সহি হাদিসের দ্বিতীয় শর্ত রাবির ‘আদল’ হওয়া। عدل ‘আদ্‌ল’ শব্দের অর্থ সোজা ও বক্রতাহীন রাস্তা, যেমন বলা হয় طريق عدل ‘সোজা রাস্তা’। পাপ পরিহারকারী ও সুস্থরুচি সম্পন্ন ব্যক্তি ন্যায় ও সোজা রাস্তার অনুসরণ করে, তাই তাকে ‘আদ্‌ল’ বা ‘আদিল’ বলা হয়। عادل কর্তাবাচক বিশেষ্য, অর্থ ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি। হাদিসের পরিভাষায় দীনদারী ও সুস্থরুচিকে عدالة বলা হয়।

‘আদিল’ এর পারিভাষিক সংজ্ঞা: মুসলিম, বিবেকী, সাবালক, দীন বিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত ও সুস্থ রুচির অধিকারী ব্যক্তিকে উসুলে হাদিসের পরিভাষায় ‘আদিল’ বলা হয়। নিম্নে প্রত্যেকটি শর্ত প্রসঙ্গে আলোকপাত করছি:

মুসলিম: রাবির ‘আদিল হওয়ার জন্য মুসলিম হওয়া জরুরি। অতএব কাফের ‘আদিল’ নয়, তার হাদিস সহি নয়। কাফের কুফরি অবস্থায় হাদিস শ্রবণ করে যদি মুসলিম হয়ে বর্ণনা করে, তাহলে তার হাদিস গ্রহণযোগ্য। কারণ সে সংবাদ দেওয়ার সময় আদিল, যদিও গ্রহণ করার সময় আদিল ছিল না। যেমন জুবাইর ইব্‌ন মুতয়িম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

«سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقْرَأُ فِي الْمَغْرِبِ بِالطُّورِ»

“আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মাগরিবের সালাতে সূরা তূর পড়তে শুনেছি”। তিনি শুনেছেন কাফের অবস্থায়, আর বর্ণনা করেছেন মুসলিম অবস্থায়।[1]

সাবালিগ: রাবির আদিল হওয়ার জন্য সাবালিগ হওয়া জরুরি। কেউ শৈশবে হাদিস শ্রবণ করে যদি সাবালিগ হয়ে বর্ণনা করে, তাহলে তার হাদিস গ্রহণযোগ্য, সাবালিগ হওয়ার পূর্বে তার হাদিস গ্রহণযোগ্য নয়। কতক সাহাবির ক্ষেত্রে এ শর্ত প্রযোজ্য নয়, যেমন ইব্‌ন আব্বাস, ইব্‌ন যুবায়ের ও নুমান ইব্‌ন বাশির প্রমুখ, তাদের হাদিস শৈশাবস্থায় গ্রহণ করা হয়েছে।

বিবেকী: রাবির আদিল হওয়ার জন্য বিবেক সম্পন্ন হওয়া জরুরি। বিবেকহীন ও পাগল ব্যক্তির বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়। পাগল দু’প্রকার: স্থায়ী পাগল ও অস্থায়ী পাগল। স্থায়ী পাগলের হাদিস কোনো অবস্থায় গ্রহণযোগ্য নয়। অস্থায়ী পাগলের মধ্যে যদি সুস্থাবস্থায় সহির অন্যান্য শর্ত বিদ্যমান থাকে, তাহলে তার হাদিস গ্রহণযোগ্য, তবে শ্রবণ করা ও বর্ণনা করা উভয় অবস্থায় সুস্থ থাকা জরুরি।

দীনদারী: রাবির ‘আদিল হওয়ার জন্য দীনদার হওয়া জরুরি, তাই পাপের উপর অটল ব্যক্তি আদিল নয়। পাপ হলেই ‘আদল বিনষ্ট হবে না, কারণ মুসলিম নিষ্পাপ নয়, তবে বারবার পাপ করা কিংবা কবিরা গুনায় লিপ্ত থাকা ‘আদল পরিপন্থী। দীনের অপব্যাখ্যাকারী, তাতে সন্দেহ পোষণকারী ও বিদ‘আতির হাদিস গ্রহণ করা সম্পর্কে আহলে ইলমগণ বিভিন্ন শর্তারোপ করেছেন।

সুস্থ রুচিবোধ: রাবির ‘আদল হওয়ার জন্য সুস্থ রুচিবোধ সম্পন্ন হওয়া জরুরি। সুস্থ রুচিবোধের নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। প্রত্যেক সমাজের নির্দিষ্ট প্রথা, সে সমাজের জন্য মাপকাঠি, যা স্থান-কাল-পাত্র ভেদে নানা প্রকার হয়। সাধারণত সৌন্দর্য বিকাশ ও আভিজাত্য প্রকাশকারী কর্মসমূহ সম্পাদন করা এবং তুচ্ছ ও হেয় প্রতিপন্নকারী কর্মসমূহ পরিত্যাগ করাকে সুস্থ রুচিবোধের পরিচায়ক বলা হয়।

হাফেয ইব্‌ন হাজার রাহিমাহুল্লাহ ‘আদল’ এর সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেন: ‘আদল’ ব্যক্তির মধ্যে এমন যোগ্যতা, যা তাকে তাকওয়া ও রুচিবোধ আঁকড়ে থাকতে বাধ্য করে”।[2]

অতএব ফাসেক ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ‘আদিল’ নয়, যদিও সে সত্যবাদী। জামাত ত্যাগকারী ‘আদিল’ নয়, যদিও সে সত্যবাদী, সুতরাং তাদের বর্ণনাকৃত হাদিস সহি নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِن جَآءَكُمۡ فَاسِقُۢ بِنَبَإٖ فَتَبَيَّنُوٓاْ أَن تُصِيبُواْ قَوۡمَۢا بِجَهَٰلَةٖ فَتُصۡبِحُواْ عَلَىٰ مَا فَعَلۡتُمۡ نَٰدِمِينَ ٦﴾ [الحجرات: ٦]

“হে ঈমানদারগণ, যদি কোনো ফাসেক তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা যাচাই করে নাও। এ আশঙ্কায় যে, তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো কওমকে আক্রমণ করে বসবে, ফলে তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে”।[3] ফাসেক ব্যক্তির সংবাদ যাচাই ব্যতীত গ্রহণ করা যাবে না, পক্ষান্তরে আদিল ব্যক্তির সংবাদ গ্রহণযোগ্য। আল্লাহ বলেন:

﴿ وَأَشۡهِدُواْ ذَوَيۡ عَدۡلٖ مِّنكُمۡ وَأَقِيمُواْ ٱلشَّهَٰدَةَ لِلَّهِۚ ٢ ﴾ [الطلاق : ٢]

“আর তোমাদের মধ্য থেকে ন্যায়পরায়ণ দু’জন সাক্ষী বানাবে। আর আল্লাহর জন্য সঠিক সাক্ষ্য দেবে।”।[4] এ আয়াতে আল্লাহ ‘আদিল’ ব্যক্তিদের সাক্ষীরূপে গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

সারাংশ: ‘আদিল’ ব্যক্তির মধ্যে দু’টি গুণ থাকা জরুরি: দীনদারী ও সঠিক রুচিবোধ। এ দু’টি গুণকে ‘আদালত’ বলা হয়। কখনো ‘আদিল’ ব্যক্তির জন্য ক্রিয়াবিশেষ্য ‘আদ্‌ল’ শব্দ ব্যবহার করা হয়, যেমন লেখক বলেছেন: يرويه عدل এখানে ‘আদ্‌ল’ অর্থ ‘আদিল’। অত্র গ্রন্থে আমরা আদিল, আদালত ও আদ্‌ল শব্দগুলো অধিক ব্যবহার করব, তাই পাঠকবর্গ ভালো করে স্মরণ রাখুন।

[1] হাদিসটি মুত্তাফাকুন আলাইহি।

[2] দেখুন: আন-নুয্‌হাহ: (পৃ.৮৩)

[3] সূরা হুজুরাত: (৬)

[4] সূরা তালাক: (২)