উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখি যে, দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দী থেকে মুহাদ্দিসগণ সনদসহ সকল হাদীস সংকলন করেন, যেন সনদ পর্যালোচনা করে বিশুদ্ধ হাদীসকে মিথ্যা বা ভুল থেকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করা যায়।
দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে মুহাদ্দিসগণ হাদীস সংকলনের পাশাপাশি রাবীগণের গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ক তথ্যাবলি গ্রন্থাকারে সংকলন করতে থাকেন; যেন এ সকল তথ্যের আলোকে হাদীসগ্রন্থগুলোতে সংকলিত হাদীসগুলোর সনদ বিচার করা যায়। এ জাতীয় গ্রন্থ প্রণয়নেও ক্রম বিবর্তন ঘটে।
২য় হিজরী শতকের মাঝামাঝি থেকে মুহাদ্দিসগণ প্রথমে নির্ভরযোগ্য ও অনির্ভরযোগ্য সকল বর্ণনাকারীর বিবরণ একত্রে সংকলন করতে শুরু করেন। ইমাম লাইস ইবনু সা’দ (১৭৫ হি), আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (১৮১ হি) প্রমুখ মুহাদ্দিস দ্বিতীয় হিজরীর মাঝামাঝি থেকে এই জাতীয় গ্রন্থ প্রণয়ন শুরু করেন। এসকল গ্রন্থে নির্ভরযোগ্য, অনির্ভরযোগ্য, মিথ্যাবাদী সকল রাবীর জীবনী, তাদের বর্ণিত কিছু হাদীস ও তাদের বর্ণিত হাদীসের নিরীক্ষার ভিত্তিতে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বা অগ্রহণযোগ্যতা বিষয়ক বিধান সংকলিত হয়েছে। পরবর্তী শতকগুলোতে এ প্রকারের গ্রন্থ রচনার ধারা অব্যাহত থাকে। তৃতীয় হিজরী শতকে আহমাদ ইবনু হাম্বাল, আলী ইবনুল মাদীনী, বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ,ও পরবর্তী যুগের অগণিত মুহাদ্দিস এ জাতীয় গ্রন্থ রচনা করেছেন।
দ্বিতীয় পর্যায়ে মুহাদ্দিসগণ শুধুমাত্র অনির্ভরযোগ্য ও মিথ্যাবাদী রাবীদের বিষয়ে পৃথক গ্রন্থ রচনা শুরু করেন। দ্বিতীয় শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ আল-কাত্তান (১৯৮ হি) সর্বপ্রথম ‘আদ-দুআফা’ নামে এ জাতীয় গ্রন্থ রচনা করেন। পরবর্তী শতকগুলোতে এ জাতীয় গ্রন্থ প্রণয়নের ধারা অব্যাহত থাকে। এ সকল গ্রন্থে দুর্বল ও মিথ্যাবাদী রাবীগণ, তাদের বর্ণিত কিছু হাদীস ও তাদের বিষয়ে ইমামদের মতামত সংকলন করা হয়েছে। এগুলোর পাশাপাশি তৃতীয় হিজরী শতক থেকে কোনো কোনো মুহাদ্দিস শুধুমাত্র নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত রাবীদের বিষয়ে পৃথক গ্রন্থ রচনা শুরু করেন।
বস্ত্তত, রাবীগণের বিবরণ সংগ্রহ ও সংকলন মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণের একটি অতুলনীয কর্ম। প্রথম হিজরী শতাব্দী থেকে পরবর্তী ৬০০ বছর যাবত মুহাদ্দিসগণ মুসলিম দেশের প্রতিটি জনপদে ঘুরে প্রত্যেক রাবীর নাম, জন্ম, মৃত্যু, শিক্ষা, কর্ম, শিক্ষক, ছাত্র ইত্যাদি ব্যক্তিগত সকল তথ্য সহ তাঁর বর্ণিত হাদীসের নিরীক্ষা ও নিরীক্ষার ভিত্তিতে তার সম্পর্কে তার সমসাময়িক ও পরবর্তী মুহাদ্দিসগণের মতামত ইত্যাদি বিস্তারিত সংরক্ষণ করেছেন। হাদীসে রাসূলকে বিকৃতি ও জালিয়াতি থেকে রক্ষার জন্য তাঁরা এভাবে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের তথ্য সংরক্ষণ করেছেন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এর কোনো নযির নেই। এ সকল তথ্যের ভিত্তিতে যে কোনো যুগে যে কোনো গবেষক যে কোনো হাদীসের সনদ বিচার করতে সক্ষম হন।