১. ‘কুলুখ’ ব্যবহার না করলে গোর আযাব হওয়া

প্রচলিত একটি গ্রন্থে বলা হয়েছে: ‘‘হাদীসে আছে, যাহারা বাহ্য-প্রস্রাবের পর কুলুখ ব্যবহার না করিবে তাহাদের ন্যায় কঠিন গোর আযাব কাহারও হইবে না’’[1]

কথাটি এভাবে ঠিক নয়। এভাবে একে হাদীস বললে, রাসূলুল্লাহ () -এর নামে মিথ্যা বলা হবে। সম্ভবত এখানে একটি সহীহ হাদীসের অনুবাদ বিকৃত ভাবে করা হয়েছে। বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, পেশাব থেকে ভালভাবে পবিত্র না হওয়া কবর আযাবের অন্যতম কারণ। একটি হাদীসে আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুললাহ () বলেছেন:

أَكْثَرُ عَذَابِ اَلْقَبْرِ مِنْ اَلْبَوْلِ

‘‘কবরের অধিকাংশ শাস্তি পেশাব থেকে।’’[2]

উপরের কথাটি সম্ভবত এ হাদীসের বিকৃত অনুবাদ। এ হাদীস এবং এ অর্থের অন্য সকল হাদীসে পেশাব থেকে ভালভাবে পবিত্র হতে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। কোনো হাদীসেই বলা হয় নি যে, ‘কুলুখ’ ব্যবহার না করলে কোনো অন্যায় হবে বা শাস্তি হবে।

মলমূত্র ত্যাগের পর পরিপূর্ণরূপে পবিত্র হওয়া ইসলামের অন্যতম বিধান। রাসূলুল্লাহ ও সাহাবীগণ ইস্তিন্জার সময় কখনো শুধু পাথর বা ঢিলা ব্যবহার করতেন। শুধু পাথর বা কুলুখ ব্যবহার করে পবিত্রতা অর্জন করলে মূল ওয়াজিব আদায় হবে এবং কোনোরূপ অপরাধ বা গোনাহ হবে না। তবে পানি ব্যবহার করা সর্বাবস্থায় উত্তম। বিভিন্ন হাদীসে পানি দ্বারা ইসতিনজা করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাধারণভাবে পানি দ্বারা ইসতিনজা করতেন বলে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।[3]

কুলুখ ও পানি উভয়ের ব্যবহার, অর্থাৎ প্রথমে পাথর বা কুলুখ ব্যবহারের পরে পানি ব্যবহারের কথা দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে। ফকীহগণ এভাবে কুলুখ ও পানি উভয়ের ব্যবহার উত্তম বলে উল্লেখ করেছেন।

এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। মলমুত্র পরিত্যাগের পরে পবিত্র হওয়ার দুটি পর্যায় রয়েছে: (ক) পবিত্রতা। অর্থাৎ মলমুত্র ত্যাগের পরে বসা অবস্থাতেই পানি বা পাথর দ্বারা ময়লা স্থানকে পরিষ্কার করা। একে আরবীতে ইসতিনজা বা ইসতিজমার বলা হয়। (খ) সতর্কতা। এর অর্থ ইসতিনজার পরেও উঠে দাঁড়ালে বা হাঁটতে গেলে দু এক ফোটা পেশাব বেরিয়ে আসতে পারে বলে ভয় পেলে গলা খাঁকারি দিয়ে বা কয়েক পা হাঁটাচলা করে সন্দেহ থেকে মুক্ত হওয়া। আরবীতে একে ‘ইসতিবরা’ বলা হয়।

হাদীস শরীফে প্রথম পর্যায়ে ইসতিনজার জন্য পানি বা পাথর ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। একটি যয়ীফ হাদীসে পেশাবের পরে বসা অবস্থাতেই তিনবার পুরুষাঙ্গ টান দেয়ার কথা বলা হয়েছে।[4] এ ছাড়া আর কোনো বিষয় হাদীস শরীফে বর্ণিত হয় নি। রাসূলুল্লাহ বা তাঁর সাহাবীগণ ইসতিনজার সময় পাথর বা ‘কুলুখ’ ব্যবহার করতে গিয়ে কখনো উঠে দাঁড়ান নি, হাঁটাচলা, লাফালাফি, গলাখাকারি ইত্যাদি কিছুই করেন নি। পেশাব ও পায়খানা উভয় ক্ষেত্রেই তাঁরা স্বাভাবিকভাবে বসা অবস্থাতেই পাথর বা পানি ব্যবহার করে পরিচ্ছন্নতা অর্জন করেছেন।

পরবর্তী যুগের আলিমগণ সন্দেহের ক্ষেত্রে সতর্কতার জন্য এরূপ হাঁটা চলার বিধান দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, মানুষের তবিয়ত বিভিন্ন প্রকারের। যদি কারো একান্ত প্রয়োজন হয় তাহলে উঠে দাঁড়িয়ে বা দুই এক পা হেঁটে, গলাখাকারি দিয়ে বা এধরনের কোনো কাজের মাধ্যমে তারা ‘পেশাব একদম শেষ হয়েছে’ -এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারে। আর যার মনে হবে যে, বসা অবস্থাতেই সে পরিপূর্ণ পাক হয়ে গিয়েছে তার জন্য সুন্নাতের বাইরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।[5]

কাজেই কুলুখ করা বলতে যদি আমরা ‘কুলুখ নিয়ে হাঁটাচলা করা’ বুঝি, অথবা দাবি করি যে, রাসূলুল্লাহ () এরূপ হাঁটাচলা করেছেন বা করতে বলেছেন তাহলে তাঁর নামে মিথ্যা দাবি করা হবে।

[1] মো. গোলাম রহমান, মকছুদোল মো'মেনীন, পৃ. ৮৪।

[2] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১২৫; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/২৯৩; আল-বূসীরী, মিসবাহুয যুজাজা ১/৫১।

[3] তিরমিযী, আস-সুনান (কিতাবুত তাহারাহ, বাবুল ইসতিনজা বিল মা) ১/৩০ (নং ১৯)।

[4] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১১৮; আহমাদ, আল-মুসনাদ ৪/৩৪৭।

[5] আব্দুল হাই লাখনবী, মাজমূআতুল ফাতাওয়া, উর্দু ১/১৫৫।