উহুদ যুদ্ধ শেষে যখন মক্কার মুশরিকরা ফেরত গেল, তখন মুসলমানদের মুখে মুখে এ কথা বলাবলি হতে লাগল যে, মুশরেকরা পুনরায় মদ্বীনা আক্রমণের প্রস্ত্ততি নিচ্ছে। এই খবরটি তাদের কাছে খুব বিরাট কষ্টকর মনে হল। কেননা নাবী (ﷺ) আলী বিন আবু তালেবকে বলে রেখেছিলেন যে, তুমি খেয়াল রাখ, তাদের গতিবিধি লক্ষ্য কর এবং দেখ তারা কি করতে চায়। তারা ঘোড়া থেকে নেমে উটের উপর আরোহন করে তাহলে বুঝতে হবে যে, তারা মক্কায় চলে যাচ্ছে। আর যদি ঘোড়ায় আরোহন করে উটকে চালিয়ে নিয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে যে, তারা পুনরায় মদ্বীনা আক্রমন করবে। ঐ পবিত্র সত্তার শপথ! তারা যদি মদ্বীনা আক্রমণ করার ইচ্ছা করে, তাহলে অবশ্যই আমি মদ্বীনা থেকে বের হয়ে তাদের কাছে যাবো এবং তাদের মুকাবেলা করবো। আলী (রাঃ) বলেন- আমি তাদের সন্ধানে বের হলাম এবং তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করতে লাগলাম। তারা কি করতে যাচ্ছে তাও দেখতে লাগলাম। দেখলাম, তারা ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে উটের উপর আরোহন করে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে।

মক্কার মুশরিকরা যখন ফেরত যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করল, তখন আবু সফিয়ান মুসলমানদেরকে লক্ষ্য করে বলতে লাগল- আগামী বছর আমাদের ও তোমাদের মাঝে বদর প্রান্তরে মুলাকাত হবে। রসূল (ﷺ) তখন মুসলিমদেরকে লক্ষ্য করে বললেন- তোমরা বল হ্যাঁ, ঠিক আছে, আমরাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্ত্তত আছি। অতঃপর তারা চলতে লাগল।

কিছু দূর গিয়ে তারা পরস্পর বলাবলি করতে লাগল এবং তাদের একজন অন্যজনকে এই বলে দোষারোপ করতে লাগল- আমরা মুসলমানদেরকে দুর্বল করে দিয়েছি ঠিকই, কিন্তু তাদেরকে এমন অবস্থায় রেখে আসলাম যে, তারা দ্বিতীয়বার শক্তি জোগাড় করতে সক্ষম হবে। চল আবার ফেরত গিয়ে তাদের মূলোৎপাটন করে আসি। এই খবর রসূল (ﷺ) এর কাছে এসে পৌঁছলে তিনি মানুষের মাঝে ঘোষণা করে দিলেন যে, তোমরা পুনরায় জিহাদের জন্য প্রস্ত্তত হও। তিনি আরও বললেন- তবে আমাদের সাথে শুধু তারাই বের হবে, যারা উহুদ যুদ্ধে শরীক ছিল। মুসলমানেরা যে অবস্থায় ছিল, সে অবস্থাতেই তারা রসূলের ডাকে সাড়া দিল। এবার মুনাফেক সরদার আব্দুল্লাহ্ ইবনে উবাই বলল- আমিও কি বের হব? রসূল (ﷺ) বললেন- তোমার বের হওয়ার প্রয়োজন নেই। উহুদ যুদ্ধে জাবের (রাঃ) এর পিতা যেহেতু মারাত্মক আহত হয়েছিল তাই তিনি পিতার অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তার পাশে থেকে যাওয়ার অনুমতি চাইলে তাঁকে না যাওয়ার অনুমতি দেয়া হল।

যাই হোক মুসলমানগণ বের হয়ে হামরাউল আসাদ নামক স্থান পর্যন্ত পৌঁছে গেল। আবু সুফিয়ান তখন মদ্বীনাগামী এক মুশরিককে বলল- তুমি যদি আমাদের পক্ষ হতে মুহাম্মাদকে একটি পয়গাম পৌঁছিয়ে দিতে পার, তাহলে মক্কায় ফেরত আসার পর আমি তোমাকে তোমার বাহন বোঝাই কিসমিস প্রদান করব। লোকটি বলল- অবশ্যই পারব। এইবার আবু সুফিয়ান বলল- তাঁকে জানিয়ে দাও যে, আমরা মুসলমানদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়ার সিদ্বান্ত নিয়েছি। মুসলমানদের কাছে খবরটি পৌঁছার পর তারা বলল-ঃ

حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ فَانْقَلَبُوا بِنِعْمَةٍ مِنَ اللهِ وَفَضْلٍ لَمْ يَمْسَسْهُمْ سُوءٌ وَاتَّبَعُوا رِضْوَانَ اللهِ وَاللهُ ذُو فَضْلٍ عَظِيمٍ

‘‘আমাদের জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট; তিনি কতই না চমৎকার কর্মসম্পাদনকারী। অতঃপর ফিরে এল মুসলমানরা আল্লাহর অনুগ্রহ নিয়ে, তাদের কিছুই অনিষ্ট হল না। তারপর তারা আল্লাহর ইচ্ছার অনুগত হল। বস্ত্ততঃ আল্লাহর অনুগ্রহ অতি বিরাট’’।[1]

উহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসের সাত তারিখ শনিবার। যুদ্ধ শেষে নাবী (ﷺ) মদ্বীনায় ফেরত আসলেন। বছরের বাকী দিনগুলো তিনি মদ্বীনাতেই কাটালেন। নতুন বছরের মুহার্রাম মাসের চাঁদ উদিত হওয়ার পর রসূল (ﷺ)-এর কাছে সংবাদ পৌঁছল যে, খুওয়াইলিদের দুই ছেলে তুলাইহা এবং সালামা নিজেদের গোত্র এবং বনী আসাদ গোত্রকে নাবী (ﷺ) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য একত্রিত করছে। এই সংবাদ পেয়ে নাবী (ﷺ) আনসার ও মুহাজিরদের থেকে ১৫০ জন সাহাবীকে প্রেরণ করলেন। সাহাবীগণ শত্রুদের এলাকায় গিয়ে কিছু ছাগল ও উট গণীমত হিসাবে অর্জন করলেন। কিন্তু কোন প্রকার যুদ্ধ ছাড়াই গণীমতের মালসহ মদ্বীনায় ফেরত আসলেন।

মুহার্রাম মাসের ৫ তারিখে নাবী (ﷺ) জানতে পারলেন যে, খালিদ বিন সুফিয়ান আল-হুযালী রসূল (ﷺ) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সৈন্য সংগ্রহ করছে। তাই তিনি আব্দুল্লাহ্ বিন আনীসকে তাদের দিকে পাঠালেন। আব্দুল্লাহ্ তাকে হত্যা করে ফেললেন।

সফর মাসে ‘আযাল’ এবং ‘কারা’ গোত্রের একদল লোক নিজেদেরকে মুসলমান হিসাবে প্রকাশ করল। তারা রসূল (ﷺ) এর কাছে আবেদন করল যে, আমাদের কাছে এমন কিছু সাহাবীকে পাঠান, যারা আমাদেরকে দ্বীন ও কুরআন শিক্ষা দিবে। নাবী (ﷺ) তাদের সাথে মারছাদ বিন আবী মারছাদ আলগানামীর নেতৃত্বে ছয়জন সাহাবীকে পাঠিয়ে দিলেন। তাদের মধ্যে খুবাইব (রাঃ) ছিলেন। তারা যেহেতু ছদ্মবেশী ছিল তাই তারা সাহাবীদের অধিকাংশকেই হত্যা করে ফেলল। খুবাইব বিন আদী এবং যায়েদ বিন দাছিনা (রাঃ) কে বন্দী করে নিয়ে গেল এবং মক্কাবাসীদের কাছে বিক্রি করে দিল। মক্কার লোকেরা তাদেরকেও নির্মমভাবে হত্যা করে।

[1]. সূরা আল-ইমরান-৩: ১৭৩-১৭৪