নববধূ যখন সংসারে আসে তখন সে একেবারে অপরিচিতা অনভিজ্ঞা থাকে। সাংসারিক কাজে থতমত খাওয়া তার স্বাভাবিক। কোন কাজ ঠিকভাবে না পারাটাই প্রকৃতি। কারণ সকলে মায়ের বাড়ি থেকে পাকা গিন্নী হয়ে শ্বশুরালয় আসতে পারে না, তাছাড়া শিক্ষিতা হলে তো মোটেই না। কারণ, তার অধিকাংশ সময় শিক্ষালাভেই ব্যয় হয়ে থাকে। তাই শাশুড়ী-ননদের উচিৎ, তা মেনে নিয়ে নববধূকে স্নেহের সাথে কাজ শিক্ষা দেওয়া, সংসার বুঝিয়ে দেওয়া। কাঁধে জোঁয়াল দিলেই যে সব গরু গাড়ি টানবে--তা নয়। অতএব নববধূর প্রতি কোন প্রকার ভৎর্সনা, কটাক্ষ ও ব্যঙ্গোক্তি প্রয়োগ করা এবং এ নিয়ে তার সামনে তার মা-বাপকে গঞ্জনা দেওয়া মানবিক খাতিরেও উচিৎ ও বৈধ নয়।

তাছাড়া নববধূ বাড়িতে এলে তাকে নিজের মেয়ে বলে মনে করা শ্বশুর-শাশুড়ীর কর্তব্য। ‘বেটা দাসী এনেছে’ মনে করা হীন লোকেদের পরিচয়। পরন্তু এই সময় তার কর্মক্ষমতা, কর্মপটুতা ও কর্মনিপুণতা দেখার সময় নয়। প্রথমতঃ দেখার সময় ও বিষয় হল বেটা-বউয়ের প্রেম, তাদের মনের মিল। হৃদয়ের আদান-প্রদানের সুযোগ দিয়ে তাদের মধ্যে প্রগাঢ় ভালোবাসা এলে তবে অন্য কিছু বিচার্য। নচেৎ ঘর ঢুকতেই চালে মাথা লাগলে নববধূ সবভাবতঃই ঘাবড়ে যাবে। আর এর জন্য দায়ী হবে বাড়ির কর্ত্রী।

প্রীতিহীন সংসারে বধূনির্যাতন চলে। যেখানে স্বামী তার পৌরুষ খেয়ে বসে। কেউ ভালো না বাসলেও যদি স্বামীই কেবল ভালোবাসে, তাহলেও কোন প্রকার চোখ বুজে সহ্য করে সুদিনের আশা করা যায়। কিন্তু তার কাছেও নিরাশ হলে স্ত্রীর আর কোন্ পথ খোলা থাকে? সকল পথ বন্ধ দেখে অবশেষে পাপ ও আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।

শ্বশুর-শাশুড়ীর খিদমত বধূ সাধ্যমত করবে। কিন্তু সময় ও পরিস্থিতি না বুঝেই খিদমতের (গায়ে তেল, পায়ে তেল নেওয়ার) আকাঙক্ষা ও তা একান্ত অধিকার মনে করে থাকলেই কলহের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে আসে।

স্বামীর হৃদয়ে স্ত্রীর আসন পৃথক। পিতা-মাতার আসন ভিন্ন। সকলকে সব-সব অধিকার প্রদান করতে পুরুষকে পৌরুষের বড় কঠোর পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। স্ত্রীর কথা নিয়ে যেমন মা-বাপের উপর খামাখা খাপ্পা হওয়া বৈধ নয়, তেমনিই মা-বাপের কথা শুনে স্ত্রীর উপর নাহক অত্যাচার বৈধ নয়। এই উভয় সঙ্কটের ঘূর্ণাবর্তে পুরুষকে নিজের বিবেক এবং শরীয়তের সাহায্য নিতে হয়। গোপনে স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে মা-বাপের (দোষ হলেও) তাদের বাহ্যতঃ বাধ্য হয়ে থাকাই শ্রেয়ঃ। তবে একান্ত সীমাহীন পরিস্থিতিতে শরীয়তই এর ফায়সালা দিতে পারে। মা-বাপের কথামত চলা ফরয হলেও, নাহক বা অবৈধ নির্দেশমত চলা হারাম। অকারণে স্ত্রীকে তালাক দিতে বললে তাদের কথা মেনে তালাক দেওয়া মা-বাপের খিদমত ও আনুগত্যের পর্যায়ভুক্ত নয়।[1]

কতক মা-বাপ আছে, যারা তাদের ছেলে তার স্ত্রীকে ভালোবাসুক---তা চায় না। পক্ষান্তরে ঐ ভালোবাসাই আবার নিজেদের মেয়ের জন্য তাদের জামাইয়ের নিকট থেকে আশা করে। অতএব বিনা দোষে নিছক হিংসায় ‘দেখতে লারি চলন বাঁকা’ বলে স্ত্রীকে তালাক দিতে বললে ছেলের সে হুকুম মানা বৈধ নয়। উভয়কে রাজী ও শান্ত করা তার কর্তব্য।

এক ব্যক্তি ইমাম আহমদের নিকট এসে বলল, ‘আমার বাপ আমাকে আমার স্ত্রী তালাক দিতে আদেশ করছে, আমি কি করব?’ তিনি বললেন, ‘তালাক দিও না।’ লোকটি বলল, ‘হযরত উমার তাঁর ছেলে ইবনে উমারকে তাঁর স্ত্রী তালাক দিতে বললে আল্লাহর রসূল (ﷺ) তাঁকে (ইবনে উমারকে) তালাক দিতে আদেশ করেননি কি?’ ইমাম আহমদ বললেন, ‘তোমার বাপও কি উমারের মত?’ কারণ, উমার (রাঃ) কারো প্রতি যুলুম করবেন---তা কল্পনার বাইরে। হয়তো তিনি ঐ মেয়েটির ব্যাপারে এমন কিছু জানতেন যার কারণে তালাক দেওয়া জরুরী ছিল। তাই নবী (ﷺ) ইবনে উমারকে তাঁর পিতার কথা অনুসারে তালাক দিতে আদেশ করেছিলেন। সুতরাং স্ত্রীর সবভাব মন্দ হলে অবশ্যই মা-বাপের কথায় তালাক দিতে হবে।[2]

অনুরূপ বলা যায় হযরত ইবরাহীম (আঃ)এর তাঁর পুত্র ইসমাঈলকে দরজার চৌকাঠ বদলাতে আদেশ করার ব্যাপারেও।

সুপুরুষ সংসারে বিবেক নিয়ে চলে। অতএব ‘বোন ভাত পায় না, আর শালীর পাতে মোন্ডা’ দেওয়া তার উচিৎ নয়। পক্ষান্তরে স্ত্রীর দুর্নাম রটলে তাতে কোন বিচার-বিবেচনা না করেই তার ও তার আত্মীয়র প্রতি খাপ্পা হওয়াও উচিৎ নয়। সমস্ত সামঞ্জস্য বজায় রেখে তাকে সংসার-তরী আগে বেয়ে নিয়ে যেতে হয়। বিশেষ করে ‘বউ ভাঙ্গলে সরা, হবে পাড়া পাড়া, আর গিন্নী ভাঙ্গলে নাদা, ও কিছু নয় দাদা’ কথার খেয়াল রেখে এমন উপায় অবলম্বন করবে; যাতে ‘সাপও মরে এবং লাঠিও না ভাঙ্গে।’ কিন্তু হায়! যেখানে বিবেক বিবেকের কদর করে না, সেখানে আর কি আশা করা যাবে?

বাড়ির কথা বাইরে গেলেই বিপত্তি অধিক বেড়ে যায়। হিংসুটে শাঁকচুন্নীদের পরামর্শে বা কান-ভাঙানিতে শাশুড়ীর মন বিষ হয়ে উঠে। বেপর্দা পরিবেশেই এমন পরিস্থিতি অধিকতর সৃষ্টি হয়ে থাকে।

বিভিন্ন উপন্যাস ও রূপকথার প্রেমকাহিনীতে যে কাল্পনিক প্রেম ও ভালোবাসার বর্ণনা পাওয়া যায় স্বামী-স্ত্রী বা শ্বশুর-শাশুড়ী পরস্পরের নিকট থেকে সেরূপ আশা করলে অবশ্যই মন আঘাত পাবে; যা মহাভুল। কারণ, কাল্পনিক প্রেম কেবল কল্পনা ও খেয়ালের জগতে মানুষের মানসপটেই বিচরণ করে। বাস্তবজগতে তার কোন অস্তিত্ব ও উদাহরণই নেই, আর থাকলেও তা বিরল।

পক্ষান্তরে সংসারে কলহ হয় অভাবে, নচেৎ সবভাবে। দরজা দিয়ে সংসারে অভাব প্রবেশ করলে জানালা দিয়ে প্রেম-প্রীতি-স্নেহ-মমতা সব লুকিয়ে পলায়ন করে। অর্থ থাকলে বন্ধু অনেক হয়, প্রীতির উপর প্রীতির গীতি কানে ঝালা ধরায়। কিন্তু অভাব দেখা দিলেই স্বাই আপন রাস্তা ধরে। মা-বাপ, ভাই-বন্ধু এমন কি শেষে স্ত্রীও ‘ছাড়ব-ছাড়ব’ হয়। এমন না হলে সবভাবগুণেই একে অপরের প্রতি দোষারোপ করে কলহ বাধিয়ে থাকে।

আড়ি পাতা (অভিমান করা) মেয়েদের এক সহজাত কু-অভ্যাস। এতে তাদের কেউ কারো খাতির করে না। প্রয়োজনমত শাসন বা সোহাগ না পেলে এরা মাথায় উঠে গিয়ে সর্বনাশ আনে। এ সমস্যার সমাধানও পুরুষ নিজের পৌরুষ দ্বারা করতে পারে। কিন্তু যে শাসনাধীনা নয় তাকে মাথা থেকে নামাবে কে? আল্লাহর ভয় না থাকলে সংসারে শান্তির বিহঙ্গ স্থায়ী নীড় বাঁধবে কিভাবে? তাছাড়া কথাতেই আছে ‘পীর মানে না গাঁয়ে, পীর মানে না মায়ে। পীর মানে না গরুতে, পীর মানে না জরুতে।’ সুতরাং গরুর মত বিবেকের মাথা খাওয়া ছাড়া সম্মানার্হের সাথে অপমানের আচরণ করা সহজ নয়।

ভালোবাসা এমন এক বস্ত্ত যা জাত-পাত মানে না, শত্রুতা মানে না। প্রেমিকার পিতা ঘোর শত্রু হলেও প্রেমিক তাকে বর্জন করতে পারে না। প্রাণের বদলেও তাকে উদ্ধার করে আনে। তাই তো শ্বশুরবাড়ির কারো সাথে কলহ করে অথবা শ্যালক তথা ভগ্নিপতি অথবা তার বাড়ির লোক বোনকে জবালায় বলে নিজেদের স্ত্রীর উপর যারা প্রতিশোধমূলক নির্যাতনের রুলার চালায় তারা নিশ্চয়ই নীরস প্রাণের প্রেমহীন স্বামী; যারা প্রেমের মর্ম ও মূল্য সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ অথবা উদাসীন।

‘‘চেনে তাহা প্রেম, জানে শুধু প্রাণ-

কোথা হতে আসে এত অকারণে প্রাণে-প্রাণে বেদনার টান।’’

তাছাড়া বিবেকহীনতার প্রতিশোধে বিবেকহীনতা নয় বরং বিবেক ব্যবহার করলেই সাফল্য লাভ হয়।

স্বামী ভালো হলে এবং শ্বশুর-শাশুড়ী ভালো না হলেও স্বামী-সুখের জন্যই ধৈর্যের সাথে মহিলার সংসার করা উচিৎ। কারণ, ‘ স্বামী-সুখে বনবাস।’ স্বামীর সুখ থাকলে বনেও বাস করতে সতীর দ্বিধা নেই। নচেৎ স্বামী উদাসীন হলে তার স্ত্রী বিধবার মত জীবন-যাপন করে।

পরিশেষে একটি কথা সংসারের সকলকে খেয়ালে রাখা উচিৎ যে,

‘আছে এমন পূর্বাপর সকল ঘরে কথান্তর,

তাতে কি কেউ হয় গো পর?

নিত্যি কিত্যি নিত্যি লেঠা গৃহধর্মের ধর্ম সেটা,

ভালোমন্দ হয় কথাটা-

তা শুনলে কি চলে ঘর?’

[1] (ফাতাওয়াল মারআতিল মুসলিমাহ ২/৭৫৬)

[2] (ফাতাওয়াল মারআতিল মুসলিমাহ ২/৭৫৫-৭৫৬)