হাদীসের নামে জালিয়াতি বেলায়াত, আওলিয়া ও ইলম বিষয়ক ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
৩০. ইল্ম সন্ধান করা পূর্বের পাপের মার্জনা

ইমাম তিরমিযী তাঁর সুনান গ্রন্থে নিম্নের হাদীসটি সংকলন করেছেন:

مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ كَانَ كَفَّارَةً لِمَا مَضَى

‘‘যদি কোনো ব্যক্তি ইলম শিক্ষা করে, তবে তা তার পূর্ববর্তী পাপের জন্য ক্ষতিপূরণ (বা পাপমোচনকারী) হবে।’’[1]

ইমাম তিরমিযী ছাড়াও দারিমী, তাবারানী প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসটি সংকলন করেছেন। সকলেই ‘অন্ধ আবূ দাঊদ’ নুফাই ইবনুল হারিস-এর মাধ্যমে হাদীসটি সংকলন করেছেন। তিনি ১৫০ হিজরীর দিকে ইন্তিকাল করেন। সমসাময়িক ও পরবর্তী যুগের প্রখ্যাত মুহাদ্দিসগণ তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, এ ব্যক্তি হাদীসের নামে মিথ্যা বলতেন।

সমসাময়িক প্রসিদ্ধ তাবিয়ী কাতাদা ইবনু দি‘আমা (১১৭ হি) তাকে মিথ্যাবাদী বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম মুসলিম তাঁর সহীহ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, প্রসিদ্ধ তাবে-তাবিয়ী হাম্মাম ইবনু ইয়াহইয়া (১৬৫ হি) বলেন, ‘অন্ধ আবূ দাউদ’ আমাদের কাছে এসে হাদীস বলতে থাকেন। তিনি সাহাবী বারা ইবনু আযিব (৭৩ হি), সাহাবী যাইদ ইবনু আরকাম (৬৮ হি) প্রমুখ সাহাবী থেকে হাদীস শুনেছেন বলে দাবি করেন। তিনি দাবি করেন যে, বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ১৮ জন সাহাবী থেকে তিনি হাদীস শিক্ষা করেছেন। তখন আমরা প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মুহাদ্দিস কাতাদার কাছে তার বিষয়ে প্রশ্ন করলাম। তিনি বলেন লোকটি মিথ্যা বলছে। সে এ সকল সাহাবীকে দেখে নি বা তাদের থেকে কোনো কিছু শুনে নি। কারণ কয়েক বছর আগে মহামারীর সময়েও তাকে আমরা দেখেছি দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে বেড়াতে।[2]

ইমাম বুখারী, আহমাদ ইবনু হাম্বাল, আবু হাতিম রাযী প্রমুখ মুহাদ্দিস তাকে অত্যন্ত দুর্বল ও পরিত্যক্ত রাবী বলে উল্লেখ করেছেন। ইয়াহইয়া ইবনু মায়ীন, নাসাঈ, ইবনু হিববান প্রমুখ মুহাদ্দিস তাকে মিথ্যাবাদী ও জালিয়াত বলে উল্লেখ করেছেন। এই ব্যক্তিটি ছাড়া অন্য কেউ কোনো সনদে এ হাদীসটি বর্ণনা করেন নি। এ ব্যক্তি দাবি করেন যে, তাকে আব্দুল্লাহ ইবনু সাখবারাহ নামক এক ব্যক্তি বলেছেন, তাকে তার পিতা সাখবারাহ বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ () এ কথাটি বলেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু সাখবারাহ নামক ব্যক্তিটিও অপরিচিত। অন্ধ আবূ দাঊদ ছাড়া আর কেউ তার নাম উল্লেখ করেন নি বা তাকে চিনেন বলে উল্লেখ করেন নি। অনুরূপভাবে এ ‘সাখবারাহ’ নামক সাহাবীর কথাও এ ‘অন্ধ আব্দুল্লাহ’ ছাড়া কেউ কখনো উল্লেখ করেন নি। এ নামে কোনো সাহাবী ছিলেন বলে অন্য কোনো সূত্র থেকে জানা যায় না।[3]

হাদীসটি উল্লেখ করে উপরের বিষয়গুলোর দিকে ইঙ্গিত করে ইমাম তিরমিযী বলেন: ‘‘এ হাদীসটির সনদ দুর্বল। আবূ দাঊদ দুর্বল। আব্দুল্লাহ ইবনু সাখবারাহ এবং তার পিতার বিশেষ কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। এ অন্ধ আবূ দাঊদের বিষয়ে কাতাদা এবং অন্যান্য আলিম কথা বলেছেন।[4]

ইমাম তিরমিযী এখানে হাদীসটির সনদ দুর্বল বলেই ক্ষান্ত হয়েছেন। দুর্বলতার পর্যায় উল্লেখ করেন নি। আমরা জানি যে, দুর্বল বা যয়ীফ হাদীসের এক প্রকার ‘জাল’ হাদীস। যে দুর্বল হাদীসের বর্ণনাকারী মিথ্যা হাদীস বর্ণনার অভিযোগে অভিযুক্ত সে দুর্বল হাদীসকে জাল হাদীস বলে গণ্য করা হয়। এ কারণে পরবর্তী কোনো কোনো মুহাদ্দিস এ হাদীসটিকে ‘জাল’ বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লামা নূরুদ্দীন হাইসামী এই হাদীস উল্লেখ করে বলেন:

فِيْهِ أَبُوْ دَاوُدَ الأَعْمَى وَهُوَ كَذَّابٌ

‘‘এর সনদে অন্ধ আবূ দাউদ রয়েছেন যিনি একজন প্রসিদ্ধ মিথ্যাবাদী।’’[5]

[1] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/২৯।

[2] মুসলিম, আস-সহীহ ১/২১-২২।

[3] ইবনু হাজার, তাহযীব ১০/৪১৯; তাকরীব, পৃ: ৫৬৫; আল ইসাবা ৩/৩৫।

[4] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/২৯।

[5] হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/১২৩। আলবানী, যায়ীফুল জামি, পৃ ৮১৯।