হাদীসের নামে জালিয়াতি মৃত্যু, জানাযা, দুআ, যিকর ইত্যাদি ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

মহান আল্লাহ মুমিনগণকে নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর মহান নবীর (ﷺ) উপর সালাত (দরুদ) ও সালাম পাঠ করতে। হাদীসের আলোকে আমরা জানতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর উপর দরুদ ও সালাম পাঠ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও নেক কর্ম। সহীহ হাদীসের আলোকে দরুদ ও সালামের ফযীলতের বিষয়গুলো ‘রাহে বেলায়াত’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত এ সকল ফযীলতের মধ্যে রয়েছে:

(১). সালাত ও সালাম পাঠকারীর উপর আল্লাহ নিজে সালাত (রহমত) ও সালাম প্রেরণ করেন। একবার সালাত (দরুদ) পাঠ করলে মহান আল্লাহ সালাত পাঠকারীকে ১০ বার সালাত (রহমত) প্রদান করবেন, তার ১০টি মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন, ১০টি সাওয়াব লিখবেন এবং ১০টি গোনাহ ক্ষমা করবেন। একবার সালাম পাঠ করলে আল্লাহ তাকে ১০ বার সালাম জানাবেন।

(২). সালাত বা দরুদ পাঠকারী যতক্ষণ দরুদ পাঠে রত থাকবেন ততক্ষণ ফিরিশতাগণ তার জন্য দোয়া করতে থাকবেন। একবার সালাত (দরুদ) পাঠ করলে আল্লাহ এবং তাঁর ফিরিশতাগণ তাঁর উপর সত্তর বার সালাত (রহমত ও দোয়া) করবেন।

(৩). সালাত ও সালাম পাঠকারীর সালাত ও সালাম তার পরিচয়সহ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে পৌঁছান হবে।

(৪). রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে সালাত পাঠকারীর জন্য দোয়া করবেন।

(৫). দরুদ পাঠ কেয়ামতে নবী (ﷺ)-এর শাফায়াত লাভের ওসীলা।

(৬). মহান আল্লাহ সালাত (দরুদ) পাঠকারীর দোয়া কবুল করবেন এবং সকল দুনিয়াবী ও পারলৌকিক সমস্যা মিটিয়ে দেবেন।

সালাতের এত সহীহ ফযীলত থাকা সত্ত্বেও কতিপয় আবেগী মানুষ এর ফযীলতে আরো অনেক বানোয়াট কথা হাদীস নামে প্রচার করেছেন।

‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ’ এটুকু কথা হলো দরুদের ন্যূনতম পর্যায়। এর সাথে ‘সালাম’ যোগ করলে সালামের ন্যূনতম পর্যায় পালিত হবে। যেমন, ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিও সাল্লিম’। অথবা ‘সাল্লাল্লাহু আলা মুহাম্মাদিও ওয়া সাল্লামা।’ সহীহ হাদীসে দরুদ পাঠের জন্য দরুদে ইবরাহিমী ও ছোট বাক্যের দুই একটি দরুদ পাওয়া যায়। হাদীসে বর্ণিত দরুদের বাক্যগুলো ‘রাহে বেলায়াত’ ও ‘এহইয়াউস সুনান’ গ্রন্থদ্বয়ে উল্লেখ করেছি। আমাদের সমাজে প্রচলিত দরুদের বিভিন্ন নির্ধারিত বাক্য সবই বানোয়াট।

দরুদ-সালাম বিষয়ক কিছু প্রচলিত বানোয়াট বা অনির্ভরযোগ্য কথা:

১. জুমু‘আর দিনে নির্দিষ্ট সংখ্যায় দরুদের ফযীলত

জুমুআর দিনে বেশি বেশি দরুদ পাঠ করতে সহীহ হাদীসে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে এ দিনে নির্ধারিত সংখ্যক দরুদ পাঠের বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি। এ দিনে বা রাতে ৪০ বার, ৫০ বার, ১০০ বার, ১০০০ বার বা অনুরূপ কোনো সংখ্যায় দরুদ পাঠ করলে ৪০, ৫০ ১০০ বছরের গোনাহ মাফ হবে, বা বিশেষ পুরস্কার বা ফযীলত অর্জন হবে অর্থে কোনো সহীহ হাদীস নেই। মুমিন যথাসাধ্য বেশি বেশি দরুদ ও সালাম এ দিনে পাঠ করবেন। নিজের সুবিধা ও সাধ্যমত ‘ওযীফা’ তৈরি করতে পারেন। যেমন আমি প্রতি শুক্রবারে অথবা প্রতিদিন ১০০, ৩০০ বা ৫০০ বার দরুদ ও সালাম পাঠ করব।

২. দরুদে মাহি বা মাছের দরুদ

দরুদে মাহি ‘মাছের দরুদ’-এর কাহিনীতে বর্ণিত ঘটনাবলি সবই মিথ্যা ও বানোয়াট। অনুরূপভাবে এ দরুদের ফযীলতে বর্ণিত সকল কথাই বানোয়াট ও মিথ্যা কথা। এ বানোয়াট কাহিনীটিতে বলা হয়েছে, যে, রাসূলুল্লাহর (ﷺ) যুগে একব্যক্তি নদীর তীরে বসে দরুদ পাঠ করতেন। ঐ নদীর একটি রুগ্ন মাছ শুনে শুনে দরুদটি শিখে ফেলে এবং পড়তে থাকে। ফলে মাছটি সুস্থ হয়ে যায়। পরে এক ইহূদীর জালে মাছটি আটকা পড়ে। ইহূদীর স্ত্রী মাছটিকে কাটতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অবশেষে মাছটিকে ফুটন্ত তেলের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। মাছটি ফুটন্ত তেলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে দরুদটি পাঠ করতে থাকে। এতে ঐ ইহূদী আশ্চার্যান্বিত হয়ে মাছটিকে নিয়ে রাসূলুল্লাহর (ﷺ) দরবারে উপস্থিত হয়। তাঁর দোয়ায় মাছটি বাকশক্তি লাভ করে এবং সকল বিষয় বর্ণনা করে। .... পুরো ঘটনাটিই ভিত্তিহীন মিথ্যা।

৩. দরুদে তাজ, দরুদে হক্কানী, তুনাজ্জিনা, ফুতুহাত, শিফা ইত্যাদি

দরুদে তাজ, দরুদে হক্কানী, দরুদে তুনাজ্জিনা, দরুদে ফুতুহাত, দরুদে রু‘ইয়াতে নবী (ﷺ), দরুদে শিফা, দরুদে খাইর, দরুদে আকবার, দরুদে লাখী, দরুদে হাজারী, দরুদে রূহী, দরুদে বীর, দরুদে নারীয়া, দরুদে শাফেয়ী, দরুদে গাওসিয়া, দরুদে মুহাম্মাদী .....।

এ সকল দরুদ সবই পরবর্তী যুগের মানুষদের বানানো। এগুলোর ফযীলতে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা।

এ সকল দরুদের বাক্যগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাল কথার সমন্বয়। তবে এভাবে রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে বিশেষ ভাবে পড়ার জন্য কোনো নির্দেশনা নেই। এ সকল দরুদের বাক্যগুলো বিন্যাস পরবর্তী মানুষদের তৈরি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো পাঠ করলে দরুদ পাঠের সাধারণ ফযীলত লাভ হতে পারে। তবে এগুলোর বিশেষ ফযীলতে বর্ণিত কথাগুলো বানোয়াট।

যেমন, (আল্লাহুম্মা সাল্লি ‘আলা মুহাম্মাদিনিন নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি) হাদীস সম্মত একটি দরুদ। আবার (আল্লাহুম্মা সাল্লি ‘আলা মুহাম্মাদিন বি ‘আদাদি কুল্লি দায়িওঁ ওয়া বি ‘আদাদি কুল্লি ইল্লাতিওঁ ওয়া শিফা) কথাটির মধ্যে কোনো দোষ নেই। এ বাক্যের মাধ্যমে দরুদ পাঠ করলে দরুদ পাঠের সাধারণ সাওয়াব পাওয়ার আশা করা যায়। তবে এগুলোর জন্য কোনো বিশেষ ফযীলতের কথা রাসুলুল্লাহ (ﷺ) থেকে প্রমাণিত নয়। সকল বানানো দরুদেরই একই অবস্থা। কোনো কোনো বানানো দরুদের মধ্যে আপত্তিকর কথা রয়েছে।