সিয়াম তথা সিয়াম রাখার ক্ষেত্রে নাবী (সাঃ) এর হিদায়াত

সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্য হল কুপ্রবৃত্তির চাহিদা থেকে আত্মাকে রক্ষা করা। যাতে সে পরিপূর্ণ শান্তি ও সৌভাগ্য লাভে ধন্য হয়, পরকালীন চিরস্থায়ী জীবনের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে, ক্ষুধা ও পিপাসা যেন নফসের চাহিদাকে কমিয়ে দেয়, ফকীর-মিসকীনদের ক্ষুধার্ত থাকার জ্বালা যেন অনুভব করে, এবং বান্দা পানাহার কমিয়ে দেয়ার মাধ্যমে যেন শরীরের রগে রগে শয়তানের চলাচলের পথকে সংকীর্ণ করতে পারে। সুতরাং সিয়াম হচ্ছে মুত্তাকীদের লাগাম (পাপ কাজ থেকে তাদেরকে বিরত রাখার হাতিয়ার), মুজাহিদদের ঢাল (পাপের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার যন্ত্র) এবং সৎকর্মশীলদের অনুশীলন। বান্দার আমলসমূহ থেকে এটি কেবল আল্লাহর জন্যই হয়ে থাকে। কেননা সায়িম আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় পানাহার ও যৌন সম্ভোগ ছেড়ে দেয়। সে আল্লাহর ভালবাসার কারণেই প্রিয় বস্ত্তসমূহ ত্যাগ করে । সিয়ামর মাধ্যমে আল্লাহ্ ও বান্দার মধ্যে এক গোপন সম্পর্ক তৈরী হয়। কেননা বান্দাগণ বাহ্যিক দৃষ্টিতে সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয়গুলো (পানাহার ও যৌন সম্ভোগ) ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি জানতে পারে। কিন্তু তার মাবুদের সন্তুষ্টির জন্য ছেড়ে দিয়েছে কি না, তা কোন মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। এটিই হচ্ছে সিয়ামর হাকীকত (গোপন রহস্য)।

বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পাপ কাজ থেকে রক্ষায়, অপকর্মের দিকে ধাবিত হওয়া থেকে আভ্যন্তরীন শক্তিকে হেফাজতের ক্ষেত্রে এবং শরীরকে সকল খারাপ অভ্যাস থেকে পবিত্র করতে সিয়ামর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। এটি হচ্ছে তাকওয়া অর্জনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

‘‘হে ঈমানদারগণ তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে যেমনভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যাতে করে তোমারা আল্লাহ ভীরু (মুত্তাকী) হতে পার।[1]

যে ব্যক্তির যৌন চাহিদা খুব প্রবল তাকে তিনি বিবাহ করার আদেশ দিয়েছেন। আর যার যৌন চাহিদা আছে, কিন্তু সে আর্থিকভাবে সক্ষম নয়, তাকে তিনি সিয়াম রাখার আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন- সিয়াম শাহওয়াত তথা অতিরিক্ত যৌন ক্ষুধা ও চাহিদাকে কমিয়ে ফেলে।

সিয়ামর ক্ষেত্রে তাঁর সুন্নাত হচ্ছে সবচেয়ে অধিক সুন্দর ও পরিপূর্ণ একটি সুন্নাত এবং জান্নাত অর্জনের সবচেয়ে বড় একটি মাধ্যম। তা পালন করাও খুব সহজ। আর নফসের চাহিদা ও দাবী থেকে বিরত থাকা যেহেতু খুব কঠিন, তাই হিজরতের পর তথা বিলম্বে এটিকে ফরয করা হয়েছে। প্রথমে সিয়াম রাখা বা না রাখার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল। কেউ রোযা না রাখতে চাইলে প্রতিদিন একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করত। পরবর্তীতে এ আদেশ রহিত করে তা বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়। সিয়াম রাখার শক্তি না রাখলে তিনি শাইখে কাবীর তথা অতি বৃদ্ধ-বৃদ্ধার উপর সিয়াম রাখার পরিবর্তে খাদ্য দান করাকে আবশ্যক করেছেন। অসুস্থ ও মুসাফিরের জন্য সিয়াম ভাঙ্গার অনুমতি দিয়েছেন। তারা পরবর্তীতে ছেড়ে দেয়া সিয়ামগুলো সমান সংখ্যায় কাযা করে নিবে। গর্ভবতী ও স্তন্যদায়ী মহিলাগণ যদি নিজেদের স্বাস্থ্যের ক্ষতির আশঙ্কা করে, তাহলে তাদের জন্যও সিয়াম ভঙ্গ করা জায়েয। তারা পরবর্তীতে কাযা করে নিবে। আর এই শ্রেণীর মহিলাগণ যদি নিজেদের সন্তানের ক্ষতির ভয় করে তাহলে সিয়াম ছাড়তে পারে। তবে তারা কাযা করার সাথে সাথে প্রতিদিনের বিনিময়ে একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করবে। কেননা তারা অসুস্থতার আশঙ্কায় সিয়াম ভঙ্গ করে নি; বরং তারা স্বাস্থ্য ভাল থাকা সত্ত্বেও তা ভঙ্গ করেছে। সুতরাং মিসকীনকে খাদ্য প্রদান করার মাধ্যমে সেই ক্ষতি পূর্ণ করবে। আর এটি ইসলামের প্রথম যুগে সুস্থ ব্যক্তির সিয়াম ভঙ্গ করে মিসকীনকে খাদ্য প্রদান করার মতই।

নাবী (ﷺ) রমযান মাসে বেশী পরিমাণে বিভিন্ন প্রকার ইবাদতে লিপ্ত থাকতেন। জিবরীল ফিরিস্তা রমযান মাসে তাকে কুরআন পড়ে শুনাতেন। এই মাসে তিনি প্রচুর সাদকাহ করতেন, মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করতেন, বেশী করে কুরআন তেলাওয়াত করতেন, অধিক পরিমাণ সলাত আদায় করতেন, যিকিরে মশগুল থাকতেন এবং ইতেকাফ করতেন।

তিনি রমযান মাসে যত ইবাদত করতেন তার তুলনায় অন্য মাসে তা করতেন না। তাতে তিনি কখনও পানাহার ছেড়ে দিয়ে দিনরাত ইবাদতে লিপ্ত থাকতেন। কিন্তু তাঁর সাহাবীদেরকে তিনি এভাবে পানাহার ছেড়ে দিয়ে ইবাদতে মশগুল থাকতে নিষেধ করেছেন।

তাঁকে যখন বলা হল আপনিও তো পানাহার ছেড়ে দিয়ে একাধারে কয়েকদিন পর্যন্ত ইবাদতে মশগুল থাকেন তখন তিনি বললেন- আমার অবস্থা তোমাদের মত নয়। আমার প্রভু আমাকে পানাহার করান।[2]

[1]. সূরা আল-বাকারা-০২:১৮৩

[2]. বুখারী, অধ্যায়ঃ সিয়াম।