তাওয়াফের পূর্বে পবিত্রতা জরুরি। কেননা আপনি আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করতে যাচ্ছেন যা পৃথিবীর বুকে পবিত্রতম জায়গা। বিদায় হজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)প্রথমে ওজু করেছেন, তারপর তাওয়াফ শুরু করেছেন। [1] আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)যেভাবে হজ্জ করেছেন আমাদেরকেও তিনি সেভাবেই হজ্জ করতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘خذوا عنى مناسككم - আমার কাছ থেকে তোমাদের হজ্জকর্মসমূহ জেনে নাও।’[2] ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত এক হাদিসে তাওয়াফকে সালাতের তুল্য বলা হয়েছে। পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, আল্লাহ তা’আলা এতে কথা বলা বৈধ করে দিয়েছেন, তবে যে কথা বলতে চায় সে যেন উত্তম কথা বলে।[3] এহরাম অবস্থায় আয়েশা (রাঃ) এর ঋতুস্রাব শুরু হলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)তাঁকে তাওয়াফ করতে নিষেধ করে দেন।[4] এ হাদিসও তাওয়াফের সময় পবিত্রতার গুরুত্বের প্রতিই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সে কারণেই ইমাম মোহাম্মদ ও ইমাম আবু ইউসুফ ওজু অবস্থায় তাওয়াফ করাকে ওয়াজিব বলেছেন।[5]

তাওয়াফের সময় সতর ঢাকাও জরুরি। কেননা জাহেলি-যুগে উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফ করার প্রথাকে বন্ধ করার জন্য পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে,

يَا بَنِي آَدَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ.

- হে বনী আদম, প্রত্যেক সালাতের সময় তোমরা সৌন্দর্য অবলম্বন করো।[6] ইবনে আব্বাস (রাঃ) সৌন্দর্য অর্থ পোশাক বলেছেন। এক হাদিস অনুযায়ী তাওয়াফও একপ্রকার সালাত তা পূর্বেই উল্লেখ হয়েছে। তাছাড়া ৯ হিজরীতে, হজ্জের সময় পবিত্র কাবা তাওয়াফের সময় যেন কেউ উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফ না করে সে মর্মে ফরমান জারি করা হয়।[7]

তাওয়াফের শুরুতে নিয়ত করা বাঞ্ছনীয়। তবে সুনির্ধারিতভাবে নিয়ত করতে হবে না। বরং মনে মনে এরূপ প্রতিজ্ঞা করলেই চলবে যে আমি আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করতে যাচ্ছি। অনেক বই-পুস্তকে তাওয়াফের যে নিয়ত লেখা আছে-আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদু তাওয়াফা বায়তিকাল হারাম ফা য়াস্সিরহু লি ওয়া তাকাববালহু মিন্নি—হাদিসে এর কোনো ভিত্তি নেই।

সাত চক্করে তাওয়াফ শেষ করা উচিৎ। চার চক্করে তাওয়াফ শেষ করা কখনো উচিৎ নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)সাহাবায়ে কেরাম, তাবেইন, তাবে-তাবেইনদের মধ্যে কেউ চার চক্করে তাওয়াফ শেষ করেছেন বলে হাদিস ও ইতিহাসে নেই।

তাওয়াফ হজ্জরে আসওয়াদ থেকে শুরু করে হাজরে আসওয়াদ বরাবর এসে শেষ করতে হবে। কেউ যদি হজ্জরে আসওয়াদের বরাবর আসার একটু পূর্বেও তাওয়াফ ছেড়ে দেয় তাহলে তার তাওয়াফ শুদ্ধ বলে গণ্য হবে না।

তাওয়াফ করার সময় রামল ও ইযতিবা

কোন কোন তাওয়াফে রামল ও ইযতিবা আছে তা নিয়ে ফেকাহবিদদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। উমরার তাওয়াফ ও কুদুমের তাওয়াফেই কেবল ইযতিবা আছে, এটাই হল বিশুদ্ধ অভিমত। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এ দু’ধরনের তাওয়াফে রমল ও ইযতিবা করেছেন।[8] হানাফি মাজহাব অনুসারে যে তাওয়াফের পর সাফা-মারওয়ার সাঈ আছে সে তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে রমল ও পুরা তাওয়াফে ইযতিবা আছে।

নারীর তাওয়াফ

নারী অবশ্যই তাওয়াফ করবে। তবে পুরুষদের সাথে মিশ্রিত হয়ে নয়। যখন ভিড় কম থাকে তখন নারীদের তাওয়াফ করা বাঞ্ছনীয়। অথবা, একটু সময় বেশি লাগলেও দূর দিয়ে নারীরা তাওয়াফ করবে। পুরুষের ভিড়ে নারীরা হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করতে যাবে না। আয়েশা (রাঃ) এর তাওয়াফের ব্যাপারে হাদিসে এসেছে—

كانت عائشة رضى الله عنها تطوف حجرة من الرجال ، لا تخالطهم ، فقالت امرأة: انطلقى نستلم يا أم المؤمنين . قالت: انطلقي -- عنك ، وأبت .

-আয়েশা (রাঃ) পুরুষদের একপাশ হয়ে একাকী তাওয়াফ করতেন। পুরুষদের সাথে মিশতেন না। এক মহিলা বললেন: চলুন, হাজরে আসওয়াদ চুম্বন-স্পর্শ করি। তিনি বললেন, তুমি যাও—আমাকে ছাড়। তিনি যেতে অস্বীকার করলেন।[9]

ঋতুস্রাব অবস্থায় নারীরা তাওয়াফ করবে না। প্রয়োজন হলে হজ্জের সময়ে ঋতুস্রাব ঠেকানোর জন্য ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে, ব্যবহার করার বৈধতা রয়েছে। তাওয়াফের সময় নারীর জন্য কোনো রামল বা ইযতিবা নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)নারীকে রামল ইযতিবা করতে বলেননি।

হজ্জের ফরজ তাওয়াফের সময় যদি কারও ঋতুস্রাব চলে আসে এবং ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়া পর্যন্ত মক্কায় অবস্থান করা কোনো ক্রমেই সম্ভব না হয়, পরবর্তীতে এসে ফরজ তাওয়াফ আদায় করারও কোনো সুযোগ না থাকে, এমন পরিস্থিতিতে বিজ্ঞ ওলামাগণ ফতোয়া দিয়েছেন যে ন্যাপকিন দিয়ে ভালো করে বেঁধে তাওয়াফ আদায় করে নিতে পারে।

[1] - أن أول شيء بدأ به النبي صلى الله عليه وسلم حين قدم ، أن توضأ ثم طاف بالبيت

(ফাতহুল বারী : ৩/৩০৩ , হাদিস নং ১৬৪১)

[2] - শারহুননববী আলা মুসলিম: খন্ড ৮ , ২২০

[3] - عن ابن عباس رضى الله عنهما : أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : الطواف صلاة إلا أن الله تعالى أحل فيه الكلام ، فمن تكلم فلا يتكلم إلا بخير بالبيت (মুহাদ্দিস নাসীরুদ্দিন আল-বানী এ হাদিসটি সহিহ বলেছেন: এরওয়া : ২১)

[4] - فاقضي ما يقضي الحاج ، غير أن لا تطوفي بالبيت حتى تغتسلى - অন্য হাজীরা যা করে তুমিও তাই করবে, তবে পবিত্র হয়ার পর গোসলের পূর্বে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে না। (মুসলিম)

[5] - ইমাম মুহাম্মদ আশ্শানকীতি: খালিসূল জুমান,পৃ: ১৮২

[6] সূরা আরাফ : ৩১

[7] - ইবনে কাছীর : খন্ড১, পৃ: ১৫৭

[8] - দেখুন : ফাতহুল বারী : ৩/২৬৯

[9] - বুখারি : ১৫১৩