মিথ্যার কারণ ও মিথ্যাবাদীদের প্রকারভেদ

আমরা দেখেছি যে, ইসলামের গোপন শত্রুরা মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য সর্বপ্রথম হাদীসের নামে মিথ্যা কথা মুসলিম সমাজে ছড়াতে থাকে। ওহীর উপরেই ধর্মের ভিত্তি। ওহীর মাধ্যমে কোনো কথা প্রমাণিত করতে পারলেই তা মুসলিম সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পায়। কুরআন অগণিত মানুষের মুখস্থ, কুরআনের নামে সরাসরি মিথ্যা বা বানোয়াট কিছু বলার সুযোগ কখনোই ছিল না। এজন্য হাদীসের নামে মিথ্যা বলার চেষ্টা তারা করেছে।

ক্রমান্বয়ে আরো অনেক মানুষ বিভিন্ন প্রকারের উদ্দেশ্যে হাদীসের নামে মিথ্যা বলতে থাকে। এছাড়া অনেক মানুষ অজ্ঞতা, অবহেলা বা অসাবধানতা বশত হাদীসের নামে মিথ্যা বলেন। কারো মুখে কোনো ভাল কথা, কোনো প্রাচীন প্রজ্ঞাময় বাক্য, কোনো সাহাবী বা তাবিয়ীর কথা শুনে কারো কাছে ভাল লেগেছে। পরবর্তীতে তা বলার সময় রাসূলুল্লাহ ()-এর কথা বলে বর্ণনা করেছেন। এভাবে বিভিন্ন কারণে হাদীসের নামে জালিয়াতি চলতে থাকে।

আমরা দেখেছি যে, মিথ্যা দু প্রকার: ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত। অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার কারণ মূলত স্মৃতির বিভ্রাট, হাদীস মুখস্থকরণে অবহেলা বা হাদীস গ্রহণে অসতর্কতা। আর ইচ্ছাকৃত মিথ্যার কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্মের ক্ষতি বা উপকার (!) করা।

আমরা জানি যে, ওহীর সম্পর্ক ধর্মের সাথে। কাজেই ওহীর নামে মিথ্যা বলার সকল উদ্দেশ্যই ধর্ম কেন্দ্রিক। কেউ ধর্মের নামে ধর্মের ক্ষতি করার জন্য হাদীস বানিয়েছেন। কেউ ধর্মের নামে কামাই রুজি করার জন্য বা নিজের ফাতওয়া, দল বা বংশকে শক্তিশালী করার জন্য হাদীস বানিয়েছেন। কেউ ধর্মের নামে নিজের মতামতকে প্রতিষ্ঠিত করতে হাদীস বানিয়েছেন। কেউ নিঃস্বার্থভাবে (!) মানুষদের ভালকাজে উৎসাহ দান ও খারাপ কাজ থেকে নিরুৎসাহিত করার জন্য হাদীস বানিয়েছেন। এ সকল কারণ আমরা তিন শ্রেণিতে ভাগ করতে পারি: ১. ধর্মের ক্ষতি করা, ২. ধর্মের উপকার করা ও ৩. নিজের জাগতিক উদ্দেশ্য হাসিল করা।

মিথ্যার কারণ ও মিথ্যাবাদীদের প্রকরণ সম্পর্কে ৭ম হিজরী শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনুস সালাহ আবু আমর উসমান ইবনু আব্দুর রাহমান (৬৪৩হি) বলেন: হাদীস বানোয়াটকারী জালিয়াতগণ বিভিন্ন প্রকারের। এদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকারক একদল মানুষ যারা নেককার ও দরবেশ বলে সমাজে পরিচিত। এরা এদের অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তির কারণে সাওয়াবের আশায় বানোয়াট কথা হাদীসের নামে সমাজে প্রচার করতেন। এদের বাহ্যিক পরহেযগারী, নির্লোভ জীবনযাপন ইত্যাদি দেখে মানুষ সরল মনে এদের কথা বিশ্বাস করে এসকল বানোয়াট কথা হাদীস বলে গ্রহণ করতো। এরপর হাদীসের অভিজ্ঞ ইমামগণ সুক্ষ্ম নিরীক্ষার মাধ্যমে এদের মিথ্যাচার ও জালিয়াতি ধরে ফেলেন এবং প্রকাশ করে দেন।... সাওয়াবের উদ্দেশ্যে নেককাজের ফযীলত ও অন্যায় কাজের শাস্তি বিষয়ক মিথ্যা ও বানোয়াট কথাকে হাদীস নামে প্রচার করাকে এধরনের কেউ কেউ জায়েয মনে করত।[1]

আল্লামা যাইনুদ্দীন ইরাকী (৮০৬হি) বলেন: হাদীস জালকারীগণ তাদের জালিয়াতির উদ্দেশ্য ও কারণের দিক থেকে বিভিন্ন প্রকারের :

১. অনেক যিনদীক মানুষদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য হাদীস বানিয়েছে। হাম্মাদ ইবনু যাইদ বলেছেন: যিনদীকগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে দশ হাজার হাদীস তৈরি করেছে।

২. অনেকে নিজের ধর্মীয় মতের সমর্থনে হাদীস জাল করেছে।

৩. কিছু মানুষ খলীফা ও আমীরদের পছন্দসই বিষয়ে হাদীস জাল করে তাদের প্রিয়ভাজন হতে চেষ্টা করেছে।

৪. কিছু মানুষ ওয়ায ও গল্প বলে অর্থ কামাই করার মানসে হাদীস জাল করেছে।

৫. কিছু মানুষ নিজে ভাল ছিলেন, কিন্তু তাদের পুত্র বা পরিবারের কোনো সদস্য তাদের পান্ডুলিপির মধ্যে মিথ্যা হাদীস লিখে রাখতো। তারা বেখেয়ালে তা বর্ণনা করতেন।

৬. কেউ কেউ নিজেদের ফাতওয়া বা মাসআলার দলীল প্রতিষ্ঠার জন্য হাদীস বানাতেন।

৭. কেউ কেউ নতুনত্ব ও অভিনবত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন অপ্রচলিত সনদ ও মতন তৈরি করতেন।

৮. কিছু মানুষ এভাবে মিথ্যা হাদীস তৈরি করাকে দীনদারী মনে করতেন। তারা তাদের বিভ্রান্তির কারণে মনে করতেন যে, মানুষদের ভালর পথে ডাকার জন্য মিথ্যা বলা যায়। এরা নেককার, সংসারত্যাগী বুযুর্গ হিসাবে সমাজে পরিচিত। হাদীস জালিয়াতির ক্ষেত্রে তাদের দ্বারা ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি ও মারাত্মক। কারণ তারা এ কঠিন পাপকে নেককর্ম ও সাওয়াবের কাজ মনে করতেন; ফলে কোনোভাবেই তাদেরকে এথেকে বিরত করা যেত না। আর তাদের বাহ্যিক তাকওয়া, নির্লোভ জীবন ও দরবেশী দেখে মানুষেরা প্রভাবিত হতেন এবং তাদের মিথ্যাকে সত্য বলে গ্রহণ ও প্রচার করতেন। এজন্যই ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ কাত্তান (১৯৮ হি) বলতেন, হাদীসের বিষয়ে নেককার বুযুর্গদের চেয়ে বেশি মিথ্যাবাদী আমি দেখিনি।[2] তিনি নেককার বুযুর্গ বলতে বুঝাচ্ছেন সে সব জাহিলকে যারা নিজেদের নেককার মনে করেন এবং বুযুর্গীর পথে চলেন, কিন্তু হালাল হারাম বুঝেন না।[3]

আমরা এখানে হাদীসের নামে জালিয়াতির প্রধান কারণগুলো ও এতে লিপ্ত মানুষদের বিষয়ে কিছু বিস্তারিত আলোচনা করব।

[1] ইরাকী, আত-তাকঈদ, পৃ: ১২৮-১২৯; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/২৮১-২৮৪।

[2] মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৭-১৮।

[3] ইরাকী, ফাতহুল মুগীস, পৃ: ১২২-১২৪।