হাদীস জালিয়াতির ক্ষেত্রে মিথ্যাচারীদের একটি বিশেষ পদ্ধতি হলো ‘চুরি’ (سرقة)। ‘হাদীস চুরি’ অর্থ হলো, কোনো মিথ্যাচারী রাবী অন্য একজন ‘রাবী’র কোনো হাদীস শুনে সে হাদীস উক্ত রাবীর সূত্রে বর্ণনা না করে বানোয়াট সনদে তা বর্ণনা করবে। চুরি কয়েক প্রকারে হতে পারে:
ক. ‘চোর’ জালিয়াত মূল সনদ ঠিক রাখবে। তবে যার কাছ থেকে হাদীসটি শুনেছে তার নাম না বলে তার উস্তাদের নাম বলবে এবং নিজেই সে উস্তাদের কাছ থেকে শুনেছে বলে দাবী করবে।
খ. চোর জালিয়াত মূল সনদের মধ্যে কিছু পরিবর্তন করবে। সনদের মধ্যে একজন রাবীর নাম পরিবর্তন করে সে নতুন সনদ বানাবে।
গ. চোর জালিয়াত হাদীসটির মতন-এর জন্য নতুন সনদ বানাবে। একজন দুর্বল বা মিথ্যাচারী রাবীর বর্ণিত কোনো হাদীস তার মুখে বা কোনো স্থানে শুনে তার ভাল লাগে। হাদীসটির ‘আকর্ষণীয়তার’ কারণে তারও ইচ্ছা হয় হাদীসটি বলার। তবে হাদীসটি মূল জালিয়াতের নামে বললে তার ‘সম্মান’ কমে যায়। এছাড়া এতে আকর্ষণীয়তা ও নতুনত্ব থাকে না। এজন্য সে এ ‘জাল’ হাদীসটির জন্য আরেকটি ‘জাল’ সনদ তৈরি করবে।
জাল হাদীস চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে চুরির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন দুর্বল বা জাল হাদীস অনেক সময় ১০/১৫ টি সনদে বর্ণিত থাকে। এতগুলো সনদ দেখে অনেক সময় মুহাদ্দিস ধোঁকা খেতে পারেন। তিনি ভাবতে পারেন, হাদীসের সনদগুলো দুর্বল হলেও যেহেতু এতগুলো সনদ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে সেহেতু হয়ত এর কোনো ভিত্তি আছে। এক্ষেত্রে তাকে দুইটি বিষয় নিশ্চিত হতে হবে। প্রথমত: তাকে দেখতে হবে যে, প্রত্যেক সনদেই মিথ্যাবাদী রাবী আছে কিনা। দ্বিতীয়ত: নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখতে হবে যে, এখানে চুরি আছে কিনা। যদি দেখা যায় যে, হাদীসটি নির্দিষ্ট কোনো যুগে নির্দিষ্ট কোনো রাবীর বর্ণনায় প্রসিদ্ধি লাভ করে। সে যুগের মুহাদ্দিসগণ হাদীসটিকে সে রাবীর হাদীস বলে চিহ্নিত করেছেন। এরপর কোনো কোনো দুর্বল বা জালিয়াত রাবী তা উক্ত রাবীর উস্তাদ থেকে বা অন্য কোনো সনদে বর্ণনা করছেন। এক্ষেত্রে বুঝা যাবে যে, পরের রাবীগণ ‘চুরি’ করেছেন। এখানে চুরির কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করছি।
আমরা ইতোপূর্বে নেককারদের অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার উদাহরণ হিসাবে তৃতীয় হিজরী শতকের মাশহুর আবিদ সাবিত ইবনু মূসা (২২৯ হি) বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ করেছি, যে হাদীসে বলা হয়েছে: ‘যার রাতের সালাত (তাহাজ্জুদ) অধিক হবে দিবসে তার চেহারা সৌন্দর্যময় হবে।’ এ হাদীসটি সর্বপ্রথম সাবিতই বলেন। মুহাদ্দিসগণ সাবিতের মুখে হাদীসটি শোনার পরে বিস্তারিত নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হন যে, সাবিত ছাড়া কেউ হাদীসটি ইতোপূর্বে বলেন নি। কিন্তু এ হাদীসটি সাবিতের মাধ্যমে পরিচিতি ও প্রসিদ্ধি লাভ করার পরে কোনো কোনো দুর্বল ও মিথ্যাচারী রাবী এই হাদীসটি সাবিতের উস্তাদ শারীক থেকে বা অন্যান্য সনদে বর্ণনা করেছেন। মুহাদ্দিসগণ এগুলোকে চুরি বলে চিহ্নিত করেছেন। এ সকল চোর জালিয়াতের একজন আব্দুল হামীদ ইবনু বাহর আবুল হাসান আসকারী, তিনি সাবিতের পরের যুগে দাবী করেন যে, তিনিও হাদীসটি শারীক থেকে শুনেছেন। ৪র্থ হিজরীর প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনু আদী বলেন, আমাকে হাসান ইবনু সুফিয়ান বলেন, আমাকে আব্দুল হামীদ ইবনু বাহর বলেছেন, আমাদেরকে শারীক বলেছেন, আ’মাশ থেকে, আবু সুফিয়ান থেকে জাবির থেকে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তি রাত্রে সালাত (তাহাজ্জুদ) আদায় করে তবে দিনে তার চেহারা সৌন্দর্যময় হবে।’ ইবনু আদী বলেন, হাদীসটি সাবিত ইবনু মুসা থেকে প্রসিদ্ধ। তার থেকে পরবর্তীতে অনেক দুর্বল রাবী হাদীসটি চুরি করেছে। আব্দুল হামীদ তাদের একজন।[1]
চতুর্থ হিজরী শতকের একজন জালিয়াত রাবী হাসান ইবনু আলী ইবনু সালিহ আল-আদাবী। আল্লামা ইবনু আদী বলেন: আমি লোকটির কাছ থেকে হাদীস শুনেছি ও লিখেছি। লোকটি হাদীস জাল করত এবং চুরি করত। একজনের হাদীস আরেকজনের নামে বর্ণনা করতো। এমন সব লোকের নাম বলে হাদীস বলতো যাদের কোনো পরিচয় জানা যায় না।
এরপর তিনি এ হাসান ইবনু আলীর হাদীস চুরির অনেক উদাহরণ উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে ইবনু আদী বলেন: আমাকে হাসান ইবনু আলী আদাবী বলেন, আমাদেরকে হাসান ইবনু আলী ইবনু রাশিদ বলেছেন, তিনি শারীক থেকে, তিনি আ’মাশ থেকে, তিনি আবু সুফিয়ান থেকে, তিনি জাবির থেকে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: ‘যার রাতের সালাত অধিক হবে দিবসে তার চেহারা সৌন্দর্যময় হবে।’ ইবনু আদী বলেন: হাদীসটি সাবিত ইবনু মুসার হাদীস। সাবিতের পরে অনেক দুর্বল রাবী হাদীসটি চুরি করে বিভিন্ন রাবীর নাম দিয়ে চালিয়েছে। এ সনদে হাসান ইবনু আলী আল-আদাবী হাদীসটিকে হাসান ইবনু আলী ইবনু রাশিদের নামে চালাচ্ছে। অথচ হাসান ইবনু আলী ইবনু রাশিদ প্রসিদ্ধ ও সত্যপরায়ণ রাবী ছিলেন, তিনি কখনোই এ হাদীসটি শারীক থেকে বা অন্য কোনো সনদে বর্ণনা করেন নি। তাঁর পরিচিত কোনো ছাত্র হাদীসটি তাঁর থেকে বর্ণনা করেন নি।[2]
২য় শতকের একজন দুর্বল রাবী ‘হুযাইল ইবনুল হাকাম’। তিনি বলেন, আমাকে আব্দুল আযীয ইবনু আবী রাওয়াদ (১৫৯ হি) বলেছেন, তিনি ইকরিমাহ থেকে, তিনি ইবনু আববাস থেকে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
مَوْتُ الْغَرِيْبِ (مَوْتُ غُرْبَةٍ) شَهَادَةٌ
‘‘প্রবাসের মৃত্যু শাহাদত বলে গণ্য।’’[3]
হাদীসটির একমাত্র বর্ণনাকারী হুযাইল নামক এ রাবী। দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতকের মুহাদ্দিসগণ বিস্তারিত সন্ধান ও নিরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পেরেছেন যে, এ হাদীসটি একমাত্র এ ব্যক্তি ছাড়া কোনো রাবী আব্দুল আযীয থেকে বা অন্য কোনো সূত্রে বর্ণনা করেন নি।
এ যুগের অন্য একজন রাবী ইবরাহীম ইবনু বাকর আল-আ’ওয়ার। তিনি এসে দাবী করলেন যে, তিনি হাদীসটি আব্দুল আযীয থেকে শুনেছেন। তিনিও বললেন: আমাদেরকে আব্দুল আযীয বলেছেন, ইকরিমাহ থেকে, ইবনু আববাস থেকে...। মুহাদ্দিসগণ নিরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করলেন যে, ইবরাহীম নামক এ ব্যক্তি হাদীসটি চুরি করেছেন। তাঁরা দেখলেন যে, ইবরাহীম আব্দুল আযীয থেকে হাদীস শুনেন নি। যখন হুযাইল হাদীস বলতেন তখনও তিনি বলেন নি যে, তিনিও হাদীসটি শুনেছেন। হুযাইলের সূত্রে যখন হাদীসটি মুহাদ্দিসগণের মধ্যে প্রসিদ্ধি লাভ করে তখন তিনিও হাদীসটি হুযাইলের সূত্রে জানতে পারেন। এখন হুযাইলের সূত্রে হাদীসটি বললে তার ‘মর্যাদা’ কমে যাবে। এজন্য তিনি হুযাইলের সনদ চুরি করলেন। হুযাইলের উস্তাদকে নিজের উস্তাদ দাবী করে তিনি হাদীসটি বলতে শুরু করলেন।[4]
[2] ইবনু আদী, আল-কামিল ২/৩৩৮-৩৪১ আরো দেখুন ৬/৩০৩।
[3] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৫১৫; আবু ইয়ালা আল-মাউসিলী, আল-মুসনাদ ৪/২৬৯, আল-বুসীরী, মিসবাহুয যুজাজাহ ২/৫৪।
[4] ইবনু আদী, আল-কামিল ১/২৫৭।