স্বালাতে মুবাশ্‌শির জুম'আ আবদুল হামীদ ফাইযী ১ টি

নামাযীর জন্য যথাসম্ভব ইমামের নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা করা কর্তব্য। মহানবী (ﷺ) বলেন, “তোমরা আল্লাহর যিকরে উপস্থিত হও এবং ইমামের নিকটবর্তী হও। আর লোকে দূর হতে থাকলে বেহেশত প্রবেশেও দেরী হবে তার; যদিও সে বেহেশ্তে প্রবেশ করবে।” (আবূদাঊদ, সুনান ১১০৮নং)

জুমআর দিন নামাযী মসজিদে এসে যেখানে জায়গা পাবে সেখানে বসে যাবে। দেরী করে এসে (সামনের কাতারে ফাঁক থাকলেও) কাতার চিরে সামনে যাওয়া এবং তাতে অন্যান্য নামাযীদেরকে কষ্ট দেওয়া বৈধ নয়।

হযরত আব্দুল্লাহ বিন বুসর (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, কোন এক জুমআর দিনে এক ব্যক্তি লোকেদের কাতার চিরে (মসজিদের ভিতর) এল। সে সময় নবী (ﷺ) খুতবা দিচ্ছিলেন। তাকে দেখে নবী (ﷺ) বললেন, “বসে যাও, তুমি বেশ কষ্ট দিয়েছ এবং দেরী করেও এসেছ।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ, সহিহ তারগিব ৭১৩ নং)

খুতবা চলাকালে মসজিদে উপস্থিত ব্যক্তির জন্য নামায নিষিদ্ধ। কিন্তু এই সময়ে কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে তার জন্য হাল্কা করে ২ রাকআত নামায পড়া বিধেয়। যেমন কাউকে নামায না পড়ে বসতে দেখলে খতীবের উচিৎ তাকে ঐ নামায পড়তে আদেশ করা। খুতবা শোনা ওয়াজেব হলেও এ নামাযের গুরুত্ব দিয়েছেন খোদ মহানবী (ﷺ)। একদা খুতবা চলাকালে এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে বসে পড়লে তিনি তাকে বললেন, “তুমি নামায পড়েছ কি?” লোকটা বলল, না। তিনি বললেন, “ওঠ এবংহাল্কা করে ২ রাকআত পড়ে নাও।” (বুখারী ৯৩০, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ১১১৫-১১১৬, তিরমিযী, সুনান ৫১০নং) অতঃপর তিনি সকলের জন্য চিরস্থায়ী একটি বিধান দেওয়ার উদ্দেশ্যে লোকেদেরকে সম্বোধন করে বললেন, “তোমাদের কেউযখন ইমামের খুতবা দেওয়া কালীন সময়ে উপস্থিত হয়, সে যেন (সংক্ষেপে) ২ রাকআত নামায পড়ে নেয়।” (বুখারী, ১১৭০, মুসলিম, সহীহ ৮৭৫, আবূদাঊদ, সুনান ১১১৭নং)

একদা হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) মসজিদ প্রবেশ করলেন। তখন মারওয়ান খুতবা দিচ্ছিলেন। তিনি নামায পড়তে শুরু করলে প্রহ্‌রীরা তাঁকে বসতে আদেশ করল। কিন্তু তিনি তাদের কথা না শুনেই নামায শেষ করলেন। নামায শেষে লোকেরা তাকে বলল, আল্লাহ আপনাকে রহ্‌ম করুন। এক্ষনি ওরা যে আপনার অপমান করত। উত্তরে তিনি বললেন, আমি সে নামায ছাড়ব কেন, যে নামায পড়তে নবী (ﷺ)-কে আদেশ করতে দেখেছি। (তিরমিযী, সুনান ৫১১নং)

বলা বাহুল্য, খুতবা শুরু হলে লাল বাতি জ্বেলে দেওয়া, অথবা কাউকে ঐ ২ রাকআত নামায পড়তে দেখে চোখ লাল করা, অথবা তার জামা ধরে টান দেওয়া, অথবা খোদ খতীব সাহেবের মানা করা সুন্নাহ্‌-বিরোধী তথা বিদআত কাজ।

জুমআর আযানের সময় মসজিদে এলে দাঁড়িয়ে থেকে আযানের উত্তর না দিয়ে, তাহিয়্যাতুল মাসজিদ পড়ে খুতবা শোনার জন্য বসে যাওয়া বাঞ্ছনীয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩৩৫, ৩৪৯)

প্রকাশ থাকে যে, আযানের উত্তর দেওয়া মুস্তাহাব। (তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ৩৪০পৃ:) আর খুতবা শোনা ওয়াজেব। সুতরাং আযানের সময় পার করে খুতবা শুরু হলে নামায পড়া বৈধ নয়। পক্ষান্তরে তাহিয়্যাতুল মাসজিদ ওয়াজেব না হলেও ঐ সময় মহানবী (ﷺ)-এর মহা আদেশ পালন করা জরুরী।

ইমামের দিকে চেহারা করে বসা মুস্তাহাব। হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (ﷺ) যখন মিম্বরে চড়তেন, তখন আমরা আমাদের চেহারা তাঁর দিকে ফিরিয়ে বসতাম।’ (তিরমিযী, সুনান ৫০৯নং)

পরিধানে লুঙ্গি বা লুঙ্গি জাতীয় এক কাপড় পরে খুতবা চলাকালে বসার সময় উভয় হাঁটুকে খাড়া করে রানের সাথে লাগিয়ে উভয় পা-কে দুইহাত দ্বারা জড়িয়ে ধরে অথবা কাপড় দ্বারা বেঁধে বসা বৈধ নয়। (আবূদাঊদ, সুনান ১১১০, তিরমিযী, সুনান ৫১৪নং) কারণ, এতে শরমগাহ্‌ প্রকাশ পাওয়ার, চট করে ঘুম চলে আসার এবং তাতে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে তাই।

খুতবা শোনা ওয়াজেব। আর এ সময় সকল প্রকার কথাবার্তা, সালাম ও সালামের উত্তর, হাঁচির হামদের জবাব, এমনকি আপত্তিকর কাজে বাধা দেওয়াও নিষিদ্ধ।

হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেন, “জুমআর দিন ইমামের খুতবা দানকালে কথা বললে তুমি অনর্থ কর্ম করলে এবং (জুমুআহ) বাতিল করলে।” (ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, সহিহ তারগিব ৭১৬ নং)

উক্ত হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেন, “জুমআর দিন ইমামের খুতবা দেওয়ার সময় যদি তুমি তোমার (কথা বলছে এমন) সঙ্গীকে ‘চুপ কর’ বল তাহলে তুমিও অসার কর্ম করবে।” (বুখারী ৯৩৪, মুসলিম, সহীহ ৮৫১নং, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌), ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ)

‘অসার বা অনর্থক কর্ম করবে’ এর একাধিক ব্যাখ্যা করা হয়েছে; যেমন, তুমি জুমআর সওয়াব থেকে বঞ্চিত হবে। অথবা তোমারও কথা বলা হবে। অথবা তুমিও ভুল করবে। অথবা তোমার জুমুআহ বাতিল হয়ে যাবে। অথবা তোমার জুমুআহ যোহরে পরিণত হয়ে যাবে -ইত্যাদি। তবে বিশেষজ্ঞ উলামাদের নিকট শেষোক্ত ব্যাখ্যাই নির্ভরযোগ্য। কারণ, এরুপ ব্যাখ্যা নিম্নোক্ত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।

আব্দুল্লাহ বিন আম্‌র বিন আস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি জুমআর দিন গোসল করল, তার স্ত্রীর সুগন্ধি (আতর) থাকলে তা ব্যবহার করল, উত্তম লেবাস পরিধান করল, অতঃপর (মসজিদে এসে) লোকেদের কাতার চিরে (আগে অতিক্রম) করল না এবং ইমামের উপদেশ দানকালে কোন বাজে কর্ম করল না, সে ব্যক্তির জন্য তা উভয় জুমআর মধ্যবর্তী কৃত পাপের কাফফারা হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি অনর্থক কর্ম করল এবং লোকেদের কাতার চিরে সামনে অতিক্রম করল সে ব্যক্তির জুমুআহ যোহরে পরিণত হয়ে যাবে।” (আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, সহিহ তারগিব ৭২০নং)

মহানবী (ﷺ) বলেন, “জুমআর দিন ৩ শ্রেণীর মানুষ (মসজিদে) উপস্থিত হয়। প্রথম শ্রেণীর মানুষ উপস্থিত হয়ে বাজে কথা বলে; তার সেটাই হল প্রাপ্য। দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ উপস্থিত হয়ে দুআ করে; আর সে এমন লোক, যে আল্লাহর কাছে দুআ করে, আল্লাহ তার দুআ কবুল করেন অথবা না করেন। আর তৃতীয় শ্রেণীর মানুষ উপস্থিত হয়ে চুপ ও নির্বাক থাকে, কোন মুসলিমের কাঁধ ডিঙিয়ে (কাতার চিরে) আগে যায় না এবং কাউকে কোন প্রকার কষ্ট দেয় না। এই শ্রেণীর মানুষের জন্য তার ঐ কাজের ফলে তার ঐ জুমুআহ থেকে আগামী জুমুআহ পর্যন্ত বরং অতিরিক্ত ৩ দিনে (অর্থাৎ, ১০ দিনে) কৃত গুনাহর কাফফারা হবে। কেননা আল্লাহ আয্‌যা অজাল্ল্‌ বলেন, (من جاء بالحسنة فله عشر أمثالها) (অর্থাৎ, যে ব্যক্তি একটি সওয়াবের কাজ করবে, সে তার ১০ গুণ সওয়াব লাভ করবে।)” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ১১১৩নং)

আলকামাহ্‌ বিন আব্দুল্লাহর সাথে তাঁর এক সাথী খুতবা চলাকালে কথা বলছিল। তিনি তাকে চুপ করতে বললেন। নামাযের পর ইবনে উমার (রাঃ)-এর কাছে এ কথা উল্লেখ করা হলে তিনি বললেন, ‘তোমার তো জুমুআহই হয়নি। আর তোমার সাথী হল একটা গাধা।’ (ইবনে আবী শাইবা ৫৩০৩নং)

প্রকাশ থাকে যে, ইমাম মিম্বরের উপর বসে থাকা অবস্থায়, অর্থাৎ খুতবা বন্ধ থাকা অবস্থায় কথা বলা অবৈধ নয়। (ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু১৭৩পৃ:) যেমন ইমামের খুতবা শুরু না করা পর্যন্ত (প্রয়োজনীয়) কথাবার্তা (এমনকি আযানের সময়ও) বলা বৈধ। ষা’লাবাহ্‌ বিন আবী মালেক কুরাযী বলেন, হযরত উমার ও উসমানের যুগে ইমাম বের হলে আমরা নামায ত্যাগ করতাম এবং ইমাম খুতবা শুরু করলে আমরা কথা বলা ত্যাগ করতাম। (ইবনে আবী শাইবা, তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ৩৪০পৃ:)

খুতবা চলা অবস্থায় কেউ মসজিদ এলে মসজিদে প্রবেশ করার আগে রাস্তায় খুতবা শুনতে পেলে রাস্তাতেও কারো সঙ্গে কথা বলাও বৈধ নয়।

বৈধ নয় খুতবা চলা অবস্থায় হাতে কোন কিছু নিয়ে ফালতু খেলা করা। যেমন মিসওয়াক করা, তাসবীহ-মালা (?) নিয়ে খেলা করা, মসজিদের মেঝে, কাঁকর বা কুটো স্পর্শ করে খেলা করা ইত্যাদি। মহানবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে ওযু করে জুমআর উদ্দেশ্যে (মসজিদে) উপস্থিত হয়। অতঃপর মনোযোগ সহকারে (খুতবাহ্‌) শ্রবণ করে ও নীরব থাকে সেই ব্যক্তির ঐ জুমুআহ থেকে দ্বিতীয় জুমুআহর মধ্যবর্তীকালে সংঘটিত এবং অতিরিক্ত তিন দিনের পাপ মাফ করে দেওয়া হয়। আর যে ব্যক্তি (খুতবা চলাকালে) কাঁকর স্পর্শ করে সে অসার (ভুল) কাজ করে।” (মুসলিম, সহীহ ৮৫৭ নং, আবূদাঊদ, সুনান ১০৫০, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

খুতবা চলাকালে তন্দ্রা (ঢুল) এলে জায়গা পরিবর্তন করে বসা বিধেয়। এতে তন্দ্রা দূরীভূত হয়ে যায়। মহানবী (ﷺ) বলেন, “তোমাদের কেউমসজিদে বসে ঢুললে সে যেন তার বসার জায়গা পরিবর্তন করে অন্য জায়গায় বসে।” (আবূদাঊদ, সুনান ১১১৯ নং, তিরমিযী, সুনান, জামে ৮০৯নং)

কাউকে তার জায়গা থেকে উঠিয়ে সেখানে বসা, কেউ কোন কারণে জায়গা ছেড়ে উঠে গেলে এবং সে ফিরে আসবে ধারণা হওয়া সত্ত্বেও তার সেই জায়গায় বসা বৈধ নয়। মহানবী (ﷺ) বলেন, “যখন তোমাদের কেউ নিজ জায়গা ছেড়ে উঠে যায় এবং পরক্ষণে সে ফিরে আসে, তাহলে সেই ঐ জায়গার অধিক হ্‌কদার।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, সহীহ)

হযরত ইবনে উমার (রাঃ) কেউ তার জায়গা ছেড়ে উঠে গেলে সে জায়গায় বসতেন না। (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, সহীহ)

কিন্তু খুতবা শুনতে শুনতে ঘুম এলে (কথা না বলে) ইঙ্গিতে পাশের সাথীর সাথে জায়গা বদল করা উত্তম। যেহেতু মহানবী (ﷺ) বলেন, “যখন তোমাদের কেউ জুমআর দিন ঢুলতে শুরু করে, তখন তার উচিৎ তার সঙ্গীর জায়গায় গিয়ে বসা এবং তার সঙ্গীর উচিৎ তার ঐ জায়গায় বসা।” (বায়হাকী, জামে ৮১২নং)

জ্ঞাতব্য যে, ইমামের কলেমা অথবা দরুদ পড়ার সাথে সাথে মুসল্লীদের সমস্বরে সশব্দে তা পড়া বিদআত। (মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্‌ ২৬৫পৃ:)

প্রকাশ থাকে যে, বিশেষ করে জুমুআহ বা ঈদের নামাযে অত্যন্ত ভিঁড়ের ফলে যদি সিজদাহ করার জায়গা না পাওয়া যায়, তাহলেও জামাআতে নামায পড়তে হবে। আর এই অবস্থায় সামনের নামাযীর পিঠে সিজদা করতে হবে। ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, ‘নবী (ﷺ) আমাদের কাছে সিজদার সূরা পড়তেন। অতঃপর সিজদায় জায়গায় তিনি সিজদাহ করতেন এবং আমরাও সিজদাহ করতাম। এমনকি ভিঁড়ের ফলে আমাদের কেউ সিজদাহ করার মত জায়গা না পেলে অপরের (পিঠের) উপরে সিজদাহ করতাম।’ (বুখারী ১০৭৬নং)

হযরত উমার বলেন, পিঠের উপর উপর সিজদাহ করতে হবে। এই মত গ্রহণ করেছেন কুফাবাসীগণ, ইমাম আহমাদ এবং ইসহাক। পক্ষান্তরে আত্বা ও যুহ্‌রী বলেন, সামনের লোকের উঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করে সে উঠে গেলে তারপর সিজদাহ করবে। আর এমত গ্রহণ করেছেন ইমাম মালেক ও অধিকাংশ উলামাগণ। (কিন্তু এর ফলে ইমামের বিরোধিতা হবে।) ইমাম বুখারীর লিখার ভঙ্গিতে বুঝা যায় যে, তিনি মনে করেন, এই অবস্থায় নামাযী নিজ সামথ্য অনুযায়ী সিজদাহ করবে। এমনকি নিজ ভায়ের পিঠে সিজদাহ করতে হলে তাও করবে। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৬৫২)

অবশ্য (মাসজিদুলহারামাইনে) সামনে মহিলা পড়লে সিজদাহ না করে একটু ঝুঁকে বা ইশারায় নামায আদায় করবে।