হাদীসের নামে জালিয়াতি ৮. মিথ্যা হাদীস বিষয়ক কিছু বিভ্রান্তি ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
৮. ৬. নিরীক্ষা বনাম ঢালাও ও অনুমান-নির্ভর কথা

জাল হাদীসের ক্ষেত্রে জঘন্যতম ও সবচেয়ে মারাত্মক বিভ্রান্তি হলো, নিরীক্ষা ব্যতিরেকে ঢালাও মন্তব্য। আমরা ইতোপূর্বে বারংবার উল্লেখ করেছি এবং পূর্বের সকল আলোচনা থেকে নিশ্চিতরূপে বুঝতে পেরেছি যে, ওহী বা ধর্মীয় শিক্ষার বিশুদ্ধতা রক্ষা ও সূত্র সংরক্ষণ মুসলিম উম্মাহর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। অন্য কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় তাদের ধর্মগ্রন্থ, ধর্ম-প্রচারক বা প্রবর্তকের শিক্ষা ও নির্দেশাবলীর বিশুদ্ধতা রক্ষায় এরূপ সচেষ্ট হয় নি।

সাহাবীগণের যুগ থেকে সকল যুগের মুসলিম আলিম ও মুহাদ্দিসগণ রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে প্রচারিত প্রতিটি কথা চুলচেরা নিরীক্ষা ও যাচাই করে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু অনেক ‘প্রাচ্যবিদ’, তাঁদের চিন্তাধারায় প্রভাবিত অনেক মুসলিম ও অনেক অনভিজ্ঞ বা অজ্ঞ মুসলিম ‘চিন্তাবিদ’ বা ‘গবেষক’ হাদীসের বিশুদ্ধতা ও নির্ভুলতার বিষয়ে ঢালাও মন্তব্য ও মতামত ব্যক্ত করেন। হাদীস যেহেতু জাল হয়েছে, কাজেই কোনো হাদীসই নির্ভরযোগ্য নয়, অথবা অমুক হাদীসের অর্থ সঠিক নয় কাজেই তা জাল বলে গণ্য হবে .... ইত্যাদি। কেউ কেউ মনে করেন, মুহাদ্দিসগণ সম্ভবত শুধু সনদই বিচার করেছেন, অর্থ, শব্দ, বাক্য, ভাব ইত্যাদি বিচার ও নিরীক্ষা করেন নি। এগুলো সবই ভিত্তিহীন ধারণা ও উর্বর মস্তিকের বর্বর কল্পনা মাত্র। মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষা পদ্ধতির সাথে পরিচয়হীনতা এর মূল কারণ। এর চেয়েও বড় কারণ ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ও ইসলাম থেকে মানুষদেরকে বিচ্যুত করার উদগ্র বাসনা।

ইহূদী-খৃস্টান প্রাচ্যবিদ পন্ডিতগণ, কাদিয়ানী, বাহাঈ ইত্যাদি অমুসলিম সম্প্রদায় ও শিয়া সম্প্রদায় ছাড়াও কিছু ‘জ্ঞানপাপী’ পন্ডিত হাদীসের বিরুদ্ধে এরূপ ঢালাও মন্তব্য করেন অথবা মর্জিমাফিক অর্থ বিচার করে হাদীস ‘জাল’ বলে ঘোষণা করেন। তারা নিজেদেরকে মুসলিম দাবি করতে চান, কিন্তু ইসলাম পালন করতে চান না। এরা সালাত, সিয়াম, যাকাত, হজ্জ, হালাল ভক্ষণ, পবিত্রতা অর্জন, ইত্যাদি কোনো ‘কর্ম’ই করতে রাজি নন। কুরআনে উল্লিখিত এ সকল বিষয়কে ‘ইচ্ছামত’ ব্যাখ্যা করে বাতিল করে দিতে চান। কিন্তু ভয় হলো, হাদীস নিয়ে। হাদীস থাকলে তো ইচ্ছামত ব্যাখ্যা অচল। রাসূলুল্লাহ ()-এর ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। এজন্য তারা নির্বিচারে হাদীসকে জাল বলে বাতিল করতে চান।

আশা করি, এ গ্রন্থের আলোচনা থেকে পাঠক এ সকল মানুষের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পেরেছেন। আমরা বুঝতে পেরেছি যে, মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষা ও বিচার পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত সুক্ষ্ম ও বৈজ্ঞানিক। তাঁরা সনদ, শ্রুতি, পান্ডুলিপি, ভাষা, অর্থ, ও প্রাসঙ্গিক সকল প্রমাণের আলোকে যে সকল হাদীসকে সহীহ বলে চিহ্নিত করেছেন সেগুলোর বিশুদ্ধতা ও যথার্থতা সম্পর্কে তথ্য-প্রমাণবিহীন ঢালাও সন্দেহ একমাত্র জ্ঞানহীন মুর্খ বা বিদ্বেষী জ্ঞানপাপী ছাড়া কেউই করতে পারে না। আর এ নিরীক্ষার ভিত্তিতে যে সকল হাদীসকে তাঁরা জাল ও বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছেন সেগুলোকে গায়ের জোরে হাদীস বলে দাবি করাও রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে মিথ্যা বলার ভয়ঙ্কর দুঃসাহস ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে তথ্য ভিত্তিক নিরীক্ষার দরজা সর্বদা উন্মুক্ত।