হাদীসের নামে জালিয়াতি ২. মিথ্যা ও ওহীর নামে মিথ্যা ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
২. ১. ৩. মিথ্যা বনাম ‘মাউদূ’ (মাউযূ)[1] ও ‘বাতিল’

হাদীসের পরিভাষায় ও ১ম শতকে সাহাবী-তাবিয়ীগণের পরিভাষায় রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে কথিত মিথ্যাকে حديث كذب বা ‘মিথ্যা হাদীস’ বলে অভিহিত করা হতো। আবু উমামাহ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ () বলেন:

مَنْ حَدَّثَ عَنِّيْ حَدِيْثاً كَذِباً مُتَعَمِّداً فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدُهُ مِنَ النَّارِ

যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক আমার নামে ‘মিথ্যা হাদীস’ বলবে তাকে জাহান্নামে বসবাস করতে হবে।[2]

যে কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন নি তা তাঁর নামে বলা হলে সাহাবী ও তাবিয়িগণ বলতেন: ‘هذا الحديث كذب’ এ হাদীসটি মিথ্যা, ‘حديث كذب’ মিথ্যা হাদীস বা অনুরূপ শব্দ ব্যবহার করতেন। এ ধরনের মানুষদের সম্পর্কে ‘মিথ্যাবাদী’ (كذّاب), ‘সে মিথ্যা বলে’ (يكذب) ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করতেন।[3]

দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে হাদীসের নামে মিথ্যার প্রসারের সাথে সাথে এ সকল মিথ্যাবাদীদের চিহ্নিত করতে মুহাদ্দিসগণ ‘মিথ্যা’-র সমার্থক আরেকটি শব্দ ব্যবহার করতে থাকেন। শব্দটি ‘الوضع’। শব্দটির মূল অর্থ নামানো, ফেলে দেয়া, জন্ম দেয়া। বানোয়াটি অর্থেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়।[4] ইংরেজিতে: To lay, lay off, lay on, lay down, put down, set up... give birth, produce ...humiliate, to be low, humble...[5]

পরবর্তী যুগে মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় এ শব্দের ব্যবহারই ব্যাপকতা লাভ করে। তাঁদের পরিভাষায় হাদীসের নামে মিথ্যা বলাকে ‘ওয়াদউ’ (وضع) এবং এধরনের মিথ্যা হাদীসকে ‘মাউদূ’ (موضوع) বলা হয়। ফার্সী-উর্দু প্রভাবিত বাংলা উচ্চারণে আমরা সাধারণত বলি ‘মাউযূ’।

অনেক মুহাদ্দিস ইচ্ছাকৃত মিথ্যা ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা বা ভুল উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করেন নি। উভয় প্রকার মিথ্যা হাদীসকেই তাঁরা মাউদূ (موضوع) হাদীস বলে অভিহিত করেছেন।[6] বাংলায় আমরা মাউদূ (মাউযূ) অর্থ বানোয়াট বা জাল বলতে পারি।

মুহাদ্দিসগণ মাউযূ (মাউদূ) হাদীসের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন দু’ভাবে: অনেক মুহাদ্দিস মাউযূ হাদীসের সংজ্ঞায় বলেছেন: ‘المختلق المصنوع’ ‘‘বানোয়াট জাল হাদীসকে মাউযূ হাদীস বলা হয়।’’ এখানে তাঁরা হাদীসের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।[7]

অন্যান্য মুহাদ্দিস মাউযূ হাদীসের সংজ্ঞায় বলেছেন: (ما تفرد بروايته كذاب) ‘‘যে হাদীস কোনো মিথ্যাবাদী রাবী একাই বর্ণনা করেছে তা মাউযূ হাদীস।’’[8] এখানে তাঁরা মাউযূ বা জাল হাদীসের সাধারণ পরিচয়ের দিকে লক্ষ্য করেছেন। মুহাদ্দিসগণ তুলনামূলক নিরীক্ষার (Cross Examine) মাধ্যমে রাবীর সত্য-মিথ্যা যাচাই করতেন। নিরীক্ষার মাধ্যমে যদি প্রমাণিত হয় যে, কোনো একটি হাদীস একজন মিথ্যাবাদী ব্যক্তি ছাড়া কেউ বর্ণনা করছেন না তবে তাঁরা হাদীসটিকে মিথ্যা বা মাউযূ বলে গণ্য করতেন।

কোনো কোনো মুহাদ্দিস ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তাঁরা অনিচ্ছাকৃত মিথ্যাকে ‘বাতিল’ (باطل) ও ইচ্ছাকৃত মিথ্যাকে ‘মাউযূ’ বা ‘মাউদূ’ (موضوع) বলে অভিহিত করেছেন। নিরীক্ষা মাধ্যমে যদি প্রমাণিত হয় যে, এ বাক্যটি রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন নি, কিন্তু ভুল করে তাঁর নামে বলা হয়েছে, তাহলে তাঁরা সে হাদীসটিকে ‘বাতিল’ বলে অভিহিত করেন। আর যদি প্রমাণিত হয় যে, বর্ণনাকারী ইচ্ছাপূর্বক বা জ্ঞাতসারে এ কথাটি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে বলেছে, তাহলে তাঁরা একে ‘মাউযূ’ নামে আখ্যায়িত করেন।[9]

মিথ্যা হাদীস সংকলনের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ প্রথম পদ্ধতিরই অনুসরণ করেছেন। তাঁরা ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত সকল প্রকার মিথ্যাকেই ‘মাউযূ’ (موضوع) বলে গণ্য করেছেন। তাঁদের উদ্দেশ্য হলো, যে কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন নি বা যে কর্ম তিনি করেন নি, অথচ তাঁর নামে কথিত বা প্রচারিত হয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করে ওহীর নামে জালিয়াতি রোধ করা। বর্ণনাকারী ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যাটি বলেছেন, না ভুলক্রমে তা বলেছেন সে বিষয় তাঁদের বিবেচ্য নয়। এ বিষয় বিবেচনার জন্য রিজাল ও জারহ ওয়াত্ তা’দীল শাস্ত্রে পৃথক ব্যবস্থা রয়েছে।[10]

[1] মূল আরবী উচ্চারণে আমরা (মাউদূ) বলতেই অভ্যস্থ। পক্ষান্তরে ফার্সী ও উর্দু প্রভাবিত বাংলা ব্যবহারে আমরা (মাউযূ) বলে থাকি। এ বইয়ে উভয় উচ্চারণই ব্যবহার করা হয়েছে।

[2] তাবারানী, সুলাইমান ইবনু আহমাদ (৩৬০ হি), আল-মু’জামুল কাবীর ৮/১২২।

[3] ইবনু আবী হাতিম, আব্দুর রাহমান ইবনু মুহাম্মাদ (৩২৭ হি), আল-জারহু ওয়াত তা’দীল ১/৩৪৯, ৩৫০, ৩৫১, ৩/৪০৭, ৬/২১২, ৮/১৬, ৫২, ৩২৫; যাহাবী, মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ (৭৪৮ হি) মীযানুল ই’তিদাল ১/২৭১, ২৮৫, ২/৮০, ১০৯, ১২২, ২৪১, ৩/৪, ৫০, ৩৭৫, ৪৬৭, ৪৭৫, ৪/৩১, ৯১, ১৭৮, ১৯১, ৪২০, ৪২৮, ৪৩৭, ৫/৩, ২৯, ৫২, ৫৪, ৮৮, ১২৮, ১৬৯, ২০৭, ২২০, ৬/২৪, ৫৫, ১৩৮, ২৪৬, ২৪৯, ৫৩৪, ৫৪৫, ৫৬৬, ৭/২১৯, ৩৪১, ৩৯৩, ৮/১৬২, ১৮২, ১৯৬; ইবনু হাজার আসকালানী, আহমাদ ইবনু আলী (৮৫২ হি), ফাতহুল বারী, ১৩/১১৩; আল-মুনাবী, মুহাম্মাদ আব্দুর রাঊফ (১০৩১ হি), ফাইদুল কাদীর ১/৫৪০, ৩/২১৯, ৫/৩০০, ৬/১৫, ২১৬, ২২১, ৩৫৩।

[4] ইবনু দুরাইদ, মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান (৩২১ হি), জামহারাতুল লুাগাহ ৩/৯৫; জাওহারী, ইসমাঈল ইবনু মুহাম্মাদ (৩৯৩ হি), আস-সিহাহ ৩/১২৯৯; ইবনু ফারিস, আহমাদ (৩৯৫ হি), মু’জাম মাকাঈসুল লুগাহ ৬/১১৭-১১৮; ইবনুল আসীর, মুহাম্মাদ ইবনুল মুবারাক (৬০৬ হি), আন-নিহাইয়াহ ৫/১৯৭, ১৯৮; ইবনু মানযূর, মুহাম্মাদ ইবনু মাকরাম (৭১১ হি) লিসানুল আরাব ৮/৩৯৬-৩৯৭; ফাল্লাতা, উমার ইবনু হাসান, আল-ওয়াদউ ফিল হাদীস ১/১০৮।

[5] Hans Wehr, A Dictionary of Modern Written Arabic, p 1076.

[6] হাকিম নাইসাপূরী, মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ (৪০৫ হি), মা’রিফাতু উলুমিল হাদীস, পৃ: ১১৯-১২১; ইবনুল জাওযী, আব্দুর রাহমান ইবনু আলী (৫৯৭ হি), আল-ইলালুল মুতানাহিয়্যাহ ১/১৭২-১৭৩; মুযযী, ইউসূফ ইবনুয যাকী (৭৪২ হি), তাহযীবুল কামাল ১৯/৪৮৩।

[7] ইরাকী, আত-তাকঈদ, পৃ: ১২৮; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/২৭৪; ইবনু জামা‘আ, মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম (৭৩৩ হি), আল-মানহালুর রাবী, পৃ: ৫৩; মুহাম্মাদ সালিহ উসাইমীন, শারহুল বাইকূনিয়্যাহ, পৃ: ১৩৫।

[8] ইবনু হাজার আসকালানী, নুখবাতুল ফিকার, পৃ: ২৩০, আব্দুল হক্ক দেহলবী (১০৫২ হি), মুকাদ্দিমা ফী উসূলিল হাদীস, পৃ: ৬৩-৬৪।

[9] মুআল্লিমী, আব্দুর রাহমান ইবনু ইয়াহইয়া আল-ইয়ামানী (১৩৮৬ হি), মুকাদ্দিমাতুল ফাওয়াইদিল মাজমূ‘আ লিশ-শাওকানী, পৃ: ৫৭; ফাল্লাতা, আল-ওয়াদউ ১/১০৮।

[10] মুআল্লিমী, মুকাদ্দিমাতুল ফাওয়াইদ, পৃ: ৫৭।