হাদীসের নামে জালিয়াতি জাল হাদীস প্রমাণে জাল পুস্তক ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

২০০৫ খৃস্টাব্দে (الجزء المفقود من الجزء الأول من المصنف): ‘মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকের প্রথম খন্ডের হারানো অংশ’’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। ‘ঈসা ইবন আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ ইবন মানি হিমইয়ারী’ নামক সংযুক্ত আরব আমিরাতের একজন আলিম গ্রন্থটি সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছেন। প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ড. মাহমূদ সায়ীদ মামদূহ পুস্তকটির প্রশংসাপত্র লিখেন।

ভূমিকায় শাইখ হিমইয়ারীর বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, নূর মুহাম্মাদীই যে প্রথম সৃষ্টি তা তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করেন। কিন্তু এ বিষয়ক হাদীসটির মুসান্নফ আব্দুর রায্যাক গ্রন্থে বিদ্যমান না থাকায় এটি প্রমাণের জন্য তিনি অত্যন্ত অস্থিরচিত্ত ছিলেন। তিনি তুরস্ক, ইয়ামান ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের গ্রন্থাগারগুলিতে এ গ্রন্থের পান্ডুলিপিগুলো অনুসন্ধান করে কোথাও কোনো পান্ডুলিপিতে এ হাদীসটি পান নি। হঠাৎ করেই ড. সাইয়িদ মুহাম্মাদ আমীন কাদিরী বারাকাতী নামক একজন ভারতীয় রেজবী সূফী শাইখ তাকে মুসান্নাফ গ্রন্থে প্রথম দুটি খন্ডের একটি পান্ডুলিপি প্রদান করেন যার মধ্যে এ হাদীসটি বিদ্যমান। বিশ্বের কোথাও এ পান্ডুলিপির দ্বিতীয় কোনো কপি পাওয়া যায় না। এতে লেখা আছে ৯৩৮ হিজরীতে বাগদাদ নগরীতে ইসহাক ইবনু আব্দুর রাহমান সুলাইমানী এ পান্ডুলিপিটি লিখেন। তিনি কোন্ পান্ডুলিপি দেখে এটি লিখেছেন, এর সনদ কী ইত্যাদি বিষয় তাতে লেখা নেই। হিমইয়ারী দাবি করেন যে, এ পান্ডুলিপিটি দশম হিজরী শতকেই লেখা এবং এর বয়স প্রায় ৫০০ বৎসর।

এ পান্ডুলিপিটিতে মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকের শুরুতে দশটি পরিচ্ছেদ বিদ্যমান যে অধ্যায়গুলি বিশ্বের অন্য কোনো পান্ডুলিপিতে নেই। প্রথম পরিচ্ছেদটির নাম (ﷺباب في تخليق نور محمد) ‘নূর মুহাম্মাদী সৃষ্টির অধ্যায়’। পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলো ওযূ অধ্যায়ের। মুদ্রিত গ্রন্থটির প্রথম অধ্যায়ের নাম ‘কিতাবুল ঈমান’: ঈমান অধ্যায়। এ অধ্যায়ে উপরের একটিই মাত্র পরিচ্ছেদ রয়েছে। এ পরিচ্ছেদে উপরের হাদীসটির সনদ নিম্নরূপ:

عبد الرزاق عن معمر عن ابن المنكدر عن جابر قال:

আব্দুর রায্যাক মা’মার থেকে, তিনি ইবনুল মুনকাদির থেকে, তিনি জাবির থেকে, তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ কে জিজ্ঞাসা করলাম....।

প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণ পান্ডুলিপি এবং এতে বিদ্যমান হাদীসগুলোর সনদ ও মতন বিচার করে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন যে, পান্ডুলিপিটি পুরোটাই জাল। আমাদের এ গ্রন্থের পরিসরে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। আমরা সংক্ষেপে নিম্নের বিষয়গুলোর দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি:

(১) তুর্কি সুলতানগণ বিগত কয়েকশত বৎসর যাবৎ বিশ্বের সকল দুষ্প্রাপ্য পান্ডুলিপি সংগ্রহ করেছেন, যেগুলি তুরস্কের বিভিন্ন লাইব্রেরিতে বিদ্যমান। খোদাবখশ লাইব্রেরী-সহ ভারতেও অনেক প্রসিদ্ধ গ্রন্থাগারে মুসলিম বিশ্বের প্রাচীন ও দুষ্প্রাপ্য পান্ডুলিপিগুলি সংরক্ষিত। উপনিবেশ সময়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশের পন্ডিতগণ মুসলিম দেশগুলো থেকে সকল পান্ডুলিপি সংগ্রহ করে নিজেদের দেশের যাদুঘর ও পাঠাগারে সংরক্ষণ করেছেন। বিশ্বের কোনো যাদুঘরে বা লাইব্রেরিতে নেই এমন একটি পান্ডুলিপি আল্লামা রেজা খান ব্রেলবীর ভক্ত কোনো পীর সাহেবের বাড়িতে পাওয়া যাবে! বিশেষত আল্লামা আহমাদ রেযা খান ব্রেলবী (১২৭২-১৩৪০ হি/ ১৮৫৬-১৯২১খৃ) গবেষণা অধ্যয়নকে ওহাবীদের পরিচয় বলে গণ্য করতেন। তিনি বলেন:

أهل سنة بحر قوالي وعرس : ديوبندي بحر تصنيفات ودرس

خرج سني بر قبور وخانقاه : خرج نجدي بر علوم ودرس كاه

‘‘আহল সুন্নাত কাওয়ালী ও উরশের সাগর; দেওবন্দি (ওহাবী) গ্রন্থরচনা ও পাঠদানের সমূদ্র । সুন্নীর খরচ কবর ও খানকার জন্য। নজদীর (ওহাবীর) খরচ ইলম ও মাদরাসার জন্য।’’[1]

এমন একজন পীর সাহেব ৫০০ বৎসর যাবৎ একটি পান্ডুলিপি সংরক্ষণ করলেন, বিশ্বের বিশেষজ্ঞ আলিমদেরকে দিয়ে এর বিশুদ্ধতা প্রমাণ না করে তিনি ‘নূর মুহাম্মাদী’ প্রমাণের জন্য ‘পাগলপারা’ শাইখ হিমইয়ারীকেই তা প্রদান করলেন! তিনিও তা কাউকে দেখতে দিচ্ছেন না!

(২) পান্ডুলিপিটি ৯৩৩ হিজরী সালে লেখা বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু লিপিকার কার কাছ থেকে শুনে বা কোন্ পান্ডুলিপি দেখে লিখেছেন তা বলেন নি। আবার ৯৩৩ সাল থেকে ১৪২৫ সাল পর্যন্ত ৫০০ বৎসর পান্ডুলিপিটি কোথায় ছিল তারও কোনো বিবরণ এতে নেই। ইসলামী পান্ডুলিপি সম্পর্কে অভিজ্ঞ সকলেই জানেন যে, এটি পান্ডুলিপির জালিয়াতি প্রমাণ করে।

(৩) পান্ডুলিপির যে পৃষ্ঠাগুলি বইটিতে ছাপা হয়েছে সেগুলি প্রমাণ করে যে, এটি আধুনিকযুগের ভারতীয় লিখন পদ্ধতিতে লেখা।

(৪) এ বইটিতে দাবি করা হয়েছে যে, মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় ‘কিতাবুল ঈমান’ বা ‘ঈমান অধ্যায়’। অথচ প্রাচীনকাল থেকে মুহাদ্দিসগণ মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকের অধ্যায়গুলির বর্ণনায় ‘কিতাবুল ঈমান’-এর কথা উল্লেখ করেন নি; বরং কিতাবুত তাহারাহ বা পবিত্রতার অধ্যায় দিয়ে এ পুস্তকের শুরু বলে উল্লেখ করেছেন।[2]

(৫) বিশ্বে কোনো মুসান্নাফ গ্রন্থ কিতাবুল ঈমান দিয়ে শুরু করা হয় নি। ইমাম আব্দুর রায্যাক (২১১ হি)-এর পরে আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম ইবন উসমান আবু বাকর ইবন আবী শাইবা (২৩৫ হি) তাঁর প্রসিদ্ধ ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থ রচনা করেন। এটিও ‘কিতাবুত তাহারাত’ দিয়ে শুরু। উল্লেখ্য যে, অধ্যায়, পরিচ্ছেদ ও হাদীসের বিন্যাসে উভয় মুসান্নাফ প্রায় একইরূপ।

(৬) এ জাল পুস্তকটির দাবি অনুসারে ইমাম আব্দুর রায্যাক তাঁর মুসান্নাফ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় ‘কিতাবুল ঈমানে’ একটিই মাত্র পরিচ্ছেদ সংকলন করেন! হাদীসের গ্রন্থগুলো সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞান থাকলেও কি একথা কল্পনা করা যায়? বিশ্বের শতশত হাদীসগ্রন্থের মধ্যে একটি গ্রন্থও কি পাওয়া যায় যার ‘কিতাবুল ঈমান’-এর মধ্যে একটিই মাত্র পরিচ্ছেদ বিদ্যমান?!

(৭) পান্ডুলিপিটি যিনি রচনা করেছেন তিনি হাদীস সম্পর্কে অভিজ্ঞ, তবে ভাল অভিজ্ঞ নন। বইটির দ্বিতীয় হাদীসের সনদ নিম্নরূপ:

عبد الرزاق عن ابن جريج قال: أخبرني البراء قال:

‘‘আব্দুর রায্যাক: ইবন জুরাইজ থেকে, ইবনু জুরাইজ বলেন: আমাকে বারা (রা) বলেন...’’।[3] জুরাইজ (১৫০ হি) একজন তাবি-তাবিয়ী। বারা ইবন আযিব (৭১ হি) বা কোনো সাহাবীকে তিনি দেখেনও নি। কোনো তাবি-তাবিয়ী যদি বলেন: ‘‘অমুক সাহাবী থেকে’’ তবে তা ‘মুনকাতি’ বলে গণ্য। আর যদি কোনো তাবি তাবিয়ী বলেন যে, অমুক সাহাবী তাকে বলেছেন, তবে তিনি মিথ্যাবাদী বলে গণ্য হন। ইবন জুরাইজ কখনোই মিথ্যাবাদী ছিলেন না; তবে এ পান্ডুলিপিটির লেখক জ্ঞানের স্বল্পতা বা জালিয়াতির ব্যবস্তায় এরূপ ভয়ঙ্কর মিথ্যা লিখেছেন। এরূপ আরেকটি মহামিথ্যা বইটির ২৪ নং হাদীসের সনদ:

عبد الرزاق عن ابن جريج عن الزهري أنه سمع عقبة بن عامر...

‘‘আব্দুর রায্যাক, ইবন জুরাইজ থেকে, তিনি যুহরী থেকে, তিনি উকবা ইবন আমির (রা) কে বলতে শুনেছেন...।’’[4]

উকবা ইবন আমির (রা) ৪৪ হিজরীতে মিসরের গভর্নর নিযুক্ত হন এবং ৬০ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। ইমাম যুহরী ৫০ বা ৫৮ হিজরী সালে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। যুহরী কখনো উকবা থেকে হাদীস শুনেন নি। পান্ডুলিপিটির লেখক অজ্ঞতা বশত এরূপ লিখেছেন।

[1] মুফতী ইয়ার খান, দিওয়ানে সালেক (চট্টগ্রাম, মুহাম্মাদী কুতুবখানা), পৃ. ৬১।

[2] মুহাম্মাদ ইবন খাইর ইশবিলী (৫৭৫ হি); ফিহরিসত (বৈরুত, দারুল কুতুব, ১৯৯৮), পৃ১০৮।

[3] হিমইয়ারী, আল-জুযউল মাফকূদ, পৃষ্ঠা ৫৫।

[4] হিমইয়ারী, আল-জুযউল মাফকূদ, পৃষ্ঠা ৮৪।