এ সকল মহান মাশাইখ রচিত বলে কিছু পুস্তক প্রচলিত। এগুলো ‘উস্তাদ বা পীরের সাহচর্যের স্মৃতি ও আলোচনা হিসেবে রচিত।’ খাজা মুঈন উদ্দীন চিশতী তাঁর উস্তাদ উসমান হারুনীর সাথে তাঁর দীর্ঘ সাহচর্যের বিবরণ লিখেছেন ‘আনিসুল আরওয়াহ’ নামক পুস্তকে। খাজা কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী তাঁর উস্তাদ মুঈন উদ্দীন চিশতীর সাথে তার সাহচর্যের স্মৃতিগুলি লিখেছেন ‘দলিলুল আরেফীন’ পুস্তকে। খাজা ফরীদ উদ্দীন গঞ্জে শক্কর তাঁর উস্তাদ কুতুব উদ্দীনের সাহচর্যের স্মৃতিগুলো লিখেছেন ‘ফাওয়ায়েদুস সালেকীন’ পুস্তকে। খাজা নিজাম উদ্দীন আউলিয়া তাঁর উস্তাদ ফরীদ উদ্দীনের সাহচর্যের স্মৃতিগুলো লিখেছেন ‘রাহাতিল কুলুব’ পুস্তকে। প্রসিদ্ধ গায়ক আমীর খসরু তাঁর উস্তাদ নিজাম উদ্দীনের সাহচর্যের স্মৃতি ও নির্দেশাবলি লিখেছেন ‘রাহাতুল মুহিববীন’ পুস্তকে।
এ সকল পুস্তক পাঠ করলে প্রতীয়মান হয় যে এগুলো পরবর্তী যুগের মানুষদের রচিত জাল পুস্তক। অথবা তাঁরা কিছু লিখেছিলেন সেগুলোর মধ্যে পরবর্তী যুগের জালিয়াতগণ ইচ্ছামত অনেক কিছু ঢুকিয়েছে। এই পুস্তকগুলোতে কুরআন-হাদীস ভিত্তিক অনেক ভাল কথা আছে। পাশাপাশি অগণিত জাল হাদীস ও মিথ্যা কথায় সেগুলো ভরা। এ ছাড়া ঐতিহাসিক তথ্যাবলি উল্টোপাল্টা লেখা হয়েছে। এমন সব ভুল রয়েছে যা প্রথম দৃষ্টিতেই ধরা পড়ে।
প্রত্যেক বুযুর্গ তার মাজালিসগুলোর তারিখ লিখেছেন। সন তারিখগুলো উল্টোপাল্টা লেখা। শাওয়াল মাসের ৪ তারিখ বৃহস্পতিবার ও ৭ তারিখ রবিবার লেখা হয়েছে। অর্থাৎ শাওয়ালের শুরু সোমবারে। কিন্তু ১৫ই জিলক্বদ সোমবার লেখা হয়েছে। অর্থাৎ যিলকাদের শুরুও সোমবারে! শাওয়াল মাস ২৮ দিনে হলেই শুধু তা সম্ভব![1] আবার পরের মাজলিস হয়েছে ৫ই জিলহজ্জ বৃহস্পতিবার। জিলকাদের শুরু সোম, মঙ্গল বা বুধবার যেদিনই হোক, কোনোভাবেই ৫ই জিলহজ্জ বৃহস্পতিবার হয় না! আবার পরের মাজলিস ২০শে জিলহজ্ব শনিবার! ৫ তারিখ বৃহস্পতিবার হলে ২০ তারিখ শনিবার হয় কিভাবে? [2] ২০ শে রজব সোমবার এবং ২৭শে রজব রবিবার লেখা হয়েছে। ৫ই শাওয়াল শনিবার অথচ ২০ শে শাওয়াল বৃহস্পতিবার[3]. ... এরূপ অগণিত অসঙ্গতি ও জালিয়াতি প্রথম নজরেই ধরা পড়ে।
কাকী (রাহ) উল্লেখ করেছেন যে, ৬১৩ হিজরীতে তিনি বাগদাদে মুঈন উদ্দীন চিশতীর নিকট মুরীদ হন। এরপর কয়েক মাজলিস তিনি বাগদাদেই থাকেন। এরপর তিনি তাঁর সহচরদের নিয়ে আজমীরে আগমন করেন। এভাবে আমরা নিশ্চিত জানতে পারছি যে, ৬১৩ হি (১২১৬ খৃ)-এর পরে মুঈন উদ্দীন চিশতী ভারতে আগমন করেন। বখতিয়ার কাকী আরো উল্লেখ করেছেন যে, আজমীরে অবস্থান কালে আজমীরের রাজা পৃথ্বীরাজ তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতো। একপর্যায়ে তিনি বলেন, আমি পৃথ্বীরাজকে মুসলমানদের হাতে জীবিত বন্দী অবস্থায় অর্পণ করলাম। এর কয়েক দিন পরেই সুলতান শাহাবুদ্দীন ঘোরীর সৈন্যগণ পৃথ্বীরাজকে পরাজিত ও বন্দী করে।[4]
অথচ ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করছেন যে, ৬১৩ হিজরীর প্রায় ২৫ বছর পূর্বে ৫৮৮ হিজরীতে (১১৯২ খৃস্টাব্দে) তারাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে সুলতান ঘোরী পৃথীরাজকে পরাজিত করে আজমীর দখল করেন। আর ৬১৩ হিজরীতে খাজা মুঈন উদ্দীনের আজমীর আগমনের ১০ বছর পূবে ৬০৩ হিজরীতে (১২০৬ খৃস্টাব্দে) শিহাবুদ্দীন ঘোরী মৃত্যুবরণ করেন। এ থেকে বুঝা যায় যে, এ সকল কাহিনী সবই বানোয়াট। অথবা মুঈন উদ্দীন (রাহ) অনেক আগে ভারতে আসেন। এক্ষেত্রে আনিসুল আরওয়াহ, দলিলুল আরেফীন, ফাওয়ায়েদুস সালেকীন ইত্যাদি পুস্তকে লেখা সন-তারিখ ও প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি বানোয়াট।
এভাবে আমরা দেখছি যে, হাদীসের নামে জালিয়াতির ন্যায় বুযুর্গদের নামেও জালিয়াতি হয়েছে ব্যাপকভাবে। হাদীসের ক্ষেত্রে যেমন সুনির্দিষ্ট নিরীক্ষা পদ্ধতি রয়েছে, বুযুর্গদের ক্ষেত্রে তা না থাকাতে এদের নামে জালিয়াতি ধরার কোনো পথ নেই। জালিয়াতগণ বুযুর্গদের নামে ‘জাল পুস্তক’ লিখে সেগুলোর মধ্যে জাল হাদীস উল্লেখ করেছে, এবং তাঁদের লেখা বইয়ের মধ্যে জাল হাদীস ঢুকিয়ে দিয়েছে। এখন এ সকল জাল হাদীসের বিরুদ্ধে কিছু বললেই সাধারণ মুসলিম বলবেন, অমুক বুযুর্গের পুস্তকে এই হাদীস রয়েছে, তা জাল হয় কিভাবে?! এভাবে জালিয়াতগণ এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছে!
[2] প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৭, ১৪৯
[3] নিযাম উদ্দীন আউলিয়া, রাহাতুল মুহিববীন, পৃ. ২৪, ৪৩, ৮৩, ৮৮।
[4] আনিসুল আরওয়াহ: (দলিুলল আরেফীন ও ফাওয়ায়েদুস সালেকীনসহ) পৃ. ৬২, ১১৯, ১৩৮।