১। ইমামতির নিয়ত :

সাধারণভাবে ইমামতির নিয়ত (সংকল্প) জরুরী। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৫/৭০) অবশ্য একাকী নামায পড়া অবস্থায় কেউ জামাআতের নিয়তে তার সাথে শামিল হলে জামাআত হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে নামায পড়তে পড়তে ইমামতির সংকল্প করে নেওয়া যথেষ্ট হবে। নামায শুরু করার আগে থেকে ইমামতির নিয়ত জরুরী নয়। (ঐ ১৭/৫৯) হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস বলেন, এক রাত্রে আমি আমার খালা মায়মূনার ঘরে শুয়ে ছিলাম। নবী (ﷺ) রাত্রে উঠে যখন নামায পড়তে লাগলেন, তখন আমিও তাঁর সাথে শামিল হয়ে গেলাম। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ)

একদা মহানবী (ﷺ) এক ব্যক্তিকে একাকী নামায পড়া দেখে বললেন, “কে আছে যে এর জন্য সাদকাহ্‌ করবে? (এর সওয়াব বর্ধন করবে?)” এ কথা শুনে এক ব্যক্তি উঠে তার সাথে নামায পড়ল। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান)

২। কাতার সোজা করতে বলা :

নবী মুবাশ্‌শির (ﷺ) নামাযে ইমামতির জায়গায় দাঁড়িয়ে মুক্তাদীদের দিকে মুখ করে তাদেরকে বিভিন্ন নির্দেশ দিতেন। (বুখারী ৭১৯নং) যেমন, “তোমরা সোজা হয়ে দাঁড়াও।” “কাতার সোজা কর।” “কাতার পূর্ণ কর।” “ঘন হয়ে দাঁড়াও।” “সামনে এস।” “ঘাড় ও কাঁধসমূহকে সমপর্যায়ে সোজা কর।” “প্রথম কাতারকে আগে পূর্ণ কর, তারপর তার পরের কাতারকে। অপূর্ণ থাকলে যেন শেষের কাতার থাকে।” “কাতারের ফাঁক বন্ধ কর।” “বাজারের মত হৈ-চৈ করা থেকে দূরে থাক।” ইত্যাদি।

কাতারে কেউ আগে-পিছে সরে থাকলে তাকে বরাবর হতে বলা এমন কি নিজে কাছে গিয়ে কাতার সোজা করা ইমামের কর্তব্য। আর যতক্ষণ পর্যন্ত না কাতার পূর্ণরুপে সোজা হয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত নামায শুরু করা উচিৎ নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১৬) বরং কাতার সোজা ও ঠিক হওয়ার আগে ইমামের নামায শুরু করা বিদআত। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্‌, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্‌, মুহাদ্দিস আলবানী ৭৪পৃ:)

নু’মান বিন বাশীর (রাঃ) বলেন, ‘আমরা নামাযে দাঁড়ালে আল্লাহর রসূল (ﷺ) আমাদের কাতার সোজা করতেন। অতঃপর আমরা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলে তবেই তকবীর দিতেন।’ (বুখারী ৭১৭, মুসলিম, সহীহ ৪৩৬, আবূদাঊদ, সুনান ৬৬৫নং)

৩। মুক্তাদীদের খেয়াল করে নামায হাল্কা করে পড়া :

জামাআতে বিভিন্ন ধরনের লোক নামায পড়ে থাকে। ইমামের উচিৎ, নিজের ইচ্ছামত নামায না পড়া; বরং তাদের খেয়াল রেখে ক্বিরাআত ইত্যাদি লম্বা করা। অবশ্য কারো ইচ্ছা অনুসারে নামায এমন হাল্কা করা উচিৎ নয়, যাতে নামাযের বিনয়, ধীরতা-স্থিরতা, পরিপূর্ণরুপে রুক্‌ন-ওয়াজেব-সুন্নত আদি আদায় ব্যাহত হয়। বলা বাহুল্য, যাতে উভয় দিক বজায় থাকে তার খেয়াল অবশ্যই রাখতে হবে।

আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আমি নবী (ﷺ) অপেক্ষা কোন ইমামের পিছনে অধিক সংক্ষেপ অথচ অধিক পরিপূর্ণ নামায পড়ি নি। এমন কি তিনি যখন কোন শিশুর কান্না শুনতেন তখন তার মায়ের উদ্বিগ´ হওয়ার আশংকায় নামায সংক্ষেপ করতেন।’ (বুখারী ৭০৮নং, মুসলিম, সহীহ)

মহানবী (ﷺ) বলেন, “আমি অনেক সময় নামায শুরু করে তা লম্বা করতে ইচ্ছা করি। কিন্তু যখন আমি কোন শিশুর কান্না শুনি, তখন আমার নামাযকে সংক্ষেপ করি। কারণ, তার কান্নায় তার মায়ের মনের উদ্বেগ যে বেড়ে যাবে তা আমি জানি।” (বুখারী ৭০৯নং)

তিনি বলেন, “যখন তোমাদের কেউ লোকেদের নামায পড়ায়, তখন সে যেন হাল্কা করে পড়ে। কেননা, তাদের মধ্যে রোগী, দুর্বল ও বৃদ্ধ লোক থাকে। অবশ্য যখন তোমাদের কেউ একা নামায পড়ে, তখন সে যত ইচ্ছা লম্বা করতে পারে।” (বুখারী ৭০৩নং, মুসলিম, সহীহ)

এক ব্যক্তি বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহর কসম! আমি ফজরের নামাযে অমুকের কারণে হাজির হ্‌ই না; সে আমাদের নামায খুব লম্বা করে পড়ায়।’ আবূ মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘এর পর সেদিন আল্লাহর রসূল (ﷺ)-কে ওয়াযে যেরুপ রাগান্বিত হতে দেখেছি সেরুপ আর অন্য কোন দিন দেখি নি। তিনি বললেন, “তোমাদের কেউ কেউ লোকদেরকে (জামাআতের প্রতি) বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। তোমাদের যে কেউ কোন নামাযের ইমামতি করে সে যেন নামায সংক্ষেপ করে পড়ে। কেননা, তাদের মধ্যে দুর্বল, বৃদ্ধ ও (বিভিন্ন) প্রয়োজন-ওয়ালা লোক আছে।” (বুখারী ৭০২নং, মুসলিম, সহীহ)

মহানবী (ﷺ) বলেন, “জামাআতের সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তির খেয়াল করে নামায পড়াও। আর এমন মুআযযিন রেখো না, যে আযানের পারিশ্রমিক চায়।” (ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, জামে ৩৭৭৩নং)

তিনি মুআয (রাঃ) কে এশার ইমামতিতে লম্বা ক্বিরাআত পড়তে নিষেধ করে বলেছিলেন, “তুমি কি লোকদেরকে ফিতনায় ফেলতে চাও হে মুআয? তুমি যখন ইমামতি করবে তখন ‘অশশামসি অয্বহা-হা, সাব্বিহিসমা রাব্বিকাল আ’লা, ইক্বরা বিসমি রাব্বিকা, অল্লাইলি ইযা য়্যাগশা’ পাঠ কর। কারণ তোমার পশ্চাতে বৃদ্ধ, দুর্বল ও প্রয়োজনে উদ গ্রী ব মানুষ নামায পড়ে থাকে। (বুখারী ৭০৫, মুসলিম, না, মিশকাত ৮৩৩ নং)

আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিনত্বারখান বলেন, একদা আমরা শায়খ ইমাদের পশ্চাতে নামায পড়ছিলাম। আমার পাশে এক ব্যক্তি নামায পড়ছিল, -আমার মনে হয়- তার কোন ব্যস্ততা ছিল। যখন নামায থেকে ফারেগ হ্‌লাম, তখন সে কসম করে বলল, আর কখনো তাঁর পিছনে নামায পড়বে না। আর সেই সঙ্গে মুআযের ঐ হাদীস উল্লেখ করল। আমি তাকে বললাম, তুমি কেবল এই হাদীসটিই জান? অতঃপর আমি তার কাছে নবী (ﷺ)-এর নামায লম্বা করার ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসগুলি উল্লেখ করলাম। এরপর আমি শায়খ ইমাদের পাশে বসলাম এবং ঘটনা খুলে বললাম। আমি তাঁকে বললাম, ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি এবং এই কামনা করি যে, আপনার বিরুদ্ধে যেন কোন প্রকার সমালোচনা না হয়। সুতরাং যদি আপনি নামাযকে একটু হাল্কা করে পড়তেন। তিনি আমার এ কথা শুনে বললেন, ‘সম্ভবত: অতি নিকটে ওরা আমার ও আমার নামায থেকে নিস্ক্রিতি পাবে। ইয়া সুবহানাল্লাহ্‌! ওদের কেউ কেউ (দুনিয়ার) রাজা-বাদশার সামনে সারা দিন দাঁড়িয়ে থাকলে কোন প্রকারের বিরক্তি প্রকাশ করে না; অথচ ওরা ওদের (দ্বীন-দুনিয়ার বাদশা) প্রভুর সামনে সামান্য সময় দাঁড়াতে বিরক্তিবোধ করে?! (মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্‌ ১৮৮পৃ:)

৪। দ্বিতীয় রাকআতের তুলনায় প্রথম রাকআত দীর্ঘ করা :

প্রথম রাকআতকে একটু লম্বা করে পড়া উত্তম। যাতে পিছে থেকে যাওয়া মুসল্লীরা প্রথম রাকআতেই এসে শামিল হতে পারে।

আবূ কাতাদাহ্‌ কর্তৃক বর্ণিত, মহানবী (ﷺ) যোহরের নামাযে দ্বিতীয় রাকআতের তুলনায় প্রথম রাকআত লম্বা করে পড়তেন। অনুরুপ আসর ও ফজরের নামাযেও। (বুখারী, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ৮০০ নং) আবূ দাঊদের বর্ণনায় আরো বলা হয়েছে যে, আমরা মনে করতাম, তিনি তা এই জন্য করছেন; যাতে লোকেরা প্রথম রাকআতে শামিল হতে পারে।

আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, নামাযের ইকামত হয়ে যেত, আর আমাদের কেউ কেউ বাকী গিয়ে নিজের প্রয়োজন (প্রস্রাব-পায়খানা) সেরে ওযূ করে প্রথম রাকআতে শামিল হতে পারত। কারণ, নবী (ﷺ) ঐ রাকআতকে লম্বা করে পড়তেন। (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

তদনুরুপ ইমাম রুকূতে থাকা কালে কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে তাকে রুকূ পাইয়ে দেওয়ার জন্য রুকূ একটু লম্বা করা বৈধ। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩৫২) পক্ষান্তরে বেশী লম্বা করে জামাআতের মুসল্লীদেরকে কষ্ট দেওয়া উচিৎ নয়। অভিজ্ঞ ইমাম তাঁর মুক্তাদীদের অভ্যাস ও আচরণের মাধ্যমে তাদের বিরক্তি ও সন্তুষ্টির কথা অবশ্যই বুঝতে পারবেন।

৫। দুআয় নিজেকে খাস না করা :

দুআর সময় এক বচন শব্দ ব্যবহার করে নিজের জন্য দুআকে খাস করা ইমামের জন্য বৈধ নয় বলে যেহাদীস মহানবী (ﷺ) থেকে বর্ণনা করা হয়, তা সহীহ নয়। (দ্র: তামামুহ্‌ মিন্নাহ্‌ ২৭৮-২৮০পৃ:) আর এ কথা বিদিত যে, মহানবী (ﷺ) নিজে ইমাম হয়েও অনেক সময় একবচন শব্দ ব্যবহার করে নামায পড়েছেন। উদাহ্‌রণস্বরুপ ‘বা-ইদ বাইনী’রহাদীস।

তবুও সাধারণ দুআর সময় এক বচনের স্থলে বহুবচন শব্দ ব্যবহার করা দোষাবহ্‌ নয়। ইমাম বগবী (রহঃ) বলেন, ইমাম হলে (দুআয়) এক বচনের স্থলে বহু বচন শব্দ ব্যবহার করবে। ‘আল্লাহুম্মাহ্‌দিনা---- অআ-ফিনা --- বলবে এবং দুআকে নিজের জন্য খাস করবে না। (শারহুস সুন্নাহ্‌ ৩/১২৯) অনুরুপ বলেন ইবনে বায রাহিমাহুল্লাহ্‌। (স্বালাতুত তারাবীহ্‌ ৪১পৃ:, মুখতাসারু মুখালাফাতু ত্বাহারাতি অসস্বালাহ, আব্দুল আযীয সাদহান ১৭০-১৭১পৃ:)

৬। সালাম ফিরে মুক্তাদীদের দিকে ফিরে বসা :

নামাযে সালাম ফিরার পর ডান অথবা বাম দিকে ঘুরে মুক্তাদীদের প্রতি মুখ করে বসা ইমামের জন্য মুস্তাহাব। (বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান ১০৪১, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৯৪৪নং)

ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, “আমি আল্লাহর রসূল (ﷺ)-কে বহুবার বাম দিক হতে ঘুরতে দেখেছি। (বুখারী ৮৫২নংও মুসলিম ৭০৭নং, মিশকাত ৯৪৬নং)

আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আমি আল্লাহর রসূল (ﷺ)-কে অধিকাংশ ডান দিক হতে ঘুরে বসতে দেখেছি। (মুসলিম৭০৮নং)

৭। যিক্‌র-আযকারের পর জায়গা বদলে সুন্নত আদি পড়া :

মহানবী (ﷺ) বলেন, “ইমাম যে জায়গায় (ফরয) নামায পড়ে সে জায়গাতেই সে যেন (সুন্নত) নামায না পড়ে। বরং সে যেন অন্য জায়গায় সরে যায়।” (আবূদাঊদ, সুনান ৬১৬নং, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

শুধু ইমামই নয়; বরং মুক্তাদীর জন্যও জায়গা বদলে সুন্নত পড়া মুস্তাহাব। নবী মুবাশ্‌শির (ﷺ) বলেন, “তোমাদের কেউকি (সুন্নত পড়ার জন্য) তার সামনে, পিছনে, ডাইনে বা বামে সরে যেতে অক্ষম হবে?” (আবূদাঊদ, সুনান ১০০৬, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, জামে ২৬৬২নং)

সায়েব বিন য়্যাযীদ বলেন, একদা আমি মুআবিয়া (রাঃ)-এর সাথে (মসজিদের) আমীর-কক্ষে জুমআর নামায পড়লাম। তিনি সালাম ফিরলে আমি উঠে সেই জায়গাতেই সুন্নত পড়ে নিলাম। অতঃপর তিনি (বাসায়) প্রবেশ করলে একজনের মারফৎ আমাকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ‘তুমি যা করলে তা আর দ্বিতীয়বার করো না। জুমআর নামায সমাপ্ত করলে কথা বলা অথবা বের হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তার সাথে আর অন্য কোন নামায মিলিয়ে পড়ো না। কারণ, আল্লাহর রসূল (ﷺ) আমাদেরকে আদেশ করেছেন যে, (মাঝে) কথা না বলে বা বের হয়ে না গিয়ে কোন নামাযকে যেন অন্য নামাযের সাথে মিলিয়ে না পড়ি।’ (মুসলিম, সহীহ ৮৮৩, আবূদাঊদ, সুনান ১১২৯নং, আহমাদ, মুসনাদ৪/৯৫, ৯৯)

উদ্দেশ্য হল, নামাযের জায়গা বেশী করলে, কিয়ামতে ঐ সকল জায়গা আল্লাহর আনুগত্যের সাক্ষ্য দেবে। (মিশকাত ৯৫৩হাদীসের টীকা দ্র:)

অবশ্য এ সময় খেয়াল রাখা উচিৎ, যাতে উক্ত মুস্তাহাব পালন করতে গিয়ে কোন নামাযীর সিজদার জায়গার ভিতর বেয়ে পার হয়ে গুনাহ না হয়ে বসে।