ওয়াযের মধ্যে শ্রোতাদের দৃষ্টি-আকর্ষণ, মনোরঞ্জন, তাদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার ও নিজের সুনাম, সুখ্যাতি ও নগদ উপার্জন বৃদ্ধির জন্য অনেক মানুষ ওয়াযের মধ্যে বানোয়াট কথা হাদীস নামে বলেছেন। মিথ্যা ও জাল হাদীসের প্রসারে এসকল ওয়ায়েয ও গল্পকারদের ভূমিকা ছিল খুব বড়। হাদীসের নামে মিথ্যা কথা বানিয়ে বলতে এদের দুঃসাহস ও প্রত্যুৎপন্নমতিতা ছিল খুবই বেশি। তাদের অনেকেই শ্রোতাদের অবাক করে পকেট খালি করার জন্য শ্রোতাদের চাহিদা মত মিথ্যা বানিয়ে নিতেন দ্রুত। এছাড়া কোনো জালিয়াতের জাল হাদীস বা গল্প কাহিনী আকর্ষণীয় হলে অন্যান্য ওয়ায়িয জালিয়াতরা তা চুরি করত এবং নিজের নামে সনদ বানিয়ে প্রচার করত।[1]

এদের বুদ্ধি ও দুঃসাহসের নমুনা দেখুন। তৃতীয় হিজরী শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন (২৩৩ হি) ও ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (২৪১ হি)। তৃতীয় হিজরী শতকের প্রথমার্ধে বাগদাদে ও পুরো মুসলিম বিশ্বে তাঁদের পরিচিতি। তাঁরা দুজন একদিন বাগদাদের এক মসজিদে সালাত আদায় করেন। সালাতের পরে একজন ওয়ায়িয ওয়ায করতে শুরু করেন। ওয়াযের মধ্যে তিনি বলেন: আমাকে আহমাদ ইবনু হাম্বাল ও ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন দুজনেই বলেছেন, তাঁদেরকে আব্দুর রাযযাক, তাঁকে মা’মার, তাকে কাতাদাহ, তাকে আনাস বলেছেন, রাসূলুল্লাহ বলেছেন, যদি কেউ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলে তবে এর প্রত্যেক অক্ষর থেকে একটি পাখি তৈরি করা হয়, যার ঠোঁট স্বর্ণের, পালকগুলো মহামূল্য পাথরের....। এভাবে সে তার আজগুবি গল্প ও অগণিত সাওয়াবের কাল্পনিক কাহিনী বর্ণনা করে। ওয়ায শেষে উপস্থিত শ্রোতাদের অনেকেই তাকে কিছু কিছু ‘হাদিয়া’ প্রদান করেন।

ওয়ায চলাকালীন সময়ে আহমাদ ও ইয়াহইয়া অবাক হয়ে একজন আরেকজনকে প্রশ্ন করেন, এ হাদীস কি আপনি সে ব্যক্তিকে বলেছেন? উভয়েই বলেন, জীবনে আজই প্রথম এ ‘হাদীস’টি শুনছি। ওয়ায শেষে মানুষের ভীড় কমে গেলে ইয়াহইয়া লোকটিকে কাছে আসতে ইঙ্গিত করেন। লোকটি কিছু হাদীয়া পাবে ভেবে তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসে। ইয়াহইয়া তাকে জিজ্ঞাসা করেন, এ হাদীসটি তোমাকে কে বলেছেন? সে বলে: ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন ও আহমাদ ইবনু হাম্বাল। তিনি বলেন: আমি তো ইয়াহইয়া এবং ইনি আহমাদ। আমরা দুজনের কেউই এ হাদীস জীবনে শুনিনি, কাউকে শেখানো তো দূরের কথা। মিথ্যা যদি বলতেই হয় অন্য কারো নামে বল, আমাদের নামে বলবে না। তখন লোকটি বলে, আমি সবসময় শুনতাম যে, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন একজন আহাম্মক এখন সে কথার প্রমাণ পেলাম। ইয়াহইয়া বলেন, কিভাবে? সে বলে, আপনারা কি মনে করেন যে, দুনিয়াতে আপনারা ছাড়া আর কোনো ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন ও আহমাদ ইবনু হাম্বাল নেই? আমি আপনার সাথী আহমাদ ছাড়া ১৬ জন আহমাদ ইবনু হাম্বালের কাছ থেকে হাদীস শিক্ষা করেছি। একথা শুনে আহমাদ ইবনু হাম্বাল মুখে কাপড় দিয়ে বলেন, লোকটিকে যেতে দিন। তখন লোকটি দুজনের দিকে উপহাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেল।[2]

৪র্থ হিজরী শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস আবু হাতিম মুহাম্মাদ ইবনু হিববান আল-বুসতী (৩৫৪ হি) বলেন: আমি আমার হাদীস সংগ্রহের সফর কালে সিরিয়ার ‘তাজরোয়ান’ নামক শহরে প্রবেশ করি। শহরের জামে মসজিদে সালাত আদায়ের পরে এক যুবক দাঁড়িয়ে ওয়ায শুরু করে। ওয়াযের মধ্যে সে বলে: আমাকে আবু খালীফা বলেছেন, তাঁকে ওয়ালীদ বলেছেন, তাঁকে শু’বা বলেছেন, তাঁকে কাতাদা বলেছেন, তাঁকে আনাস (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন, যদি কেউ কোনো মুসলিমের প্রয়োজন পূরণ করে তাহলে আল্লাহ তাকে এত এত পুরস্কার প্রদান করবেন... এভাবে সে অনেক কথা বলে। তার কথা শেষ হলে আমি তাকে ডেকে বললাম, তোমার বাড়ি কোথায়? সে বলে: আমি বারদায়া এলাকার মানুষ। আমি বললাম, তুমি কি কখনো বসরায় গিয়েছ? সে বলল: না। আমি বললাম: তুমি কি আবু খালীফাকে দেখেছ? সে বলল: না। আমি বললাম: তাহলে কিভাবে তুমি আবু খালীফা থেকে হাদীস বর্ণনা করছ, অথচ তুমি তাকে কোনোদিন দেখনি? যুবকটি বলল: এ বিষয়ে প্রশ্ন করা ভদ্রতা ও আদবের খেলাফ। এ একটি মাত্র সনদই আমার মুখস্থ আছে। আমি যখনই কোনো হাদীস বা কথা কারো মুখে শুনি, আমি তখন সে কথার আগে এ সনদটি বসিয়ে দিয়ে কথাটি বর্ণনা করি। ইবনু হিববান বলেন, তখন আমি যুবকটিকে রেখে চলে আসলাম।[3]

৬ষ্ঠ হিজরী শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আবুল ফারাজ ইবনুল জাওযী (৫৯৭ হি) বলেন, আমাদের এলাকায় একজন ওয়ায়িয আছেন। তিনি বাহ্যত পরহেযগার ও আল্লাহভীরু মানুষ। কাজে কর্মে দরবেশী ও তাকওয়া প্রকাশ করেন। তার বিষয়ে আমাকে আমার দুজন অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য আলিম বন্ধু বলেছেন, এক আশুরার দিনে ঐ লোকটি বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেছেন, যে আশুরার দিনে এ কাজ করবে তার এই পুরস্কার, যে এ কাজ করবে তার এ পুরস্কার... এভাবে অনেক কাজের অনেক প্রকার পুরস্কার বিষয়ক অনেক হাদীস তিনি বলেন। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, এই হাদীসগুলো আপনি কোথা থেকে মুখস্থ করলেন? তিনি বলেন: আল্লাহর কসম, আমি কখনোই হাদীসগুলো শিখিনি বা মুখস্থ করিনি। এ মুহূর্তেই এগুলো আমার মনে এল এবং আমি বললাম।[4]

ইবনুল জাওযী বলেন, আমার সমকালীন একজন ওয়ায়িয এসব মিথ্যা হাদীস দিয়ে একটি বইও লিখেছে। সে বইয়ের একটি জাল হাদীস নিম্নরূপ:

একদিন হাসান (রা) ও হুসাইন (রা) খলীফা উমার (রা) এর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেন। উমার (রা) ব্যস্ত ছিলেন। হাতের কাজ শেষ করে মাথা উঠিয়ে তিনি তাঁদের দুজনকে দেখতে পান। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে তাঁদেরকে চুমু খান, প্রত্যেককে ১০০০ মুদ্রা প্রদান করেন এবং বলেন, আমাকে ক্ষমা করুন, আমি আপনাদের আগমন বুঝতে পারিনি। তাঁরা দুজন ফিরে যেয়ে তাঁদের পিতা আলী (রা)-এর কাছে উমারের আদব ও বিনয়ের কথা উল্লেখ করেন। তখন আলী (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ()-কে বলতে শুনেছি, উমার ইবনুল খাত্তাব ইসলামের নূর ও জান্নাতবাসীদের প্রদীপ। তাঁরা দুজন উমারের কাছে ফিরে যেয়ে তাঁকে এ হাদীস শোনান। তখন তিনি কাগজ ও কালি চেয়ে নিয়ে লিখেন: বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম, জান্নাতের যুবকদের দুই নেতা আমাকে বলেছেন, তাঁরা তাঁদের পিতা আলী মুরতাযা থেকে, তাঁদের নানা নবী মুসতাফা () থেকে, তিনি বলেছেন, উমার ইসলামের নূর ও জান্নাতবাসীদের প্রদীপ। উমার ওসীয়ত করেন যে, তাঁর মৃত্যুর পরে যেন তাঁর কাফনের মধ্যে বুকের উপরে এ কাগজটি রাখা হয়। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর ওসীয়ত মত কাজ করা হয়। পরদিন সকালে সকলে দেখতে পান যে, কাগজটি কবরের উপরে রয়েছে এবং তাতে লিখা রয়েছে: হাসান ও হুসাইন সত্য বলেছেন, তাঁদের পিতা সত্য বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সত্য বলেছেন, উমার ইসলামের নূর ও জান্নাতবাসীদের প্রদীপ।

ইবনুল জাওযী বলেন, সবচেয়ে দুঃখ ও আফসোসের বিষয় হলো, এ জঘন্য বানোয়াট মিথ্যা ও আজগুবি কথা লিখেই সে সন্তুষ্ট থাকে নি। আমাদের যুগের অনেক আলিমকে তা দেখিয়েছে। হাদীসের সনদ ও বিশুদ্ধতা বিষয়ক জ্ঞানের অভাব আলিমদের মধ্যেও এত প্রকট যে, অনেক আলিম এ জঘন্য মিথ্যাকেও সঠিক বলে উল্লেখ করেছেন।[5]

[1] ফাল্লাতা, আল-ওয়াদউ ১/২৭২-২৭৯।

[2] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত ১/২১-২২।

[3] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত ১/২২।

[4] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত ১/২০।

[5] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত ১/২০-২১।