২৪-নং পঙক্তির অধীন ‘মু‘আল’ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আসছে। তার সারাংশ: ‘দোষণীয় ইল্লতযুক্ত হাদিসকে মু‘আল্ বলা হয়’। সনদ ও মতন উভয় স্থানে দোষণীয় ইল্লত হতে পারে। ইল্লত দ্বারা উদ্দেশ্য সুপ্ত ও গোপন ইল্লত, বিজ্ঞ মুহাদ্দিস ব্যতীত যা কেউ বলতে পারে না। উদাহরণে পেশকৃত মিসওয়াকের হাদিস দোষণীয় ইল্লতমুক্ত। অর্থাৎ হাদিসটি কুরআনুল কারিমের কোনো আয়াত বিরোধী নয়। হাদিসটি মারফূ‘, কোনো বিচক্ষণ মুহাদ্দিস তা মাওকুফ বলেননি; অথবা হাদিসটি মুত্তাসিল, কোনো বিচক্ষণ মুহাদ্দিস তা মুরসাল বলেননি; অথবা হাদিস থেকে প্রমাণিত বিধান অকাট্য বিধানের বিপরীত নয়, তাই হাদিস সহি। হাদিস সহি হওয়ার পঞ্চম শর্তও তাতে বিদ্যমান। এ জন্য বুখারি ও মুসলিম উভয় গ্রন্থে তার স্থান হয়েছে। বুখারি ও মুসলিমের উদ্ধৃতি পর কোনো উদ্ধৃতির প্রয়োজন নেই।

এ ছাড়া উক্ত হাদিসের অনেক মুতাবে‘ ও শাহেদ[1] রয়েছে। মুতাবে‘ ও শাহিদের বলে ‘হাসান হাদিস’ সহি লি গায়রিহি ও ‘দ্বা‘ঈফ হাদিস’ হাসান লি গায়রিহির মর্যাদায় উন্নীত হয়। ইমাম তিরমিযি রাহিমাহুল্লাহ্ উক্ত হাদিস বর্ণনা শেষে বলেন: “মিসওয়াক অধ্যায়ে আবু বকর সিদ্দিক, ‘আলি, ‘আয়েশা, ইব্‌ন আব্বাস, হুযাইফা, যায়েদ ইব্‌ন খালেদ আল-জুহানি, আনাস, আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আমর, ইব্‌ন ওমর, উম্মে হাবিবা, আবু উমামাহ, আবু আইয়ূব, তাম্মাম ইব্‌ন আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইব্‌ন হানযালা, উম্মে সালামাহ, ওয়াসেলা ইব্‌ন আসকা ও আবু মুসা প্রমুখ সাহাবি থেকে বিভিন্ন সনদে হাদিস রয়েছে”।[2] আমরা শুধু ইমাম বুখারি বর্ণিত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসের উপর আলোচনা করেছি।

প্রিয়পাঠক, আমরা দেখলাম একটি হাদিস মুহাদ্দিসগণ কি পরিমাণ সতর্কতাসহ লিপিবদ্ধ করেছেন। এক মুহাদ্দিস অপর মুহাদ্দিসকে কিভাবে পরখ ও যাচাই করেছেন। আল্লাহর দীনের স্বার্থে তারা কারো সমালোচনা করতে দ্বিধা করেননি, অনুরূপ অপরের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দিতে সামান্য কুণ্ঠাবোধ করেননি। আরো দেখলাম ‘সহি’র মর্যাদায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য একটি হাদিসকে কয়েকটি ধাপ পার হতে হয়। তাই আমরা নিশ্চিত আল্লাহর অনুগ্রহে কোনো জাল হাদিস ‘সহি’র মর্যাদা পায়নি, হাদিসের ক্ষেত্রে কোনো কুচক্রীর ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। মিথ্যা হাদিস রচনাকারী কেউ নেই, যাকে আল্লাহ জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় লাঞ্ছিত করেননি। জাল ও দুর্বল হাদিস প্রচারকারী মূর্খ মুহাদ্দিসরা সাবধান, আপনারা মিথ্যাবাদী মুহাদ্দিস, কারণ মিথ্যা হাদিস প্রচার করাও মিথ্যা বলার অন্তর্ভুক্ত। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«مَنْ حَدَّثَ عَنِّى، بِحَدِيثٍ يُرَى أَنَّهُ كَذِبٌ فَهُوَ أَحَدُ الْكَاذِبِينَ»

“যে আমার পক্ষ থেকে কোন হাদিস বর্ণনা করল, যে হাদিস মিথ্যা মনে হচ্ছে, সেও একজন মিথ্যাবাদী”।[3]সকল মুসলিম স্বীয় দীন গ্রহণের ব্যাপারে সচেতন হলে, মূর্খরা জাল হাদিস প্রচার করার সুযোগ পাবে না।[4] ইনশাআল্লাহ। উম্মতে মুসলিমার উপর আল্লাহর অনুগ্রহ যে, তিনি তাদের থেকে একটি জামাত তৈরি করেছেন, যারা দীনকে হিফাজত করার স্বার্থে সাধ্যের সবটুকু সামর্থ্য ব্যয় করেছেন। তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, যেন কোনো মিথ্যাবাদীর মিথ্যারচনা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সম্পৃক্ত না হয়। তাদের এরূপ করা সম্ভব হয়েছে সনদের কারণে, তাই মুসলিম উম্মাহর নিকট সনদের গুরুত্ব অপরিসীম।

>
[1] ‘মুতাবে’, এর আভিধানিক অর্থ অনুসারী। পরিভাষায়: এক উস্তাদের দু’জন ছাত্র একটি হাদিস বর্ণনা করলে, তারা উভয়ে পরস্পর মুতাবে। এটা ‘মুতাবে’ এর এক প্রকার, এ ছাড়া আরো প্রকার রয়েছে। ‘শাহেদ’ এর আভিধানিক অর্থ সাক্ষী, পরিভাষায়: দু’জন সাহাবি যদি একটি হাদিস বর্ণনা করেন, বা একটি বিষয় দু’জন সাহাবি থেকে বর্ণিত দু’টি হাদিসে থাকে, তাহলে তাদের এক হাদিস অপর হাদিসের শাহেদ।

[2] তিরমিযি: (২২)

[3] মুসলিম: (৬২), তিরমিযি: (২৬৬২), ইব্‌ন মাজাহ: (৩৮), আহমদ: (৯০৫)

[4] সূত্রহীন হাদিস প্রত্যাখ্যান করার অভ্যাসের ফলে জাল হাদিস প্রচার রোধ হয়। হাদিস শেষে ‘আল-হাদিস’ বলা ও লেখার রীতি পরিহার করুন। এ প্রথার সমালোচনা করুন, যতক্ষণ না সূত্র ও শুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হবেন, হাদিস গ্রহণ করবেন না। পোস্টার, ফেস্টুন, হ্যাণ্ডবিল ও দেয়াল লিখন, যেখানেই সূত্রহীন হাদিস দেখুন, কর্তৃপক্ষকে অবহিত করুন। হাদিস শেষে অবশ্যই সূত্র উল্লেখ করুন। বুখারি ও মুসলিম ব্যতীত কোনো কিতাব হলে সূত্রের সাথে মুহাদ্দিসের মন্তব্য লিখুন। এভাবে জাল হাদিস প্রচার ধীরেধীরে বন্ধ হবে। পূর্বযুগে জাল হাদিস রচনাকারীরা যেরূপ লাঞ্ছিত ও ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, এ যুগেও জাল হাদিস প্রচারকারী মিথ্যাবাদী মুহাদ্দিসরা অপাক্তেয় ও পরিত্যক্ত হবে, ইনশাআল্লাহ।