুকাত: (১/৫১২)

[5] ই‘লামুল মুয়াক্কিয়িন: (১/৬৬)

[6] হাকেম: (৪৩৯১), সুনানে কুবরা লিল বায়হাকি: (১৫২৫১)

[7] মুসলিম: (১১০৫)

[8] শারহুল মানযুমাহ আল-বাইকুনিয়াহ লি-ইব্‌ন উসাইমিন।