হুনাইনের যুদ্ধে তায়েফের ছাকীফ গোত্র পরাজিত হয়ে তাদের সুরক্ষিত দুর্গে আশ্রয় নিল। সেখানে থেকে তারা যুদ্ধের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করল। রসূল (ﷺ) ও তাদের উদ্দেশ্যে বের হলেন। তাদের দুর্গের নিকটবর্তী হয়ে তিনি একটি স্থানে অবস্থান করতে লাগলেন। এ সময় ছাকীফ গোত্রের তীরন্দাজ বাহিনী মুসলমানদেরকে লক্ষ্য করে প্রচন্ডভাবে তীর নিক্ষেপ শুরু করল। পঙ্গপালের পাখার মত তীরগুলো উড়ে এসে মুসলমানদেরকে আঘাত করতে লাগল। এতে বহু মুসলিম আহত হন। তাদের মধ্যে হতে ১২ জন মৃত্যু বরণ করেন।

অতঃপর নাবী (ﷺ) সেখান থেকে সরে এসে তায়েফের ঐ স্থানে চলে আসলেন, যেখানে বর্তমানে ‘মসজিদুত্ তায়েফ’ তথা তায়েফের মসজিদ অবস্থিত। নাবী (ﷺ) তাদেরকে ১৮ দিন মতান্তরে ২৩ দিন অবরোধ করে রাখলেন। এ সময় মুসলিমগণ তাদের বিরুদ্ধে মিনজানিক (প্রাচীন ক্ষেপণাস্ত্রবিশেষ) দিয়ে আক্রমণ করেন। ইসলামের ইতিহাসে এ ধরণের অস্ত্রের এটিই ছিল প্রথম ব্যবহার। ঐ দিকে নাবী (ﷺ) মুসলমানদেরকে সেখানকার আঙ্গুরের বাগানগুলো কেটে ফেলার নির্দেশ দিলেন। মুসলমানগণ রসূল (ﷺ) এর আদেশ তামিল করতে গিয়ে দ্রুত কাফেরদের বাগানগুলো কাটতে লাগলেন।

ঐতিহাসিক ইবনে সা’দ বলেন- তায়েফবাসীরা রসূল (ﷺ) এর কাছে আল্লাহ্ ও আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে সেগুলোকে রেখে দিতে বললেন।

নাবী (ﷺ) তখন বললেন- তাহলে আমি তা আল্লাহ্ ও আত্মীয়তার দোহাই দেয়ার কারণে ছেড়ে দিলাম। অতঃপর রসূল (ﷺ) এর পক্ষ হতে একজন ঘোষণাকারী এই বলে ঘোষণা করল যে, ছাকীফ গোত্রের কোন দাস যদি দুর্গ থেকে বের হয়ে আমাদের কাছে চলে আসে, তাহলে সে স্বাধীন। এই ঘোষণা শুনে দশাধিক ক্রীতদাস তাদের থেকে চলে আসল। তাদের মধ্যে ছিলেন আবু বাকরা (রাঃ) । রসূল (ﷺ) তাদের প্রত্যেককে এক একজন মুসলিমের হাওলা করে দিলেন। তারা যেন তাদের প্রতি খেয়াল রাখেন। তায়েফবাসীর জন্য এটি খুব পীড়াদায়ক ছিল। এরপরও রসূল (ﷺ) কে তায়েফ বিজয়ের অনুমতি দেয়া হয়নি। তাই তিনি মুসলিম বাহিনীকে ফেরত চলার আদেশ দিলেন। কিন্তু মুসলিমদের জন্য এটি মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে গেল। আমরা ফেরত যাব? অথচ এখনও তায়েফ বিজয় হয়নি। নাবী (ﷺ) তখন বললেন- তাহলে যাও। আগামিকাল লড়াই শুরু কর। সকাল বেলা লড়াই শুরু হল। এতে কতিপয় মুসলিম আহত হলেন। এবার তিনি বললেন- ইনশা-আল্লাহ্! আমরা আগামীকাল যাত্রা করব। এতে সাহাবীগণ খুব আনন্দিত হলেন এবং যাত্রা শুরু করতে তৎপর হয়ে উঠলেন। রসূল (ﷺ) তখন হাসতে লাগলেন। সফর শুরু হলে তিনি বললেন- তোমরা এই দু’আ পাঠ কর-

آيِبُونَ تَائِبُونَ عَابِدُونَ لِرَبِّنَا حَامِدُونَ

‘আমরা প্রত্যাবর্তনকারী, তাওবাকারী, আমাদের প্রভুর ইবাদতকারী এবং তাঁর প্রশংসাকারী’।[1] সাহাবীগণ তখন বললেন- হে আল্লাহর রসূল! আপনি ছাকীফ গোত্রের উপর বদ দু’আ করুন। নাবী (ﷺ) বললেন- হে আল্লাহ্! তুমি ছাকীফ গোত্রকে হিদায়াত দান কর এবং তাদেরকে অনুগত করে আমার কাছে নিয়ে এসো।

অতঃপর তিনি জিইর্রা নামক স্থানের দিকে বের হলেন। এখান থেকে ইহরাম বেঁধে উমরাহ করার জন্য মক্কায় প্রবেশ করলেন। উমরাহ থেকে ফারেগ হয়ে তিনি মদ্বীনায় ফেরত গেলেন।

রমযান মাসে যখন তিনি তাবুক থেকে ফেরত আসলেন, তখন রমযান মাসেই ছাকীফ গোত্রের প্রতিনিধি নাবী (ﷺ) এর কাছে আসল। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এই যে, তিনি যখন তায়েফ থেকে ফেরত আসলেন, তখন উরওয়া বিন মাসউদ তাঁর পিছনে রওয়ানা দিলেন। নাবী (ﷺ) মদ্বীনায় প্রবেশ করার পূর্বেই উরওয়া এসে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে ইসলাম কুবল করল। ইসলাম কবুল করার পর সে স্বীয় গোত্রের নিকট ফেরত যাওয়ার অনুমতি চাইল। নাবী (ﷺ) বললেন- তোমার জাতির লোকেরা সম্ভবতঃ তোমার সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হবে। কারণ তিনি তাদের অবস্থা দেখে অনুভব করেছিলেন যে, তাদের মধ্যে অহংকার এবং ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ রয়েছে। তাই তারা ইসলাম গ্রহণ করবে বলে মনে হয়না। উরওয়া বিন মাসউদ (রাঃ) বললেন- হে আল্লাহর রসূল! আমি তাদের নিকট তাদের নেতাদের চেয়েও অধিক প্রিয়। আসলেও উরওয়া তাদের নিকট অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। সুতরাং তিনি এই আশায় তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলেন যে, তাদের মাঝে তার মর্যাদার কারণে তারা তার বিরোধীতা করবেনা। এত প্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও তিনি যখন তাদের কাছে গেলেন এবং তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন তখন চতুর্দিক থেকে তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। একটি তীর এমনভাবে লাগল যে, এতে তিনি নিহত হলেন।

মুমূর্ষ অবস্থায় তাকে জিজ্ঞেস করা হল- তোমার রক্তপাত সম্পর্কে তোমার ধারণা কি? তিনি বললেন- আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে শাহাদাতের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। আমার মাঝে এবং যারা রসূল (ﷺ) এর সাথে শহীদ হয়েছে- তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সুতরাং তোমরা আমাকে তাদের সাথে দাফন কর।

লোকদের ধারণা রসূল (ﷺ) তার ব্যাপারে বলেছিলেন- স্বীয় গোত্রের সাথে তাঁর অবস্থা সেই রকমই হয়েছিল, যেমন হয়েছিল সূরা ইয়াসীনে বর্ণিত মুমিন ব্যক্তির অবস্থা তার গোত্রের সাথে। উরওয়া ইবনে মাসউদ শাহাদাত বরণ করার পর ছাকীফ গোত্র কয়েক মাস ইসলাম থেকে বিমুখ রইল। অতঃপর তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে বুঝতে পারল যে, চার পাশের ইসলাম গ্রহণকারী আরব গোত্রসমূহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মত শক্তি তাদের হাতে নেই। তাই তারা সিদ্বান্ত নিল যে, উরওয়া বিন মাসউদের ন্যায়ই তারা আরেকজন দূতকে রসূল (ﷺ) এর নিকট পাঠাবে। এ জন্য তারা আব্দে ইয়ালীলের সাথে কথা বলল। আব্দে ইয়ালীল এই প্রস্তাব অস্বীকার করল এবং আশঙ্কা করল যে, তাকে পাঠানো হলে তার সাথেও উরওয়া বিন মাসউদের ন্যায়ই আচরণ করা হতে পারে। কাজেই সে এই শর্তে যেতে রাজী হল যে, তার সাথে অতিরিক্ত লোক পাঠানো হোক। সুতরাং তারা বনী আহলাফ থেকে দুইজন এবং বনী মালেক থেকে তিনজন লোক আব্দে ইয়ালীলের সাথে প্রেরণ করল। তাদের মধ্যে উছমান আবীল আসও ছিল। মদ্বীনার নিকটবর্তী হয়ে তারা যখন একটি নদীর কিনারায় অবতরণ করল তখন মুগিরা ইবনে শুবার সাথে তাদের দেখা হল। মুগিরা ইবনে শুবা রসূল (ﷺ) এর কাছে বনী ছাকীফের আগমণের সংবাদ পৌঁছানোর জন্য দৌড়াতে লাগল। রাস্তায় আবু বকর (রাঃ) এর সাথে দেখা হলে তিনি মুগীরা (রাঃ) কে আল্লাহর শপথ দিয়ে বললেন, তুমি কখনই আমার আগে রসূল (ﷺ) এর কাছে প্রবেশ করবেনা। সুখবরটি আমিই রসূল (ﷺ) কে শুনাব। এতে মুগীরা থেমে গেলেন। আবু বকর (রাঃ) রসূল (ﷺ) এর দরবারে প্রবেশ করে ছাকীফ গোত্রের আগমণের কথা জানালেন। অতঃপর মুগীরা ইবনে শুবা (রাঃ) তাদের কাছে ফেরত গিয়ে যোহরের সময় তাদের সাথে রওয়ানা দিলেন। তাদের আগমণের সংবাদ শুনে নাবী (ﷺ) মসজিদের একপাশে একটি তাঁবু স্থাপন করলেন। এ সময় খালেদ বিন সাঈদ নাবী (ﷺ) এবং বনী ছাকীফ গোত্রের মাঝে পয়গাম বিনিময়ের কাজ করতেন। পরিশেষে তারা মুসলমান হয়ে গেল। ছাকীফ গোত্রের লোকেরা যে সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করল, তার মধ্যে ছিল-

১. তাদের লাত নামক মূর্তিটি তিন বছর পর্যন্ত রেখে দিতে হবে। এই সময়ের মধ্যে এটিকে ভাঙ্গা যাবেনা। যাতে করে এই গোত্রের মূর্খ লোকদের ক্ষতি থেকে বাঁচা যায়। নাবী (ﷺ) তাদের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। তারপরও তারা জোর দাবী করতে থাকল। নাবী (ﷺ) বরাবরই অস্বীকার করলেন। পরিশেষে তারা মাত্র একমাস রেখে দেয়ার অনুরোধ করলে নাবী (ﷺ) কোন মেয়াদেই তা রেখে দিতে অস্বীকার করলেন।

২. তাদের দাবী ছিল যে, তাদেরকে সলাত আদায় করা থেকে রেহাই দেয়া হোক এবং তাদের মূর্তিগুলো যেন তাদের হাতেই ভাঙ্গার আদেশ না করা হয়। নাবী (ﷺ) তখন বললেন- তোমাদের মূর্তিগুলো তোমাদের হাতে ভাঙ্গা হতে রেহাই দিলাম। তবে জেনে রাখো যেই দ্বীনের মধ্যে সলাত নেই, তাতে কোন কল্যাণ থাকতে পারেনা।

সুতরাং ছাকীফ গোত্রের লোকেরা যখন ইসলাম গ্রহণ করল তখন নাবী (ﷺ) উছমান বিন আবীল আসকে তাদের আমীর নিযুক্ত করলেন। তিনি তাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হলেও তার মধ্যে দ্বীনি জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ ছিল প্রবল।

সবশেষে তারা যখন নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার জন্য প্রস্ত্ততি নিল, নাবী (ﷺ) তখন তাদের সাথে আবু সুফিয়ান ও মুগীরা ইবনে শুবা (রাঃ) কে লাত নামক মূর্তিটি ভাঙ্গার জন্য পাঠালেন।

মুগীরা ইবনে শুবা যখন হাতিয়ার (কুঠার জাতিয় হাতিয়ার) হাতে নিয়ে মূর্তিটির ঘরে প্রবেশ করলেন। বনী মুগীছের লোকেরা তখন মুগীরাকে হেফাজতের জন্য তার চারপাশে ঘুরাফেরা করছিল। কারণ তাদের আশঙ্কা ছিল উরওয়ার মতই তাকেও তীর নিক্ষেপে হত্যা করা হয় কি না। আর বনী ছাকীফের মহিলারা মূর্তিটির জন্য বিলাপ শুরু করে দিল। তিনি মূর্তিটি ভেঙ্গে সেখানকার সমস্ত ধন-সম্পদ নিয়ে আসলেন।

উরওয়া ইবনে মাসউদ শাহাদাত বরণ করার সময় ছাকীফ গোত্রের প্রতিনিধি আসার পূর্বে আবু মুলাইহ বিন উরওয়া এবং কারেব বিন আসওয়াদ নাবী (ﷺ) এর কাছে আগমণ করেছিলেন। তারা উভয়েই ইসলাম কবুল করেছিলেন এবং ছাকীফ গোত্রের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ঘোষণা করেছিলেন। সেই সময় রসূল (ﷺ) তাদের উভয়কে বলেছিলেন- তোমরা যাকে ইচ্ছা বন্ধু বানাতে পার। জবাবে তারা বলেছিলেন- আমরা আল্লাহ্ এবং আল্লাহর রসূল ব্যতীত অন্য কাউকে বন্ধু বানাবোনা। রসূল (ﷺ) তখন বললেন- তোমাদের মামা আবু সুফিয়ান বিন হারবকেও বন্ধু বানিয়ে নাও। এতে তারা রাজী হয়ে বললেন- আমাদের মামা আবু সুফিয়ানের সাথেও আমরা বন্ধুত্বের সম্পর্ক রচনা করলাম।

তায়েফ বাসীরা যখন ইসলাম গ্রহণ করল, তখন আবু মুলাইহ ইবনে উরওয়া ইবনে মাসউদ রসূল (ﷺ) এর কাছে দাবী করল যে, লাত নামক মূর্তির ঘরে প্রাপ্ত সম্পদ থেকে তার পিতার ঋণ পরিশোধ করা হোক। রসূল (ﷺ) বললেন- হ্যাঁ, তাই করা হবে। তখন কারেব বিন আসওয়াদ বলল- হে আল্লাহর রসূল! আসওয়াদের ঋণও পরিশোধ করুন। আসওয়াদ ছিল উরওয়ার ভাই। নাবী (ﷺ) তখন বললেন- আসওয়াদ তো মুশরিক অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেছে। কারেব বলল- হে আল্লাহর রসূল! এই ঋণ পরিশোধ করা হলে একজন মুসলিমের আত্মীয়ের সাথে অনুগ্রহ করা হবে। এই কথার মাধ্যমে কারেব (রাঃ) নিজেকেই উদ্দেশ্য করেছিলেন। নাবী (ﷺ) বললেন- আমি এই ঋণ পরিশোধ করব। সুতরাং তিনি লাতের মন্দির থেকে প্রাপ্ত মাল থেকেই উরওয়া ও আসওয়াদের ঋণ পরিশোধ করলেন।

[1]. বুখারী তাও. হা/৫৯৬৮, মিশকাত হাএ. হা/২৪২০