ইহূদীগণের মধ্যে যাদুর প্রচলন ছিল। তারা আরো দাবি করত যে, সুলাইমান (আঃ) যাদু ব্যবহার করেই ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। তারা আরো দাবি করত যে, স্বয়ং সুলাইমান (আঃ) এবং হারূত ও মারূত নামক দুই ফিরিশতা তাদেরকে যাদু শিক্ষা দিয়েছেন। এদের এ মিথ্যাচারের প্রতিবাদে কুরআন কারীমে সূরা বাকারার ১০২ আয়াতে এরশাদ করা হয়েছে:

وَاتَّبَعُوا مَا تَتْلُو الشَّيَاطِينُ عَلَى مُلْكِ سُلَيْمَانَ وَمَا كَفَرَ سُلَيْمَانُ وَلَكِنَّ الشَّيَاطِينَ كَفَرُوا يُعَلِّمُونَ النَّاسَ السِّحْرَ وَمَا أُنزِلَ عَلَى الْمَلَكَيْنِ بِبَابِلَ هَارُوتَ وَمَارُوتَ وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنْ أَحَدٍ حَتَّى يَقُولا إِنَّمَا نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلا تَكْفُرْ

‘‘এবং সুলাইমানের রাজত্বে শয়তানগণ যা আবৃত্তি করত তারা (ইহূদীরা) তা অনুসরণ করত। সুলামইমান কুফুরী করেন নি কিন্তু শয়তানরাই কুফুরী করেছিল। তারা মানুষকে যাদু শিক্ষা দিত। এবং যা বাবিলে হারূত ও মারূত ফিরিশতাদ্বয়ের উপর অবতীর্ণ হয়েছিল। তারা কাউকে শিক্ষা দিত না, এ কথা না বলা পর্যন্ত যে, ‘আমরা পরীক্ষা স্বরূপ, সুতরাং তোমরা কুফুরী করিও না।...’’

এ আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যায় সাহাবী ও তাবিয়ীগণের যুগ থেকেই মুফাসসিরগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রা) ও অন্য কোনো কোনো মুফাস্সির বলেছেন যে, হারূত ও মারূতের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত আরবী (ما) অর্থ (না)। অর্থাৎ হারূত মারূত ফিরিশতাদ্বয়ের উপরেও যাদু অবতীর্ণ করা হয় নি। সুলাইমানের (আঃ) সম্পর্কে ইহূদীদের দাবি যেমন মিথ্যা, হারূত ও মারূত সম্পর্কেও তাদের দাবি মিথ্যা।

তবে অধিকাংশ মুফাস্সির বলেছেন যে, ইহূদীগণ যখন কারামত-মুজিযা ও যাদুর মধ্যে পার্থক্য না করে সবকিছুকেই যাদু বলে দাবি করতে থাকে তখন আল্লাহ দু’জন ফিরিশতাকে দায়িত্ব প্রদান করেন যাদুর প্রকৃতি এবং যাদু ও মুজিযার মধ্যে পার্থক্য শিক্ষা দানের জন্য। তারা মানুষদেরকে এ পার্থক্য শিক্ষা দিতেন এবং বলতেন, তোমরা এই জ্ঞানকে যাদুর জন্য ব্যবহার করে কুফুরী করবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেকেই যাদু ব্যবহারের কুফুরীতে নিমগ্ন হতো। কোনো কোনো মুফাস্সির বলেছেন, তাঁরা দুইজন মানুষ ছিলেন; বিশেষ জ্ঞান, পান্ডিত্য বা সৎকর্মশীলতার কারণে তাদেরকে মানুষ ফিরিশতা বলে অভিহিত করতো। তাঁরা এভাবে মানুষদেরকে যাদুর অপকারিতা শিক্ষা দিতেন।

হারূত ও মারূত সম্পর্কে কুরআনে আর কোনো কিছুই বলা হয় নি। সহীহ হাদীসেও এ বিষয়ে কিছু পাওয়া যায় না। কিন্তু এ বিষয়ক অনেক গল্প-কাহিনী হাদীস নামে বা তাফসীর নামে তাফসীরের গ্রন্থগুলোতে বা সমাজে প্রচলিত। কাহিনীটির সার-সংক্ষেপ হলো, মানব জাতির পাপের কারণে ফিরিশতাগণ আল্লাহকে বলেন, মানুষের এত অপরাধ আপনি ক্ষমা করেন কেন বা শাস্তি প্রদান করেন না কেন? আল্লাহ তাদেরকে বলেন, তোমরাও মানুষের মত প্রকৃতি পেলে এরূপ পাপ করতে। তারা বলেন, কক্ষনো না। তখন তারা পরীক্ষার জন্য হারূত ও মারূত নামক দু’জন ফিরিশতাকে নির্বাচন করেন। তাদেরকে মানবীয় প্রকৃতি প্রদান করে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়। তারা যোহরা নামক এক পরমা সুন্দরী মেয়ের প্রেমে পড়ে মদপান, ব্যভিচার ও নরহত্যার পাপে জড়িত হন। পক্ষান্তরে যোহরা তাদের কাছ থেকে মন্ত্র শিখে আকাশে উড়ে যায়। তখন তাকে একটি তারকায় রূপান্তরিত করা হয়। ...

এ গল্পগুলো মূলত ইহূদীদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনী। তবে কোনো কোনো তাফসীর গ্রন্থে এগুলি হাদীস হিসাবেও বর্ণিত হয়েছে। এ বিষয়ক সকল হাদীসই অত্যন্ত দুর্বল বা জাল সনদে বর্ণিত হয়েছে। কোনো কোনো মুহাদ্দিস বিভিন্ন সনদের কারণে কয়েকটি বর্ণনাকে গ্রহণযোগ্য বলে মত প্রকাশ করেছেন। অনেক মুহাদ্দিস সবগুলোই জাল বলে মত প্রকাশ করেছেন।

আল্লামা কুরতুবী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস ও মুফাস্সির উল্লেখ করেছেন যে, এ সকল গল্প ফিরিশতাগণ সম্পর্কে ইসলামী বিশ্বাসের বিপরীত। ইহূদী, খৃস্টান ও অন্যান্য অনেক ধর্মে ফিরিশতাগণকে মানবীয় প্রকৃতির বলে কল্পনা করা হয়। তাদের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ও সিদ্ধান্ত শক্তি আছে বলেও বিশ্বাস করা হয়। ইসলামী বিশ্বাসে ফিরিশতাগণ মানবীয় প্রবৃত্তি, নিজস্ব চিন্তা বা আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদের প্রবৃত্তি থেকে পবিত্র। তাঁরা মহান আল্লাহকে কিছু জানার জন্য প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু তাঁরা আল্লাহর কোনো কর্ম বা কথাকে চ্যালেঞ্জ করবেন এরূপ কোনো প্রকারের প্রকৃতি তাদের মধ্যে নেই। কাজেই এ সকল কাহিনী ইসলামী আকীদার বিরোধী।

এ বিষয়ে আল্লামা ইবনু কাসীর ও অন্যান্য কতিপয় মুহাদ্দিস সকল বর্ণনা একত্রিত করে তুলনামূলক নিরীক্ষার ভিত্তিতে বলেছেন যে, এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ () থেকে কোনো প্রকার হাদীস সহীহ বা নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত হয় নি। তাঁর নামে বর্ণিত এ বিষয়ক হাদীসগুলো জাল। তবে সাহাবীগণ থেকে তাঁদের নিজস্ব কথা হিসাবে এ বিষয়ে কিছু কিছু বর্ণনার সনদ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য। একথা খুবই প্রসিদ্ধ যে এ সকল বিষয়ে কোনো কোনো সাহাবী (রা) ইহূদীদের মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন কাহিনী শুনতেন ও বলতেন। সম্ভবত এ সকল বর্ণনার ভিত্তিতেই তারা এগুলি বলেছেন। আল্লাহই ভাল জানেন।[1]

[1] তাবারী, ১/৪৫১-৪৬৪; কুরতুবী, ২/৪১-৫৩; ইবনু কাসীর, ১/১৩৫-১৪৪; সুয়ূতী ও মুহাল্লী; তাফসীরুল জালালাইন, পৃ. ২২; ইবনু আবী হাতিম, আল ইলাল ২/৬৯-৭০; আল-আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৪৩৯-৪৪০; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/২০৯-২১০; মুহাম্মাদ আবূ শাহবাহ, আল-ইসরাঈলিয়্যাত, পৃ. ১৫৯-১৬৬।