আমরা দেখেছি যে, তাবিয়ীগণের যুগ থেকে ‘রাবী’ ও মুহাদ্দিসগণ সাধারণভাবে প্রত্যেক শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা করা হাদীসগুলো পৃথকভাবে পান্ডুলিপি আকারে লিপিবদ্ধ করে সংরক্ষণ করতেন। তাঁরা পান্ডুলিপির সাথে মুখস্থ বর্ণনার তুলনা করে নির্ভুলতা যাচাই করতেন। প্রয়োজনে তাঁরা পান্ডুলিপির হস্তাক্ষর, কালি ইত্যাদি পরীক্ষা করতেন। এখানে বর্ণিত হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ে পান্ডুলিপির সাহায্য গ্রহণের কয়েকটি নযির উল্লেখ করছি।
(১) দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন মুহাদ্দিস খলীফা ইবনু মূসা বলেন, আমি গালিব ইবনু উবাইদুল্লাহ আল-জাযারী নামক একজন মুহাদ্দিসের কাছে হাদীস শিক্ষা করতে গমন করি। তিনি আমাদেরকে হাদীস লেখাতে শুরু করে তার পান্ডুলিপি দেখে বলতে থাকেন: আমাকে মাকহূল (১১৫ হি) বলেছেন..., আমাকে মাকহূল বলেছেন ...., এভাবে তিনি মাকহূলের সূত্রে হাদীস লেখাতে থাকেন। এমন সময় তাঁর পেশাবের বেগ হয় তিনি উঠে যান। তখন আমি তার পান্ডুলিপির মধ্যে নযর করে দেখি সেখানে লেখা রয়েছে: আমাকে আবান ইবনু আবী আইয়াশ (১৪০ হি) বলেছেন, আনাস থেকে, আবান বলেছেন, অমুক থেকে...। তখন আমি তাকে পরিত্যাগ করে সেখান থেকে উঠে আসলাম।[1]
অর্থাৎ, এ রাবী তার হাদীসগুলো আবানের কাছ থেকে শুনেছেন ও লিখেছেন। তবে আবান মুহাদ্দিসগণের কাছে দুর্বল বলে ও অনির্ভরযোগ্য বলে পরিচিত। এজন্য তিনি হাদীস পড়ার সময় তার নাম বাদ দিয়ে প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মাকহূলের নামে হাদীসগুলো বলছিলেন। খলীফা সুযোগ পেয়ে তার মুখের বর্ণনার সাথে লিখিত পান্ডুলিপির তুলনা করে তার জালিয়াতি ধরে ফেলেন।
(২) দ্বিতীয় শতকের নাকিদ ইমাম, আব্দুর রাহমান ইবনু মাহদী (১৯৮ হি) বলেন, একদিন সুফিয়ান সাওরী (১৬১ হি) একটি হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন: হাদীসটি আমাকে বলেছেন হাম্মাদ ইবনু আবী সুলাইমান (১২০ হি), তিনি আমর ইবনু আতিয়্যাহ আত-তাইমী (মৃত্যু ১০০ হিজরীর কাছাকাছি) নামক তাবিয়ী থেকে তিনি সালমান ফারিসী (৩৪ হি) থেকে।
আব্দুর রাহমান বলেন: আমি বললাম: হাম্মাদ ইবনু আবী সুলাইমান তো এ হাদীস রিবয়ী ইবনু হিরাশ (১০০ হি) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি সালমান ফারিসী থেকে। (অর্থাৎ, আপনার সনদ বর্ণনায় ভুল হয়েছে, হাম্মাদের উস্তাদ আমর ইবনু আতিয়াহ নয়, বরং রিবয়ী ইবনু হিরাশ।) সুফিয়ান সাওরী বলেন: এ সনদ কে বলেছেন? আমি বললাম: আমাকে হাম্মাদ ইবনু সালামাহ (১৬৭ হি) বলেছেন, তিনি হাম্মাদ ইবনু আবী সুলাইমান থেকে এ সনদ উল্লেখ করেছেন। সুফিয়ান বললেন: আমি যা বলছি তাই লিখ। আমি বললাম: শু’বা ইবনুল হাজ্জাজও (১৬০ হি) আমাকে এই সনদ বলেছেন। তিনি বললেন: আমি যা বলছি তাই লিখ। আমি বললাম: হিশাম দাসতুআয়ীও (১৫৪ হি) আমাকে এ সনদ বলেছেন। তিনি বললেন: হিশাম? আমি বললাম: হ্যাঁ। তিনি কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বললেন: আমি যা বলছি তাই লিখ। আমি হাম্মাদ ইবনু আবী সুলাইমানকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন: আমি আমর ইবনু আতিয়্যাহ থেকে হাদীসটি শুনেছেন।
আব্দুর রাহমান বলেন: আমার দৃঢ় বিশ্বাস হলো যে, এখানে সুফিয়ান সাওরী ভুল করলেন। অনেকদিন যাবত আমি এ ধারণা পোষণ করে থাকলাম যে, এ সনদ বলতে সাওরী ভুল করলেন। এরপর একদিন আমি আমার উস্তাদ মুহাম্মাদ ইবনু জা’ফার গুনদার (১৯৩ হি) এর মাধ্যমে শু’বা ইবনুল হাজ্জাজের যে হাদীসগুলো শুনেছিলাম সেগুলোর লিখিত পান্ডুলিপির মধ্যে দেখলাম যে, শু’বা বলেছেন, আমাকে হাম্মাদ ইবনু আবী সুলাইমান বলেছেন, তাকে রিবয়ী ইবনু হিরাশ বলেছেন, সালমান ফারিসী থেকে। শু’বা বলেন: হাম্মাদ একবার বলেন যে, তিনি আমর ইবনু আতিয়্যাহ থেকে হাদীসটি শুনেছেন।
আব্দুর রহমান বলেন: পান্ডুলিপি দেখার পরে আমি বুঝতে পারলাম যে, সুফিয়ান সাওরী ঠিকই বলেছিলেন। তাঁর নিজের মুখস্থের বিষয়ে তাঁর গভীর আস্থা থাকার কারণে অন্যান্যদের বিরোধিতাকে তিনি পাত্তা দেন নি।[2]
(৩) দ্বিতীয় শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফকীহ আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (১৮১ হি) বলেন, যদি মুহাদ্দিসগণ শু’বা ইবনুল হাজ্জাজ (১৬০) থেকে বর্ণিত হাদীসের সঠিক বর্ণনার বিষয়ে মতভেদ করেন তাহলে মুহাম্মাদ ইবনু জা’ফার গুনদার (১৯৩ হি) এর পান্ডুলিপিই তাদের মধ্যে চূড়ান্ত ফাইসালা করবে। গুনদার-এর পান্ডুলিপির বর্ণনাই সঠিক ও নির্ভুল বলে গৃহীত হবে।[3]
(৪) তৃতীয় শতকের তিনজন মুহাদ্দিস, মুহাম্মাদ ইবনু মুসলিম ইবনু উসমান আর-রাযী (২৭০ হি), ফাদল ইবনু আববাস ও আবু যুরু‘আ রাযী উবাইদুল্লাহ ইবনু আব্দুল কারীম (২৬৪ হি) একত্রে বসে হাদীস আলোচনা করছিলেন। মুহাম্মাদ ইবনু মুসলিম একটি হাদীস বলেন যাতে ফাদল আপত্তি উঠান। তিনি অন্য একটি বর্ণনা বলেন। দুজনের মধ্যে হাদীসটির বিষয়ে বচসা হয়। তাঁরা তখন আবু যুরআকে সালিস মানেন। আবু যুরআ মতামত প্রকাশ থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু মুহাম্মাদ ইবনু মুসলিম চাপাচাপি করতে থাকেন। তিনি বলেন: আপনার নীরবতার কোনো অর্থ নেই। আমার ভুল হলে তাও বলেন। আর তাঁর ভুল হলে তাও বলেন। আবু যুর‘আ তখন তার পান্ডুলিপি আনতে নির্দেশ দেন। তিনি ছাত্র আবুল কাসিমকে বলেন, তুমি গ্রন্থাগারে ঢুকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারি বাদ দেবে। এরপরের সারির বই গুণে প্রথম থেকে ১৬ খন্ড পান্ডুলিপি রেখে ১৭ তম খন্ডটি নিয়ে এস। তিনি পান্ডুলিপিটি নিয়ে এসে আবু যুরআকে প্রদান করলেন। আবু যুরআ পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকেন এবং একপর্যায়ে হাদীসটি বের করেন। এরপর তিনি পান্ডুলিপিটি মুহাম্মাদ ইবনু মুসলিমের হাতে দেন। মুহাম্মাদ পান্ডুলিপিতে সংকলিত হাদীসটি পড়ে বলেন: হ্যাঁ, তাহলে আমারই ভুল হয়েছে। আর ভুল তো হতেই পারে।’’[4]
(৫) তৃতীয় হিজরীর একজন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আব্দুর রাহমান ইবনু উমার আল-ইসপাহানী রুস্তাহ (২৫০ হি)। তিনি একদিন হাদীসের আলোচনাকালে আবু যুরআ রাযী (২৬৪ হি) ও আবু হাতিম রাযী মুহাম্মাদ ইবনু ইদরীস (২৭৭ হি) উভয়ের উপস্থিতিতে একটি হাদীস বর্ণনা করে বলেন: আমাদেরকে আব্দুর রাহমান ইবনু মাহদী বলেছেন, তিনি সুফিয়ান সাওরী থেকে, তিনি আ’মাশ থেকে, তিনি আবু সালিহ থেকে তিনি আবু হুরাইরা থেকে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: ‘‘যোহরের সালাত ঠান্ডা করে আদায় করবে; কারণ উত্তাপের কাঠিন্য জাহান্নামের প্রশ্বাস থেকে।’’। একথা শুনেই প্রতিবাদ করেন আবু যুর‘আ রাযী। তিনি বলেন: আপনি (তাবিয়ী আবু সালিহ-এর উস্তাদ সাহাবীর নাম আবু হুরাইরা উল্লেখ করে) ভুল বললেন। সকলেই তো হাদীসটি (তাবিয়ী আবু সালিহ-এর মাধ্যমে) সাহাবী আবু সাঈদ খুদরীর সূত্রে বর্ণনা করেন। কথাটি আব্দুর রাহমানের মনে খুবই লাগে। তিনি বাড়ি ফিরে নিজের কাছে রক্ষিত পান্ডুলিপি পরীক্ষা করে আবু যুরআর কাছে চিঠি লিখে বলেন: ‘‘আমি আপনাদের উপস্থিতিতে একটি হাদীস আবু হুরাইরার সূত্রে বর্ণনা করেছিলাম। আপনি বলেছিলেন যে, আমার বর্ণনা ভুল, সবাই হাদীসটি আবু সাঈদের সূত্রে বর্ণনা করেন। কথাটি আমার মনে খুবই আঘাত করেছিল। আমি বিষয়টি ভুলতে পারি নি। আমি বাড়িতে ফিরে আমার নিকট সংরক্ষিত পান্ডলিপি পরীক্ষা করে দেখেছি। সেখানে দেখলাম যে হাদীসটি আবু সাঈদের সূত্রেই বর্ণিত। যদি আপনার কষ্ট না হয় তাহলে আবু হাতিম ও অন্য সকল বন্ধুকে জানিয়ে দেবেন যে, আমার ভুল হয়েছিল। আল্লাহ আপনাকে পুরস্কৃত করুন। ভুল স্বীকার করে লজ্জিত হওয়া (ভুল গোপন করে) জাহান্নামে পোড়ার চেয়ে উত্তম।’’[5]
(৬) তৃতীয় হিজরী শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস সুলাইমান ইবনু হারব (২২৪ হি) বলেন: আমি যখন আমার সমসাময়িক প্রসিদ্ধ ‘নাকিদ’ মুহাদ্দিস ইয়াহইয়া ইবনু মা‘য়ীন (২৩৩ হি) এর সাথে বিভিন্ন হাদীস আলোচনা করতাম, তখন তিনি মাঝে মাঝে বলতেন: এ হাদীসটি ভুল। আমি বলতাম: এর সঠিক রূপ কি হবে? তিনি বলতেন তা জানি না। তখন আমি আমার পান্ডুলিপি দেখতাম। আমি দেখতে পেতাম যে, তাঁর কথাই ঠিক। হাদীসগুলো পান্ডুলিপিতে অন্যভাবে লিখা রয়েছে।[6]
(৭) ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (২৪১ হি) কে প্রশ্ন করা হয়: আবুল ওয়ালীদ কি পরিপূর্ণ নির্ভরযোগ্য? তিনি বলেন: না। তার পান্ডুলিপিগুলিতে নোকতা দেওয়া ছিল না এবং হরকত দেয়া ছিল না। তবে তিনি শু’বা ইবনুল হাজ্জাজের কাছ থেকে যে হাদীসগুলো শুনেছিলেন ও লিখেছিলেন সেগুলো তিনি বিশুদ্ধভাবে বর্ণনা করেছেন।[7]
(৮) তৃতীয় শতকের একজন হাদীস বর্ণনাকারী ইয়াকূব ইবনু হুমাইদ ইবনু কাসিব (২৪০ হি)। ইমাম আবু দাউদ (২৭৫ হি) বলেন, ইয়াকূব- এর বর্ণিত হাদীসগুলোর মধ্যে অনেক হাদীস দেখতে পেলাম যেগুলো অন্য কেউ এভাবে বর্ণনা করেন না। এজন্য আমরা তাকে তার মূল পান্ডুলিপিগুলি দেখাতে অনুরোধ করি। তিনি কিছুদিন যাবত আমাদের অনুরোধ উপেক্ষা করেন। এরপর তিনি তার পান্ডুলিপি বের করে আমাদেরকে দেখান। আমরা দেখলাম তার পান্ডুলিপিতে অনেক হাদীস নতুন তাজা কালি দিয়ে লেখা। পুরাতন লিখা ও নতুন লিখার মধ্যে পার্থক্য ধরা পড়ে। আমরা দেখলাম অনেক হাদীসের সনদের মধ্যে রাবীর নাম ছিল না, তিনি সেখানে নতুন করে রাবীর নাম বসিয়েছেন। কোনো কোনো হাদীসের ভাষার মধ্যে অতিরিক্ত শব্দ বা বাক্য যোগ করেছেন। এজন্য আমরা তার হাদীস গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকি।[8]
(৯) ৪র্থ হিজরী শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস আবু আহমাদ আব্দুল্লাহ ইবনু আদী (৩৬৫ হি) বলেন: মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনুল আশ‘আশ নামক এক ব্যক্তি মিশরে বসবাস করতেন এবং হাদীস বর্ণনা করতেন। আমি হাদীস সংগ্রহের সফরকালে মিশরে তার কাছে গমন করি। তিনি আমাদেরকে একটি পান্ডুলিপি বের করে দেন। পান্ডুলিপিটির কালি তাজা এবং কাগজও নতুন। এতে প্রায় এক হাজার হাদীস ছিল, যেগুলো তিনি আলী (রা)-এর বংশধর মূসা ইবনু ইসমাঈল ইবনু মুসা ইবনু জা’ফার সাদিক ইবনু মুহাম্মাদ বাকির ইবনু যাইনুল আবিদীন ইবনু হুসাইন ইবনু আলী থেকে তাঁর পিতা-পিতামহদের সূত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনেছেন বলে দাবী করেন। এর প্রায় সকল হাদীসই অজ্ঞাত, অন্য কেউ এ সনদে বা অন্য কোনো সনদে তা বর্ণনা করেনি। কিছু হাদীসের শব্দ বা মতন অন্যান্য সহীহ হাদীসে পাওয়া যায়, তবে এই সনদে নয়। তখন আমি সনদে উল্লিখিত মুসা ইবনু ইসমাঈল সম্পর্কে আলী-বংশের সমকালীন অন্যতম নেতা হুসাইন ইবনু আলীকে প্রশ্ন করি। তিনি বলেন: এই মূসা ৪০ বছর যাবত মদীনায় আমার প্রতিবেশী ছিলেন। তিনি কখনোই কোনোদিন বলেন নি যে, তিনি তাঁর পিতা-পিতামহদের সূত্রে বা অন্য কোনো সূত্রে কোনো হাদীস তিনি শুনেছেন বা বর্ণনা করেছেন। ইবনু আদী বলেন: এ পান্ডুলিপির হাদীসগুলোর কোনো ভিত্তি আমরা খুজে পাই নি। এগুলো তিনি বানিয়েছিলেন বলে বুঝা যায়।[9]
[2] ইবনু আবী হাতিম, আল-জারহু ওয়াত তা’দীল ১/৬৪-৬৫।
[3] ইবনু আবী হাতিম, প্রাগুক্ত ১/২৭১।
[4] ইবনু আবী হাতিম, প্রাগুক্ত ১/৩৩৭; ইবনু হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ৭/৩০।
[5] ইবনু আবী হাতিম, আল-জারহু ওয়াত তা’দীল ১/৩৩৬।
[6] ইবনু আবী হাতিম, প্রাগুক্ত ১/৩১৪।
[7] আহমাদ ইবনু হাম্মাল, আল-ইলাল ওয়া মা’রিফাতুর রিজাল ২/৩৬৯।
[8] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৭/২৭৬-২৭৭; সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১১/১৫৯।
[9] ইবনু আদী, আল-কামিল ৬/৩০১-৩০২; ইবনুল জাওযী, আদ-দুআফা ৩/৪৩, ৯৭।