বাস্তবে আমরা দেখতে পাই যে, অনেক প্রখ্যাত সাধক, যাঁদেরকে আমরা সাহেবে কাশফ বলে জানি, তাঁরা তাঁদের বিভিন্ন গ্রন্থে অনেক কথা লিখেছেন যা নিঃসন্দেহে ভুল ও অন্যায়। শাইখ আব্দুল কাদের জীলানী (৫৬১ হি.) লিখেছেন যে, ঈমান বাড়ে এবং কমে। ঈমানের হরাস-বৃদ্ধি স্বীকার করাকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত ও ফেরকায়ে নাজিয়ার আলামত বলে গণ্য করেছেন এবং ঈমানের হরাস-বৃদ্ধি না মানাকে বাতিলদের আলামত বলে গণ্য করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, কোনো মুসলমানের উচিত নয় যে সে বলবে: ‘আমি নিশ্চয় মুমিন’, বরং তাকে বলতে হবে যে, ‘ইন্শা আল্লাহ আমি মুমিন’। ইমাম আবু হানীফা (রাহ) ও তাঁর অনুসারীগণ যেহেতু ঈমানের হরাস-বৃদ্ধি স্বীকার করেন না, আমলকে ঈমানের অংশ মনে করেন না এবং ‘ইনশা আল্লাহ আমি মুমিন’ বলাকে আপত্তিকর বলে মনে করেন, সে জন্য তিনি তাঁকে ও তাঁর অনুসারীগণকে বাতিল ও জাহান্নামী ফিরকা বলে উল্লেখ করেছেন।[1]
ইমাম গাযালী লিখেছেন যে, গান-বাজনা, নর্তন-কুর্দন ইত্যাদি আল্লাহর নৈকট্য পাওয়ার পথে সহায়ক ও বিদ‘আতে হাসানা। তিনি গান-বাজনার পক্ষে অনেক দুর্বল ও জাল হাদীস উল্লেখ করেছেন।[2]
এরূপ অগণিত উদাহরণ তাঁদের গ্রন্থে পাওয়া যায়। কাজেই, তাঁরা যদি কোনো হাদীসকে সহীহ বলেও ঘোষণা দেন তারপরও তার সনদ বিচার ব্যতিরেকে তা গ্রহণ করা যাবে না। কারণ রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা, সকল বানোয়াট কথাকে চিহ্নিত করা দীনের অন্যতম ফরয। কেউ সন্দেহযুক্ত হাদীস রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর নামে বর্ণনা করলেও তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। কাজেই, এ ক্ষেত্রে কোনো শিথিলতার অবকাশ নেই।[3]
এ প্রসঙ্গে আব্দুল হাই লাখনবীর অভিজ্ঞতা প্রণিধানযোগ্য। শাইখ আব্দুল কাদির জীলানীর গ্রন্থে বিদ্যমান ‘‘সালাতুল উসবূ’’ বা সপ্তাহের প্রত্যেক দিবস ও রাত্রির জন্য বিশেষ সালাত, আশূরার দিবস ও রাত্রির বিশেষ সালাত ইত্যাদি বিষয়ক হাদীসগুলি জাল বলে তিনি উল্লেখ করলে তাঁর এক বন্ধু তার সাথে বিতর্ক করেন। এ বিষয়ে আললামা লাখনবী বলেন:
عارضني بعض الأعزة قائلاً: قد ذَكَرَ صلواتِ يوم عاشوراء وليلته وغيرهما من أيام السنة ولياليها جَمْعٌ من المشايخ الصوفية في دفاترهم العلية وذكروا فيها أخباراً مروية، فكيف لا يُعْمَلُ بِهَا ويُحْكَمُ بكونها مختلقة؟ فقلت: لا عبرة بذكرهم، فإنهم ليسوا من المحدثين ولا أسندوا الحديث إلى أحد من المخرجين. فقال لي: ما تقول؟ تَفَكَّرْ فيما فيه تجول! إذا لم يُعْتَبَر بنقل هؤلاء الأكابر فمن هو يُعْتَبر بنقله وذكره؟ فقلت: لا عجب، فإن الله تعالى جعل لكل مقام مقالاً وخلق لكل فن رجالاً.... فعاد قائلاً: إن العَجَبَ كلَّ العَجَبِ أن أحداً من المشايخ العظام كالإمام الغزالي ... ومولانا عبد القادر الجيلاني ... وأبي طالب المكي ... وغيرهم ممن تقدمهم وتأخرهم وهم من الصوفية الكبار معدودون في طبقات الأولياء حملة ألوية الأسرار يضع حديثا على رسول الله صلى الله عليه وسلم! مع اشتهار أن الكذب على رسول الله صلى الله عليه وسلم لا يحل لمسلم فضلاً عن مثل هذا المسلم!! قلت؟ حاشاهم ثم حاشاهم! عن أن يضعوا حديثاً ... فقال: فإذا لم ينسب الوضع إلى هؤلاء فمن هو واضعها؟ فقلت: قوم من جهلة الزهاد أو قوم من أرباب الزندقة والإلحاد؛ فإن الرواة الذين وقعت في رواياتهم المقلوبات والموضوعات ... على ما بسطه ابن الجوزي والسيوطي ... منقسمون على أقسام .... فقال: فكيف قَبِلَ تلك الأحاديثَ الموضوعةَ جَمْعٌ من المشايخ الجامعين بين علوم الحقيقة والطريقة وأدرجوها في تصانيفهم السلوكية؟ فقلت: لحسن ظنهم بكل مسلم وتخيُّلهم أنه لا يكذب على النبي ﷺ مسلم..
‘‘আমার এক সম্মানিত ভাই আমার কথার প্রতিবাদ করে বললেন, ‘আশূরার দিনের ও রাতের সালাত ও বৎসরের অন্যান্য দিবস ও রাতের সালাতের কথা অনেক সূফী মাশাইখ তাদের মহামূল্যবান পুস্তকগুলিতে উল্লেখ করেছেন। তাঁরা এ বিষয়ে বর্ণিত অনেক হাদীসও উল্লেখ করেছেন। তাহলে কিভাবে আপনি বলছেন যে, এ সকল দিবস ও রাতের বিষয়ে বর্ণিত হাদীসগুলির উপর আমল করা যাবে না; বরং এগুলিকে জাল বলে গণ্য করতে হবে?’ আমি বললাম: ‘এ সকল মহাসম্মানিত সূফী মাশাইখদের উল্লেখের উপর নির্ভর করা যাবে না; কারণ তাঁরা মুহাদ্দিস ছিলেন না; আর তাঁরা এ সকল হাদীসের জন্য কোনো হাদীস-সংকলকের গ্রন্থের বরাতও দেন নি।’ তিনি আমাকে বললেন: ‘আপনি কী বলছেন? কী বিষয়ে আপনি পদচারণা করছেন তা ভেবে দেখুন!! যদি এ সকল মহান ব্যক্তিত্বের উদ্ধৃতির উপর নির্ভর করা না যায় তবে কার কথার উপর নির্ভর করতে হবে?
আমি বললাম: ‘অবাক হওয়ার কিছুই নেই। কারণ মহান আল্লাহ প্রত্যেক স্থানের জন্য পৃথক বক্তব্য রেখেছেন এবং প্রত্যেক বিষয়ের জন্য পৃথক বিশেষজ্ঞ তৈরি করেছেন।’ .... তিনি তাঁর বক্তব্যে এগিয়ে গেলেন: ‘বড়ই অবাক কথা! খুবই বিস্ময়ের বিষয়!! ইমাম গাযালী (৫০৫হি)..., মাওলানা আব্দুল কাদির জীলানী (৫৬১ হি).., আবূ তালিব মক্কী (৩৬৮হি)... এবং তাঁদের মত অন্যান্য পূর্ববর্তী ও পরবর্তী মহান মর্যাদাময় মাশাইখ, যারা ছিলেন বড় বড় সূফী, আল্লাহর ওলীগণের অন্তর্ভুক্ত, গোপন জ্ঞানের বাহক, তাঁরা রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে জাল হাদীস বানাবেন!!! অথচ এ কথা তো সর্বজন বিদিত যে, এ ধরনের মহান মুসলিম তো দূরের কথা একজন সাধারণ মুসলিমের জন্যও রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে জাল হাদীস বানানো বৈধ নয়।’
আমি বললাম: ‘কখনোই নয়! কখনোই নয়!! এ সকল মহান ব্যক্তিত্ব কখনোই কোনো হাদীস জাল করেন নি।....’ তখন তিনি বললেন, ‘যদি এ সকল হাদীসের জালিয়াতির দায়ভার তাঁদের না হয় তাহলে এর জন্য দায়ী কারা?’ আমি বললাম: ‘এক শ্রেণীর জাহিল দীনদার সংসারত্যাগী, অথবা কতিপয় যিনদীক ও মুলহিদ- ধর্মদ্রোহী; কারণ যে সকল রাবীর হাদীসের মধ্যে জাল হাদীস পাওয়া যায় ইবনুল জাওযী, সুয়ূতী, .... প্রমুখ মুহাদ্দিস তাদের শ্রেণীভাগ করে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন... এ সকল রাবীই এ সকল হাদীস জাল করার জন্য দায়ী। ....’ তিনি বললেন: ‘অনেক বড় বড় সূফী মাশাইখ, যারা ইলমে হাকীকত ও ইলমে তরীকত উভয় দিকেই পারদর্শী ছিলেন তাঁরা কিভাবে এ সকল জালিয়াত রাবীর বর্ণিত জাল হাদীসগুলি গ্রহণ করলেন এবং তরীকা-তাসাউফ বিষয়ক তাঁদের গ্রন্থগুলিতে সেগুলি উল্লেখ করলেন?’ আমি বললাম: ‘কারণ তাঁরা সকল মুসলিমের বিষয়েই ভাল ধারণা পোষণ করতেন এবং ধারণা করতেন যে, কোনো মুসলিম কখনোই রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে মিথ্যা কথা বলতে পারে না।’.....’’[4]
[2] আবু হামিদ গাযালী, এহইয়াউ উলূমিদ্দীন ২/২৯২-৩৩২।
[3] আব্দুল হাই লাখনবী, যাফরুল আমানী, পৃ: ৪১২-৪৩৩, ২২৪, আল-আজইবাতুল ফাযিলা, পৃ: ২৯-৩৫, আল-আসারুল মারফূয়া ফীল আখবারিল মাউযূয়া, পৃ: ৭-২০।
[4] আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসারুল মারফূআ, ৮-১৮ পৃষ্ঠা।