রমাযান মাস কুরআনের মাস।

(شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدىً لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ)

‘‘রমাযান মাস; যে মাসে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।’’

(কুরআনুল কারীম ২/১৮৫)

জিবরীল u রমাযানের প্রত্যেক রাত্রে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে কুরআন পাঠ করাতেন।[1]

ফাতিমা (রাঃ) বলেন, আববা বলেছেন যে, জিবরীল u প্রত্যেক বছর একবার করে তাঁর উপর কুরআন পেশ করতেন (পড়ে শুনাতেন)। কিন্তু তাঁর ইন্তিকালের বছরে দুইবার কুরআন পেশ করেন।[2]

উপরোক্ত হাদীসদ্বয় থেকে এই নির্দেশ পাওয়া যায় যে, রমাযান মাসে কুরআন পঠন-পাঠন করা, এ উদ্দেশ্যে জমায়েত হওয়া এবং অপেক্ষাকৃত বড় হাফেয বা কারীর কাছে কুরআন পেশ করা (হিফ্য পুনরাবৃত্তি করা) মুস্তাহাব। আর তাতে এ কথারও দলীল রয়েছে যে, রমাযান মাসে বেশী বেশী করে কুরআন তেলাঅত করা উত্তম।

প্রথমোক্ত হাদীস থেকে জানা যায় যে, জিবরীল u মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর সাথে রাত্রিতে কুরআন পুনরাবৃত্তি করতেন। আর তাতে বুঝা যায় যে, রমাযানের রাতে অধিকাধিক কুরআন তেলাঅত করা মুস্তাহাব। যেহেতু রাতে কোন রকম ব্যস্ততা থাকে না, রাতে ইবাদত করতে মনের উদ্দীপনা সুসংবদ্ধ থাকে এবং হৃদয়-মন ও রসনা কুরআন উপলব্ধি করতে সমপ্রয়াসী হয়। মহান আল্লাহ বলেন,

(إِنَّ ناشِئَةَ اللَّيْلِ هِيَ أَشَدُّ وَطْأً وَّأَقْوَمُ قِيْلاً)

অর্থাৎ, নিশ্চয় রাত্রি জাগরণ মনের একাগ্রতা ও হৃদয়ঙ্গমের জন্য অতিশয় অনুকূল। (কুরআনুল কারীম ৭৩/৬)

সলফে সালেহীন রমাযান মাসে বেশী বেশী কুরআন পাঠ করতেন। তাঁদের কেউ কেউ প্রত্যেক ৩ রাতে কিয়ামে পূর্ণ কুরআন খতম করতেন। কেউ কেউ খতম করতেন ৭ রাতে; এঁদের মধ্যে কাতাদাহ অন্যতম। কিছু সলফ ১০ রাতে খতম করতেন; এঁদের মধ্যে আবূ রাজা উতারিদী অন্যতম। আসওয়াদ রমাযানের প্রত্যেক ২ রাতে কুরআন খতম করতেন। নাখয়ী রমাযানের শেষ দশকে ২ রাতে এবং তার পূর্বে ৩ রাতে কুরআন খতম করতেন। রমাযান মাস প্রবেশ করলে যুহরী বলতেন, ‘এ মাস তো কুরআন তেলাঅত এবং মিসকীনদেরকে খাদ্য দান করার মাস।’ ইমাম মালেক রমাযান এলে হাদীস পড়া এবং আহলে ইল্মদের বৈঠকে বসা বাদ দিয়ে মুসহাফ দেখে কুরআন পড়তে যত্নবান হতেন। সুফিয়ান সওরী রমাযান মাস প্রবেশ করলে সকল ইবাদত ত্যাগ করে কুরআন তেলাঅত করতে প্রয়াসী হতেন।[3]

এ কথা বিদিত যে, ২ রাতে কুরআন খতম করা বিধেয় নয়। কারণ মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি ৩ রাতের কমে কুরআন পড়ে, সে তা বুঝে না।’’[4] কিন্তু ইবনে রজব (রঃ) বলেন, ৩ রাতের কম সময়ে কুরআন পড়তে যে নিষেধ এসেছে, তা আসলে নিয়মিতভাবে সারা বছরে করলে নিষিদ্ধ। নচেৎ, মর্যাদা ও মাহাত্ম্যপূর্ণ সময়; যেমন রমাযান মাসে এবং বিশেষ করে যে সকল রাত্রে শবেকদর অনুসন্ধান করা হয় সে সকল রাত্রে অথবা মর্যাদা ও মাহাত্ম্যপূর্ণ স্থান; যেমন মক্কায় বহিরাগত ব্যক্তির জন্য বেশী বেশী করে কুরআন তেলাঅত করা মুস্তাহাব। যাতে মর্যাদা ও মাহাত্ম্যপূর্ণ ঐ সময় ও স্থানের যথার্থ কদর করা হয়। এ কথা বলেছেন আহমাদ, ইসহাক প্রমুখ ইমামগণ। আর এরই উপর আমল হল অন্যান্যদের; যেমন উপর্যুক্ত উদ্ধৃতি দ্বারা সে কথা স্পষ্ট হয়।[5]

এ কথা অবিদিত নয় যে, যে কুরআন তেলাঅত তেলাঅতকারীর জন্য সম্যক্ উপকারী, তা হল তার আয়াতের অর্থ, আদেশ ও নিষেধ অনুধাবন করে ও বুঝে তেলাঅত। সুতরাং তেলাঅতকারী যদি এমন কোন আয়াত পড়ে, যাতে আল্লাহ তাকে কিছুর আদেশ করেছেন, তাহলে তা পালন করে। অনুরূপ এমন কোন আয়াত পড়ে, যাতে আল্লাহ তাকে কিছু নিষেধ করেছেন, তাহলে তা বর্জন করে ও তা থেকে বিরত হয়। কোন রহমতের আয়াত তেলাঅত করলে আল্লাহর কাছে রহমত ভিক্ষা করে এবং তাঁর নিকট দয়ার আশা করে। আযাবের আয়াত পাঠ করলে আল্লাহর নিকট তা থেকে পানাহ চায় এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে। যে তেলাঅতকারী এমন করে, আসলে সেই কুরআন অনুধাবন করে এবং তার উপর আমল করে। আর তারই জন্য কুরআন হবে সবপক্ষের দলীল। পক্ষান্তরে যে তেলাঅতকারী কুরআন অনুযায়ী আমল করে না, সে তাতে উপকৃতও হয় না। আর কুরআন তার বিরুদ্ধে দলীল হয়ে যাবে। মহান আল্লাহ বলেন,

(كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ)

অর্থাৎ, আমি এই বর্কতময় কিতাব তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধশক্তি-সম্পন্ন ব্যক্তিগণ উপদেশ গ্রহণ করে। (কুরআনুল কারীম ৩৮/২৯)[6]

মসজিদে কুরআন তেলাঅত করলে এমন উচ্চস্বরে করা উচিৎ নয়, যাতে নামাযীদের ডিষ্টার্ব হয়। যেহেতু মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) এ ব্যাপারে নিষেধ করে বলেন, ‘‘অবশ্যই নামাযী তাঁর প্রভুর কাছে মুনাজাত করে। অতএব তার লক্ষ্য করা উচিৎ, সে কি দিয়ে তাঁর কাছে মুনাজাত করছে। আর তোমাদের কেউ যেন অপরের কাছে উচ্চস্বরে কুরআন না পড়ে।’’[7]

অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, কুরআন পড়া ভাল, নাকি শোনা ভাল। আসলে উত্তম হল তাই করা, যা মনোযোগের জন্য এবং প্রভাবাw¦বত হওয়ার দিক থেকে বেশী উত্তম। কারণ, তেলাঅতের উদ্দেশ্য হল, আয়াতের অর্থ অনুধাবন, হৃদয়ঙ্গম ও মহান আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী আমল।[8]

সাধারণভাবে কুরআন তেলাঅতের রয়েছে বিশাল মর্যাদা এবং বিরাট সওয়াব। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘তোমরা কুরআন পাঠ কর। কেন না তা কিয়ামতের দিন তার পাঠকারীদের জন্য সুপারিশকারীরূপে উপস্থিত হবে। ---’’[9]

তিনি আরো বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব হতে একটি মাত্র অক্ষর পাঠ করে সে ব্যক্তি একটি নেকী লাভ করে। আর একটি নেকী দশগুণ বর্ধিত করা হয়। আমি বলছি না যে, ‘আলিফ-লাম-মীম’ একটি অক্ষর। বরং ‘আলিফ’ একটি অক্ষর, ‘লাম’ একটি অক্ষর এবং ‘মীম’ একটি অক্ষর।’’[10]

[1] (বুখারী ৬, মুসলিম ২৩০৮নং)

[2] (বুখারী ১০৮৮পৃঃ)

[3] (লামাঃ ইবনে রজব ১৭২, ১৭৯, ১৮১-১৮২ পৃঃ, কাই নাস্তাফীদা মিন রামাযান ৪৮-৪৯পৃঃ, কাইফা নাঈশু রামাযান১৭পৃঃ, হাদিয়্যাতু লিস-সায়েমীন ১১পৃঃ দ্রঃ)

[4] (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, দারেমী, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৭৭৪৩নং)

[5] (কাই নাস্তাফীদা মিন রামাযান ৪৮-৪৯পৃঃ, কাইফা নাঈশু রামাযান ১৭পৃঃ, হাদিয়্যাতু লিস-সায়েমীন ১১পৃঃ দ্রঃ)

[6] (ইতহাফঃ ৫১-৫২পৃঃ দ্রঃ)

[7] (আহমাদ, মুসনাদ, ত্বাবারানী, মু’জাম, সহীহ আবূ দাঊদ ১২০৩নং, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ১৯৫১নং) (যাদুস সায়েম অফাযলুল ক্বায়েম ১৯পৃঃ)

[8] (সালাতুল-লাইলি অত্-তারাবীহ, ইবনে বায ৪৬পৃঃ)

[9] (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ১১৬৫নং)

[10] (বুখারী তারীখ, তিরমিযী, হাকেম, মুস্তাদ্রাক, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৬৪৬৯ নং)