সাধারণত মানুষ নিজের ক্ষুদ্রত্ব ও সীমাবদ্ধতা অনুভব করতে চায় না। প্রাচীন যুগ থেকে আজ পর্যন্ত অগণিত মানুষ নিজের বুদ্ধি, বিবেক, বিচার ও প্রজ্ঞা দিয়ে ‘ওহী’-র দুর্বলতা (!) ও অপূর্ণতা (!!) দূর (!!!) করতে চেষ্টা করেছে ও করছে। সকলেরই চিন্তা ওহীর মধ্যে এ কথাটি কেন থাকল না! এ কথাটি না হলে ধর্মের পূর্ণতা আসছে না। ঠিক আছে আমি কথাটি ওহীর নামে বলি। তাহলে ধর্ম পূর্ণতা লাভ করবে!!!
এদের মধ্যে অনেকে নিজে কোনো মনগড়া ধর্মীয় মতবাদ তৈরী করেছে বা অনুসরণ করেছে এবং এ মতের পক্ষে ‘ওহী’ জালিয়াতি করেছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ইন্তেকালের পরে অর্ধ শতাব্দী অতিক্রান্ত হতে না হতেই মুসলিম সমাজে নও-মুসলিমদের মধ্যে পূর্ববর্তী ধর্মের প্রভাব, ইসলামের গোপন শত্রুদের অপপ্রচার ও বিভিন্ন সমাজের সাহিত্য, দর্শন ইত্যাদির প্রভাবে নতুন নতুন ধর্মীয় মতবাদের উদ্ভাবন ঘটে। আলী (রা) ও সকল সাহাবীর বিরুদ্ধে জিহাদ ও মনগড়া ইসলাম প্রতিষ্ঠার উন্মাদনা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় খারিজী মতবাদ। আলী (রা) এর ভক্তি ও ভালবাসার ছদ্মাবরণে মুসলমানদের মধ্যে ইহুদী, খৃস্টান ও অগ্নিপূজকদের মতবাদ ছড়ানোর জন্য প্রচারিত হয় শিয়া মতবাদ। মহান আল্লাহর মর্যাদা রক্ষার ভুয়া দাবীতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘কাদারিয়া’ মতবাদ, যাতে তাকদীর বা মানুষের ভাগ্যের বিষয়ে মহান আল্লাহর জ্ঞানকে অস্বীকার করা হতো। মহান আল্লাহর ক্ষমতা প্রমাণের বাড়াবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জাবারিয়া’ মতবাদ, যাতে মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতাকে অস্বীকার করা হতো। মহান আল্লাহর একত্ব প্রতিষ্ঠার মনগড়া দাবিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জাহ্মিয়া’, ‘মুতাজিলা’ ইত্যাদি মতবাদ, যেখানে মহান আল্লাহর গুণাবলি অস্বীকার করা হতো।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীগণ কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা হুবহু আক্ষরিকভাবে বিশ্বাস ও পালন করেছেন। সাহাবীগণকে ভালবাসতে হবে আবার রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বংশধরদেরকেও ভালবাসতে হবে। উভয়ের মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই, নেই কোনো বাড়াবাড়ির অবকাশ। মানুষের ভাগ্যের বিষয়ে আল্লাহর জ্ঞান ও নির্ধারণ যেমন সত্য, তেমনি সত্য মানুষের কর্মক্ষমতা ও ইচ্ছাশক্তি। উভয় বিষয়ের সকল আয়াত ও হাদীস সহজভাবে বিশ্বাস করেছেন তাঁরা। এগুলোর মধ্যে কোনো বৈপরীত্য তাঁরা দেখেন নি।
কিন্তু নতুন মতের উদ্ভাবকগণ কুরআন-হাদীসের কিছু নির্দেশনা মানতে যেয়ে বাকীগুলো অস্বীকার বা ব্যাখ্যা করেছেন। প্রত্যেকে নিজের মতকেই সঠিক বলে মনে করেছেন এবং দাবি করেছেন যে, তার মতই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) পক্ষে এবং এ মতের পক্ষে হাদীস বানানোর অর্থ হলো আল্লাহ ও তার রাসূলের (ﷺ) পক্ষে হাদীস বানানো। কিছু বানোয়াট বা মিথ্যা কথাকে ওহীর নামে বা হাদীসের নামে বলে যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের (ﷺ) ‘সঠিক পছন্দের (!!) মতকে’ শক্তিশালী করা যায় তাহলে অসুবিধা কি?! এ তো ভাল কাজ বলে গণ্য হওয়া উচিত। এজন্য তাদের কেউ কেউ যখন তাদের মতের পক্ষে সুস্পষ্ট কোনো হাদীস পান নি তখন প্রয়োজনে নিজেদের পক্ষে ও বিরোধীদের বিপক্ষে হাদীস বানিয়ে প্রচার করেছেন। ফিকহী ও মাসআলাগত মতভেদের ক্ষেত্রেও কখনো কখনো মিথ্যা হাদীস তৈরী করা হয়েছে।[1]
এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অগ্রগামী ছিলেন শিয়াগণ। নবী-বংশের ভক্তির নামে তাঁরা অগণিত বানোয়াট কথা ধর্মবিশ্বাসের অংশ বানিয়েছিলেন। এরপর সেগুলোর সমর্থনে অগণিত হাদীস বানিয়ে প্রচার করেছেন। নবীদের পরে সকল মানুষের মধ্যে আলীর শ্রেষ্ঠত্ব, আলীর অগণিত অলৌকিক ক্ষমতা, আলীর পুনরায় দুনিয়ায় ফিরে আসা, আলী বংশের মাহাত্ম্য, তাঁকে ও তাঁর বংশধরদেরকে বাদ দিয়ে যারা খলীফা হয়েছেন তাঁদের যুলুম ও শাস্তি, যারা তাঁর বিরোধিতা করেছেন তাঁদের ভয়ঙ্কর পরিণতি ও শাস্তি, যারা তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মানেন নি বা অন্যান্য সাহাবীদেরকে ভালবেসেছেন তাদের ভয়ঙ্কর শাস্তি ইত্যাদি বিষয়ে অগণিত বানোয়াট কথাকে তারা হাদীস নামে প্রচার করেছেন।
তাঁদের জালিয়াতি এতই ব্যাপক ছিল যে, তাদের আলিমগণও সেকথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। ৭ম হিজরী শতকের প্রখ্যাত শীয়া আলিম, আলী (রা)-এর বক্তৃতা সংকলন বলে কথিত ও প্রচারিত ‘নাহজুল বালাগাত’ নামক গ্রন্থের ব্যাখ্যাকার ইবনু আবীল হাদীদ আব্দুল হামীদ ইবনু হিবাতুল্লাহ (৬৫৬ হি) বলেন: ‘‘ফযীলত বা মর্যাদা জ্ঞাপক হাদীসের ক্ষেত্রে প্রথম মিথ্যাচারের শুরু হয়েছিল শিয়াদের দ্বারা। তারা প্রথমে তাদের নেতার পক্ষে বিভিন্ন হাদীস জালিয়াতি করে প্রচার করেন। বিরোধীদের সাথে প্রচন্ড শত্রুতা ও হিংসা তাদেরকে এ কর্মে উদ্বুদ্ধ করে।...’’[2]
[2] মুহাম্মাদ আজ্জাজ আল-খতীব, আস-সুন্নাতু কাবলাত তাদবীন পৃ: ১৯৫।