والعين عينان: عين إنسيّة وعين جنيّة বদ নযর দুই প্রকার: মানুষের বদনযর এবং জিনদের বদনযর।

উম্মে সালামা হতে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, নাবী (ﷺ) তাঁর গৃহে এমন একটি মেয়েকে দেখলেন, যার চেহারা কালো রং ধারণ করেছিল। তখন তিনি বললেন- একে ঝাড়-ফুঁক কর। কারণ এর শরীরে বদনযর লেগেছে। ইমাম বগবী (রহঃ) বলেন- হাদীছে বর্ণিত কালো রং (سعف) বলতে জিনের বদনযর উদ্দেশ্য। মেয়েটির শরীরে জিনের বদ নযর লেগেছিল। জিনের বদনযর বর্শার অগ্রভাগের চেয়েও অধিক ধারালো হয়ে থাকে।

নাবী (ﷺ) জিন এবং মানুষের বদনযর হতে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। একটি ফির্কা তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি কম হওয়ার কারণে বদনযরের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। অথচ বিভিন্ন ধর্মের জ্ঞানী ও দার্শনিকরাও বদনযরের প্রভাবকে অস্বীকার করেনি এবং তারা এগুলোকে শুধু কল্পনা ও কুসংস্কার বলেনি। যদিও তারা এগুলোর কারণ ও প্রভাব সম্পর্কে মতভেদ করেছে।

কোন সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষের অন্তর ও শরীরে বিভিন্ন শক্তি ও স্বভাব তৈরী করেছেন। এই অন্তর বা রূহ ও শরীরগুলোর প্রত্যেকটির মধ্যেই এমন এমন স্বভাব ও বৈশিষ্ট রয়েছে, যা অপরের উপর প্রভাব ফেলে। কোন জ্ঞানীই শরীরের উপর মনের প্রভাবকে অস্বীকার করতে পারেনা। এটি একটি জানা ও দৃশ্যমান বিষয়, যা অস্বীকারের কোন সুযোগ নেই।

চোখের সরসূরি কোন প্রভাব নেই। আসলে প্রভাব পড়ে রূহ থেকে। মানুষের রূহ (অন্তর) বিভিন্ন স্বভাবের হওয়ার কারণে এর প্রভাবও হয় বিভিন্ন। অন্তরের সাথে যেহেতু চোখের গভীর সম্পর্ক রয়েছে, তাই ‘বদনযর’ নামক কর্মটিকে চোখের সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়া হয়েছে। হিংসুকের অন্তর মানুষকে কষ্ট দেয়। এই কষ্ট খুবই সুস্পষ্ট। এ জন্যই আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর নাবীকে আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি যেন হিংসুকের অনিষ্ট হতে তাঁর কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করেন। হাসেদের (হিংসুকের) বদনযর দ্বারা মাহসুদের (যাকে হিংসা করা হয়েছে) প্রভাবিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি এমন সুস্পষ্ট, যা কেবল ঐ ব্যক্তিই অস্বীকার করতে পারে, যে মানুষের প্রকৃত অবস্থা, গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। হিংসুককে বিষাক্ত সাপের সাথে তুলনা করা চলে। কেননা সাপের মধ্যে বিষ লুকায়িত থাকে। আর হিংসুকের অন্তরে হিংসার বিষ লুকায়িত থাকে। সাপ যখন তার শত্রুকে দেখে, তখন তার মধ্যে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠে এবং সে কষ্টদায়ক এক নিকৃষ্ট আকার ধারণ করে। কিছু সাপ আছে, যার অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ ও প্রখর। এগুলো গর্ভবতী মহিলার পেটের সন্তানকে ফেলে দেয়। আরও কিছু সাপ আছে, যার উপর দৃষ্টি পড়লেই চোখের দৃষ্টি চলে যায়। নাবী (ﷺ) আবতার (লেজকাটা এক প্রকার ছোট সাপ) ও যুত-তুফয়াতাইন (মাথায় দু’টি বিন্দু বিশিষ্ট সাপ) সম্পর্কে বলেছেন যে, এগুলো চোখের দৃষ্টি বিলুপ্ত করে দেয় এবং গর্ভের সন্তান ফেলে দেয়।

শরীরের পারস্পরিক মিশ্রণের ফলেই কেবল এক শরীর অন্য শরীরের উপর প্রভাব বিস্তার করা এবং এক দেহ থেকে অন্য দেহে রেসূ চলে যাওয়ার ধারণা ঠিক নয়। যেমন ধারণা করে থাকে শরীয়ত ও প্রকৃতি সম্পর্কে কম বুদ্ধি সম্পন্ন লোকেরা। বরং পারস্পরিক মিলনের ফলে কখনও এক দেহের প্রভাব অন্য শরীরে পতিত হয় আবার কখনও শুধু সামনাসামনি হওয়ার মাধ্যমেও হয় আবার কখনও শুধু পারস্পরিক দেখার মাধ্যমেও হয়। কখনও কখনও রূহানী তাওয়াজ্জুহের (আত্মার প্রতিক্রিয়ার) মাধ্যমে, কখনও দু’আ, ঝাড়-ফুক, তাবীজ-কবজ এবং খেয়াল ও কল্পনার মাধ্যমে একজনের প্রভাব অন্যজনের মধ্যে গিয়ে পতিত হয়। বদনযর প্রয়োগকারীর দেখার দ্বারাই কেবল বদনযর লাগেনা; বরং অন্ধরাও বদনযর প্রয়োগকারী হয়ে থাকে। অন্ধ বদনযর প্রয়োগকারীর জন্য বস্ত্তর বিবরণ পেশ করা হলে তার হিংসুক আত্মা তাতে প্রভাব ফেলতে সক্ষম। যদিও সে তা দেখেনি। অনেক বদনযর প্রয়োগকারী এমন হয় যে, না দেখে শুধু গুণাগুণ শুনেই বদনযর ফেলে। সুতরাং প্রত্যেক বদনযর দানকারীই হিংসুক। কিন্তু প্রত্যেক হিংসুক বদনযর প্রয়োগকারী নয়।

হিংসুক (হাসেদ) যেহেতু আম অর্থাৎ বদনযর প্রয়োগকারীর চেয়ে অধিকতর ব্যাপক হয়, তাই বদনযর প্রয়োগকারীর পরিবর্তে হিংসুক থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করার আদেশ দেয়া হয়েছে। এতে করে উভয় শ্রেণীর অনিষ্ট হতেই আশ্রয় প্রার্থনা হয়ে যাবে। বদনযর মূলত তীরের মতই, যা হাসেদ ও বদনযর প্রয়োগকারীর নফ্স ও মেজাজ থেকে বের হয়ে মাহসুদ ও বদনযরে আক্রান্ত ব্যক্তির দিকে যায়। তীরের মতই এটি আঘাত হানে।

কখনও লক্ষ্যবস্ত্ততে গিয়ে লাগে আবার কখনও ভুল করে। লক্ষ্যবস্ত্তটি যখন খোলা থাকে অর্থাৎ মানুষের শরীর যখন খোলা থাকে তথা যে ব্যক্তি আয়াতুল কুরসী, সূরা ইখলাস, নাস, ফালাকসহ অন্যান্য দু’আ পাঠ করার মাধ্যমে শরীরকে বন্ধ করে রাখেনা, তখন আল্লাহর ইচ্ছায় তার শরীরে বদনযর পতিত হয়।

আর যেই মুসলিম বান্দা সুচতুর হয় ও সাবধানতা অবলম্বন করে এবং শরীরকে উপরোক্ত অস্ত্র দিয়ে ঢেকে রাখে, তার শরীরে বদনযর প্রয়োগকারীর তীর প্রবেশের রাস্তা খুঁজে পায়না বলে তার উপর বদনযর প্রভাব বিস্তার করতে পারেনা। কখনও কখনও এই তীর নিক্ষেপকারীর দিকেই ফেরত আসতে পারে। যেমনটি লক্ষ্য করা যায় তীরন্দাজদের কাজ-কর্ম থেকে। অর্থাৎ বন্দুকধারী এবং তীরন্দাজরা কখনও নিজেদের তীর ও গুলিতেই আক্রান্ত এবং আহত হয়। এমনি বদনযর দানকারী কখনও নিজের বদনযরেই আক্রান্ত হয়। পার্থক্য শুধু এই যে, বদনযর বের হয় রূহ ও নফ্স থেকে। আর গুলি ও তীর বের হয় বন্দুক এবং ধনুক থেকে। বদনযরের স্বরূপ এ রকম যে, প্রথমে বদনযর প্রয়োগকারী কোন জিনিষ দেখে মুগ্ধ হয়। এর পরই তার নিকৃষ্ট আত্মা হিংসাত্মক অবস্থায় রূপান্তরিত হয়। অতঃপর ভিকটিমের (বদনযরের শিকার ব্যক্তির) উপর তার বিষযুক্ত দৃষ্টি ফেলে।

কখনও মানুষের উপর তার নিজের বদনযরই লেগে যায়। (নিজের স্ত্রী-পরিবার ও সন্তান-সন্ততির উপরও ব্যক্তির বদনযর পড়ে যাওয়ার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায়না)। কখনও তার বিনা ইচ্ছাতেই এরূপ হতে পারে। শুধু তার তবীয়ত (স্বভাব) ও মেজাজ দ্বারাও এমনটি হতে পারে। এটি হচ্ছে সর্বাধিক নিকৃষ্ট বদনযর। অর্থাৎ নিজের উপর নিজের বদনযর পড়া অত্যন্ত জটিল ও নিকৃষ্ট বিষয়।

আল্লামা ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) বলেন- আমাদের অনেক বন্ধু ও অন্যান্য ফিকাহবিদগণ বলেছেন- বদনযর প্রয়োগকারী বলে যাদেরকে জানা যাবে, শাসকের উচিৎ তাদেরকে আটকিয়ে রাখা এবং মৃত্যু পর্যন্ত আবদ্ধ অবস্থায় তাদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা। এটিই সঠিক মত।