আমরা দেখেছি যে, সাহাবীগণ হাদীসের সনদ বা তথ্য-সূত্র বলার রীতি চালু করেন। যেন সূত্র যাচাইয়ের মাধ্যমে হাদীসের সত্যাসত্য যাচাই করা যায়। পরবর্তী যুগগুলোতে সনদ সংরক্ষণের বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়। হাদীস বর্ণনাকারী ব্যক্তির প্রসিদ্ধি, সততা, মহত্ব, পান্ডিত্য ইত্যাদি যত বেশিই হউক না কেন, তিনি কার কাছ থেকে হাদীসটি শুনেছেন এবং তিনি কোন্ সূত্রে হাদীসটি বলেছেন তা উল্লেখ না করলে মুহাদ্দিসগণ কখনোই তার বর্ণিত হাদীসকে নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করেন নি। উপরন্তু তিনি এবং তার সনদে বর্ণিত প্রত্যেক রাবী পরবর্তী রাবী থেকে হাদীসটি নিজে শুনেছেন কিনা তা যাচাই করেছেন। সনদের গুরুত্ব বুঝাতে অনেক কথা তাঁরা বলেছেন।
প্রথম হিজরী শতকের প্রখ্যাত তাবিয়ী মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন বলেন:
إِنَّ هَذَا الْعِلْمَ دِينٌ فَانْظُرُوا عَمَّنْ تَأْخُذُونَ دِينَكُمْ
এ জ্ঞান হলো দীন (ধর্ম); কাজেই কার কাছ থেকে তোমাদের দীন গ্রহণ করছ তা দেখে নেবে।[1]
সুফিয়ান ইবনু উ‘আইনাহ (১৯৮ হি) বলেন, একদিন ইবনু শিহাব যুহরী (১২৫ হি) হাদীস বলছিলেন। আমি বললাম: আপনি সনদ ছাড়াই হাদীসটি বলুন। তিনি বলেন: তুমি কি সিঁড়ি ছাড়াই ছাদে আরোহণ করতে চাও?[2]
দ্বিতীয় হিজরী শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস সুফিয়ান ইবনু সাঈদ আস-সাওরী (১৬১ হি) বলেন: ‘‘সনদ মুমিনের অস্ত্র স্বরূপ।’’[3]
উতবাহ ইবনু আবী হাকীম (১৪০ হি) বলেন, একদিন আমি ইসহাক ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু আবী ফারওয়া (১৪৪ হি) এর কাছে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে ইবনু শিহাব যুহরী (১২৫ হি) উপস্থিত ছিলেন। ইবনু আবী ফারওয়া হাদীস বর্ণনা করে বলতে থাকেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ...। তখন ইবনু শিহাব যুহরী তাকে বলেন, হে ইবনু আবী ফারওয়া, আল্লাহ আপনাকে ধ্বংস করুন! আল্লাহর নামে কথা বলতে আপনার কত বড় দুঃসাহস! আপনি হাদীস বলছেন অথচ হাদীসে সনদ বলছেন না। আপনি আমাদেরকে লাগামহীন হাদীস বলছেন!’’[4]
প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (১৮১ হি) বলেন:
الإِسْنَادُ مِنَ الدِّينِ وَلَوْلا الإِسْنَادُ لَقَالَ مَنْ شَاءَ مَا شَاءَ
‘‘সনদ বর্ণনা ও সংরক্ষণ দীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সনদ বর্ণনার ব্যবস্থা না থাকলে যে যা চাইত তাই বলত।’’[5]
তৃতীয় হিজরী শতকের মুহাদ্দিস আবু ইসহাক ইবরাহীম ইবনু ইসহাক ইবনু ঈসা (২১৫ হি) বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (১৮১ হি)-কে বললাম, একটি হাদীসে বলা হয়েছে, ‘তোমার সালাতের সাথে পিতামাতার জন্য সালাত আদায় করা এবং তোমার সিয়ামের সাথে পিতামাতার জন্য সিয়াম পালন করা নেককর্মের অন্তর্ভুক্ত।’ তিনি বলেন: হাদীসটি আপনি কার কাছ থেকে শুনেছেন? আমি বললাম: শিহাব ইবনু খিরাশ থেকে। তিনি বলেন: শিহাব নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি, তিনি কার কাছে শুনেছেন? আমি বললাম: তিনি হাজ্জাজ ইবনু দীনার থেকে। তিনি বলেন: হাজ্জাজ নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি, তিনি কার কাছ থেকে শুনেছেন? আমি বললাম: তিনি বলেছেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন। ইবনুল মুবারাক বললেন: হে আবু ইসহাক, হাজ্জাজ ইবন দীনার ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মাঝে বিশাল দূরত্ব রয়েছে, যে দূরত্ব অতিক্রম করতে অনেক বাহনের প্রয়োজন। অর্থাৎ হাজ্জাজ দ্বিতীয় হিজরীর শেষ দিকের একজন তাবি-তাবিয়ী। অন্তত ২/৩ জন ব্যক্তির মাধ্যম ছাড়া তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন না। তিনি যেহেতু বাকী সনদ বলেন নি, সেহেতু হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয়।[6]
এভাবে প্রথম হিজরী শতাব্দী থেকে মুসলিম উম্মাহ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে ‘সনদ’ (uninterrupted chain of authorities) উল্লেখ অপরিহার্য বলে গণ্য করেছেন। মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় হাদীস বলতে দুটি অংশের সমন্বিত রূপকে বুঝায়। প্রথম অংশ: হাদীসের সূত্র বা সনদ ও দ্বিতীয় অংশ: হাদীসের মূল বক্তব্য বা ‘মতন’।
একটি উদাহরণ দেখুন। ইমাম মালিক (১৭৯ হি) ২য় হিজরী শতকের একজন প্রসিদ্ধ হাদীস সংকলক। তিনি তাঁর মুয়াত্তা গ্রন্থে বলেন:
مَالِك عَنْ أَبِي الزِّنَادِ عَنِ الأَعْرَجِ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ ذَكَرَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ فَقَالَ فِيهِ سَاعَةٌ لا يُوَافِقُهَا عَبْدٌ مُسْلِمٌ وَهُوَ قَائِمٌ يُصَلِّي يَسْأَلُ اللَّهَ شَيْئًا إِلا أَعْطَاهُ إِيَّاهُ وَأَشَارَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ بِيَدِهِ يُقَلِّلُهَا
‘‘মালিক, আবুয্ যিনাদ (১৩০হি) থেকে, তিনি আ’রাজ (১১৭হি) থেকে, তিনি আবূ হুরাইরা (৫৯হি) থেকে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শুক্রবারের কথা উল্লেখ করে বলেন: এ দিনের মধ্যে একটি সময় আছে কোনো মুসলিম যদি সে সময়ে দাঁড়িয়ে সালাতরত অবস্থায় আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করে তবে আল্লাহ তাকে তা প্রদান করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাত দিয়ে ইঙ্গিত করেন যে, এ সুযোগটি স্বল্প সময়ের জন্য।’’[7]
উপরের হাদীসের প্রথম অংশ ‘‘মালিক আবুয্ যিনাদ থেকে.... আবু হুরাইরা থেকে’’ হাদীসের সনদ বা সূত্র। শেষে উল্লিখিত রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর বাণীটুকু হাদীসের ‘‘মতন’’ বা বক্তব্য। মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় হাদীস বলতে শুধু শেষের বক্তব্যটুকুই নয়, বরং সনদ ও মতনের সম্মিলিত রূপকেই হাদীস বলা হয়। একই বক্তব্য দুটি পৃথক সনদে বর্ণিত হলে তাকে দুটি হাদীস বলে গণ্য করা হয়। অনেক সময় শুধু সনদকেই হাদীস বলা হয়।[8]
[2] সুয়ূতী, জালালুদ্দীন আব্দুর রাহমান (৯১১ হি), তাদরীবুর রাবী ২/১৬০।
[3] সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ২/১৬০।
[4] হাকিম নাইসাপূরী, মা’রিফাতু উলূমিল হাদীস পৃ: ৬; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ১/৩৪৪।
[5] মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৫।
[6] মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৬।
[7] মালিক ইবনু আনাস (১৭৯) আল-মুআত্তা ১/১০৮।
[8] ইবনু হাজার আসকালানী, লিসানুল মীযান ৩/২৫৩।