হিজরি প্রথম শতাব্দীর অর্ধেক শেষ না-হতেই অধিকাংশ সাহাবি জীবন সংগ্রাম শেষ করে জান্নাতুল ফিরদউসে পাড়ি জমান। ইতোপূর্বে তারা ইসলামের দাওয়াত ও আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের উদ্দেশ্যে পূর্ব-পশ্চিম বিচরণ করেন, ফলে বিভিন্ন দেশের তাবে‘ঈগণ তাদের থেকে ইলম হাসিল করার সুযোগ পান, তবে তারা কতক সমস্যার মুখোমুখি হন, যেমন:

১. তারা দেখলেন, নবী যুগ থেকে দূরত্বের সাথে মানুষের স্মৃতি শক্তি লোপ পাচ্ছে, লেখা-লেখির উপর নির্ভরতা বাড়ছে ও আরব-অনারব মিশ্রিত হচ্ছে।

২. ধীরে ধীরে সনদ দীর্ঘ হচ্ছে, সাহাবি থেকে তাবে‘ঈ, কখনো তাবে‘ঈ থেকে তাবে‘ঈ ইলম শিখছেন।

৩. মুসলিমের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে রাবি ও হাদিসের সনদ বাড়ছে।

৪. তাবে‘ঈদের যুগে কয়েকটি বাতিল ফের্কার আত্মপ্রকাশ ঘটে, যেমন শিয়া, খাওয়ারেজ, অতঃপর মুতাযিলা, মুরজিয়াহ ও জাবরিয়া ইত্যাদি। তারা দেখলেন বাতিল ফিরকাগুলো তাদের বিদআতের সমর্থনে মিথ্যা হাদিস রচনায় লিপ্ত।

তাবে‘ঈগণ এসব সমস্যার সমাধানের জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তারা হাদিসের সুরক্ষার স্বার্থে সাহাবিদের থেকে শেখা নীতির সাথে নতুন কতিপয় নীতি তৈরি করেন, যেমন:

তাবে‘ঈদের অনুসৃত নীতি:

১. তাবে‘ঈগণ রাবি ও সনদ যাচাই করেন, যেন মিথ্যাবাদীদের কোনো রচনা হাদিসের স্বীকৃতি না পায়। তারা রাবিদের অবস্থা, নাম, উপাধি, উপনাম, জন্ম ও সফর ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করেন। রাবিদের দেশ সফর, অবস্থান, মৃত্যু এবং প্রত্যেকের ভালো-মন্দ জানেন, তাদের স্মৃতি শক্তি ও হাদিসের উপর দক্ষতা সংরক্ষণ করেন। এভাবে তারা গ্রহণযোগ্য ও পরিত্যক্ত রাবিদের পৃথক করেন।[1]

তারা সনদকে দীনের অংশ মনে করেন, কারণ সহি, দুর্বল ও জাল হাদিস জানার সনদ একটি মাধ্যম। ইমাম মুসলিম সহি মুসলিমের ভূমিকায়[2] আব্দুল্লাহ ইব্‌ন মুবারক থেকে বর্ণনা করেন:

«‏الْإِسْنَادُ مِنْ الدِّينِ، وَلَوْلَا الْإِسْنَادُ لَقَالَ مَنْ شَاءَ مَا شَاءَ ‏»، ‏ وقَالَ أيضاً: «‏بَيْنَنَا وَبَيْنَ الْقَوْمِ الْقَوَائِمُ» ‏يَعْنِي الْإِسْنَادَ».

“সনদ দীনের অংশ, যদি সনদ না থাকত তাহলে যে যা ইচ্ছা তাই বলত”। তিনি অন্যত্র বলেন: “আমাদের ও পূর্ববর্তীদের মাঝে সিঁড়ি [সনদ] রয়েছে”। আবু ইসহাক ইবরাহিম ইব্‌ন ঈসা তালাকানি রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: আমি আব্দুল্লাহ ইব্‌ন মুবারককে বললাম: হে আবু আব্দুর রহমান, এ হাদিসটি কেমন:

«إِنَّ مِنْ الْبِرِّ بَعْدَ الْبِرِّ أَنْ تُصَلِّيَ لِأَبَوَيْكَ مَعَ صَلَاتِكَ وَتَصُومَ لَهُمَا مَعَ صَوْمِكَ»

“নিশ্চয় সদাচরণের সাথে আরো সদাচরণ হচ্ছে যে, তুমি তোমার সালাতের সাথে তোমার পিতা-মাতার জন্য সালাত পড়বে এবং তোমার সিয়ামের সাথে তাদের জন্য সিয়াম রাখবে”। আব্দুল্লাহ বললেন: হে আবু ইসহাক, এ হাদিস কার থেকে বর্ণিত? তিনি বলেন: আমি বললাম: শিহাব ইব্‌ন খিরাশ থেকে। তিনি বললেন: সে সেকাহ, সে কার থেকে? আমি বললাম: হাজ্জাজ ইব্‌ন দিনার থেকে। তিনি বললেন: সে সেকাহ, সে কার থেকে? আমি বললাম: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে। তিনি বললেন: হে আবু ইসহাক, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও হাজ্জাজ ইব্‌ন দিনারের মাঝে অনেক দূরত্ব রয়েছে, যেখানে উটের গর্দান নুইয়ে যায়, তবে সদকার ক্ষেত্রে দ্বিমত নেই। অর্থাৎ হাজ্জাজ ইব্‌ন দিনার ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাঝে অপর রাবি রয়েছে, যাদেরকে হাজ্জাজ উল্লেখ করেনি, অতএব সনদ মুত্তাসিল নয়, তাই হাদিস সহি নয়।

এ যুগে হাদিসের কতক পরিভাষা সৃষ্টি হয়, যেমন ‘মুদাল্লাস’। মুহাদ্দিসগণ মুদাল্লিসের হাদিস গ্রহণ করতেন না, যতক্ষণ না সে বাদ দেওয়া রাবির নাম বলে দিত। অনুরূপ ‘মুরসাল’, ‘মুত্তাসিল’, ‘মারফূ‘’, ‘মাওকুফ’ ও ‘মাকতু’ ইত্যাদি পরিভাষার সৃষ্টি হয়।

২. তাবে‘ঈগণ রাবিদের গুণাগুণ নির্ণয়ে বিভিন্ন পরিভাষা গ্রহণ করেন, যেমন ‘দ্বা‘ঈফ’, ‘কাযযাব’, ‘সেকাহ’, ‘আদিল’ ও ‘দাবেত’ ইত্যাদি, যেন সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদী, দুর্বল ও সবল রাবিদের চিহ্নিত করা যায়।

৩. তাবে‘ঈগণ সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে হাদিস লিপিবদ্ধ করা আরম্ভ করেন। কতক তাবে‘ঈ হাদিসের কিতাব লিখেন, যেমন হাম্মাম ইব্‌ন মুনাব্বিহ আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত হাদিসগুলো জমা করেন। খলিফা ওমর ইব্‌ন আব্দুল আযিয রাহিমাহুল্লাহ সরকারি তত্ত্বাবধানে আবু বকর ইব্‌ন মুহাম্মদ ইব্‌ন হাযম ও মুহাম্মদ ইব্‌ন শিহাব যুহরিকে বিভিন্ন দেশ থেকে হাদিস সংগ্রহ করার নির্দেশ দেন, যেন আলেমদের মৃত্যুর কারণে ইলম বিনষ্ট না হয় ও মিথ্যা হাদিস দীনে প্রবেশ না করে। এ সময়ে লিখিত সবচেয়ে পুরনো কিতাব হিসেবে আমাদের নিকট পৌঁছেছে মা‘মার ইব্‌ন রাশেদ সান‘আনি (মৃ.১৫৪হি.) রচিত جامع ‘জামে’ ও ইমাম মালিক (মৃ.১৭৯হি.) রচিত ‘মুয়াত্তা ইমাম মালিক’ গ্রন্থদ্বয়।

৪. তাবে‘ঈগণ বিভিন্ন দেশ থেকে হাদিসের সনদগুলো জমা করে পরখ করেন ও এক হাদিসের সাথে অপর হাদিস তুলনা করেন। এভাবে হাদিসের শুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হন।

৫. যারা পেশা হিসেবে হাদিস শিক্ষা করেনি বা হাদিস বর্ণনার নীতি জানেনি, তাবে‘ঈগণ তাদের হাদিস ত্যাগ করেন। অর্থাৎ এক শ্রেণীর ইবাদত গোজার ও দুনিয়া ত্যাগীদের হাদিস তারা ত্যাগ করেন, যারা উসুলে হাদিস জানতেন না, তবে মানুষদেরকে ইবাদত ও নেক আমলের প্রতি আহ্বান করতেন। তারা নেক আমলের প্রতি উদ্বুদ্ধ ও খারাপ আমল থেকে সতর্ক করে অনেক হাদিস রচনা করেন। আলেমগণ তাদের হাদিস থেকে সতর্ক করেন। তারা বলেন: কারো হাদিস গ্রহণ করার জন্য রাবির নেককার হওয়া যথেষ্ট নয়, বরং আলেমদের ইলমি মজলিসে বসা ও বর্ণনা নীতি জানা আবশ্যক। ইমাম মালিকের উস্তাদ আবুয যিনাদ আব্দুল্লাহ ইব্‌ন যাকওয়ান বলেন: “আমি মদিনায় এক শো ব্যক্তিকে পেয়েছি, তারা সবাই বিশ্বস্ত, তবে তাদের হাদিস গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ তারা হাদিস বর্ণনার উপযুক্ত নয়”।[3] তারা নেককার, তবে তারা সহি-দ্বা‘ঈফ চিনে না, তাদের থেকে ভুলের সম্ভাবনা বেশী।৬. নবীন তাবে‘ঈগণ প্রবীণ তাবে‘ঈদের নিকট হাদিস পেশ করতেন, যেমন স্বর্ণকারের নিকট স্বর্ণ পেশ করা হয়। তারা হাদিসের দোষ-ত্রুটি বলে দিতেন। তখনো হাদিস যাচাইয়ের নীতিগুলো স্বতন্ত্র কোনো কিতাবে লিখা হয়নি, কারণ হাদিসের প্রত্যেক ছাত্রের নিকট তা প্রসিদ্ধ ছিল।

[1] উদাহরণের জন্য দেখুন: বুখারি: (১১/২০১), হাদিস নং: (৬৪০৩)

[2] মুসলিম: (১/১৫), হাদিস নং: (১৫-১৬)

[3] মুসলিম: (১/১৫)