কুরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে নাবী (সাঃ) এর হিদায়াত

নাবী (ﷺ) প্রতিদিন কুরআন থেকে নির্ধারিত একটি পরিমাণ তিলাওয়াত করতেন। কখনই তিনি এর ব্যতিক্রম করেন নি। তিনি তারতীলের সাথে কুরআন পাঠ করতেন। প্রত্যেকটি অক্ষর তার নিজস্ব মাখরাজ (উচ্চারণের স্থান) থেকে সুস্পষ্ট করে উচ্চারণ করতেন এবং প্রতিটি আয়াত পাঠ শেষে ওয়াক্ফ করতেন (বিরতি গ্রহণ করতেন)। তিলাওয়াতের সময় হরফে মদ্ আসলে লম্বা করে পড়তেন। উদাহরণ স্বরূপ তিনি الرحمن الرحيم পাঠ করার সময় মদ-&এর সাথে পড়তেন। তিলাওয়াতের শুরুতে তিনিأَعُوذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ পাঠ করতেন। কখনও তিনি এই দু’আটি পাঠ করতেন-

أَعُوذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ مِنْ هَمْزِهِ وَنَفْخِهِ وَنَفْثِهِ

‘‘আমি বিতারিত শয়তান, তার ধোঁকা, ফুঁক ও তার যাদু থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাচ্ছি’’।[1] তিনি অন্যের কাছ থেকে কুরআন তিলাওয়াত শুনতে পছন্দ করতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদকে রসূল (ﷺ) কুরআন তিলাওয়াত করার আদেশ দিতেন। তিনি তাঁর সামনে কুরআন পড়তেন। নাবী (ﷺ) তা শুনতেন। এ সময় তাঁর অন্তরের অবস্থা ও একাগ্রতা এমন হত যে, তাঁর উভয় চোখ থেকে অশ্রম্ন প্রবাহিত হত।[2] তিনি দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। ওযূ ছাড়াও তিনি কুরআন পাঠ করতেন। তবে স্ত্রী সহবাস জনিত কারণে অপবিত্র হলে পবিত্রতা অর্জন না করে কুরআন পড়তেন না। তিনি আওয়াজ উঁচু করে সুন্দর সুর দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুগাফ্ফাল লম্বা আওয়াজে তাঁর সামনে কুরআন তিলাওয়াত করার ধরণটি আ-আ-আ (তিনবার) বলার মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারী এরূপই বর্ণনা করেছেন।[3] আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুগাফ্ফাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত ধরণটি যদি রসূল (ﷺ) এর বাণী-

زَيِّنُوا الْقُرْآنَ بِأَصْوَاتِكُمْ

‘‘তোমাদের আওয়াজের মাধ্যমে কুরআনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি কর। অর্থাৎ তোমরা সুন্দর আওয়াজের মাধ্যমে কুরআন পড়’’।[4] এবং তাঁর বাণীঃ

مَا أَذِنَ اللهُ لِشَىْءٍ مَا أَذِنَ لِنَبِىٍّ حَسَنِ الصَّوْتِ يتغنى بِالْقُرْآنِ

‘‘আল্লাহ্ তা‘আলা সুন্দর কন্ঠের অধিকারী নাবীর কাছ থেকে সুন্দর স্বরে কুরআন তিলাওয়াত যেমনভাবে শুনেন অন্য কোন বস্ত্তকে সে রকমভাবে শ্রবণ করেন না’’[5] এই দুইটি হাদীসকে একত্রিত করলে বুঝা যায় যে, তিনি ইচ্ছা করেই কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজকে উঁচু ও সুন্দর করতেন। নিছক উট চালানোর জন্য স্বীয় আওয়াজ উঁচু করেন নি। বরং কুরআন তিলাওয়াতে তাঁর অনুসরণ করার জন্যই তা করেছেন। অন্যথায় আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুগাফাফাল (রাঃ) কুরআন তিলাওয়াতে তাঁর আওয়াজ উঁচু ও সুন্দর করার ধরণ বর্ণনা করে দেখাতেন না। কুরআন তিলাওয়াতে আওয়াজ উঁচু ও সুন্দর করা দু’ভাবে হতে পারে।

১. কোন প্রকার কৃত্রিম প্রচেষ্টা ছাড়াই স্বাভাবিকভাবে যা হয়ে থাকে এবং স্বাভাবিক আওয়াজের সাথে যদি অতিরিক্ত সৌন্দর্য্য যোগ করা হয় তাতে কোন অসুবিধা নেই। কেননা আবু মুসা আশআরী নাবী (ﷺ) কে লক্ষ্য করে বলেছেন-

لَوْ عَلِمْتُ أنَّكَ تَسْتَمِعُ لَحَبَّرْتُهُ لَكَ تَحْبِيرًا

‘‘হে আল্লাহর রসূল! আমি যদি জানতাম যে আপনি আমার কুরআন তিলাওয়াত শ্রবণ করছেন, তাহলে আমি আরও সুন্দর কন্ঠে তা পাঠ করতাম। সালাফগণ এভাবেই কুরআনকে সুন্দর সুরে পাঠ করতেন। এ ব্যাপারে বর্ণিত দলীলগুলো উপরোক্ত অর্থেই প্রয়োগ করতে হবে।

২. সুন্দর সুরে কুরআন পাঠ করার দ্বিতীয় পদ্ধতি হচ্ছে যা শিল্পীদের তৈরী। যেমন বর্তমানে গানের বিভিন্ন সুর দ্বারা কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা দেয়া হয়। সালাফগণ এই পদ্ধতিকে অপছন্দ করেছেন। যে সমস্ত হাদীছে সুর দিয়ে কুরআন পড়াকে অপছন্দনীয় বলা হয়েছে, তা দ্বারা এই শেষোক্ত পদ্ধতিটিই উদ্দেশ্য; প্রথমটি নয়।

[1]. মুসনাদে আহমাদ, (৪/৮০) আবু দাউদ, হা/৭৬৪, ইবনে মাজাহ, হা/৮০৭। ইমাম ইবনে হিববান ও হাকেম সহীহ বলেছেন। আর ইমাম যাহাবী তা সমর্থন করেছেন।

[2]. সহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ কুরআনের ফজীলত।

[3]. সহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ কুরআনের ফজীলত।

[4]. আবু দাউদ, অধ্যায়ঃ কিতাবুস্ সালাত। আবু দাউদ, আলএ. হা/১৪৬৪, ইমাম আলবানী রহঃ) হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, সিলসিলায়ে সহীহা, হা/ ৭৭১।

[5]. বুখারী, অধ্যায়ঃ ফাজায়েলুল কুরআন তাও. হা/৭৫৪৪, মিশকাত, হাএ. হা/২১৯৩