সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ ত্বহারাত অধ্যায় আবূ মালিক কামাল বিন আস-সাইয়্যিদ সালিম ১ টি

আলিমগণ এ ব্যাপারে দু’টি ভিন্ন ভিন্ন অভিমত পেশ করেছেন।

১ম অভিমত:

মদ নাপাক। এটা জমহুর ওলামার অভিমত। চার ইমামও এমতামত ব্যক্ত করেছেন। শাইখুল ইসলাম এ মতটিকে পছন্দ করেছেন। তাদের দলীল হলো আল্লাহ্‌র বাণী-

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ﴾

হে মু‘মিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সূরা আল-মায়েদা-৯০)

তারা বলেন: এখানে رِجْسٌ শব্দের অর্থ نجس বা নাপাকী। তারা স্বয়ং মদকেই অনুভূতি সূচক নাপাক বলে আখ্যা দিয়েছেন।

২য় অভিমত:

২য় অভিমতে মদ পবিত্র। এটা বলেছেন রাবিয়াহ লাইস, মাযানি এবং অন্যান্য সালাফগণ। ইমাম শাওকানী, সনআনী, আহমাদ শাকির ও আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) এ মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আর এটাই বিশুদ্ধ মতামত।

এর কারণ নিম্নরূপ-

(১) আলোচ্য আয়াতে মদ নাপাক হওয়ার কোন দলীল নেই। কারণ-

(ক) এখানে رِجْسٌ শব্দটি مشترك (বহুঅর্থবোধক) শব্দ। তা অনেক অর্থের সম্ভাবনা রাখে।[1] যেমন: القذر (পংকিলতা) المحرم (হারামকৃত) القبيح (মন্দ) العذاب (শাস্তি) اللعنة (অভিশাপ) الكفر (কুকুরী) الشر (ক্ষতি) الإثم (পাপ) এবং النجس (নাপাক) ইত্যাদি।

(খ) আমরা সালাফদের কাউকেও দেখি নি যে, তারা অত্র আয়াতে رجس এর ব্যাখ্যা نجس (নাপাকী) দ্বারা করেছেন। বরং ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন رجس অর্থ سخط বা অসমেত্মাষ। ইবনে যায়েদ বলেন رجس অর্থ شر ক্ষতি।

(গ) رجس শব্দটি আল্লাহ্‌র কিতাবে অত্র আয়াত ব্যতীত আরও তিন জায়গায় উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু সেগুলোর কোথাও رجس অর্থ نجس (নাপাকী) করা হয় নি। যেমনঃ (১) رجسশব্দটি আল্লাহ্‌র নিম্নোক্ত বাণীতে উল্লেখ হয়েছে: ﴾ كَذَلِكَ يَجْعَلُ اللَّهُ الرِّجْسَ عَلَى الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ ﴿ এমনিভাবে আল্লাহ্‌ অকল্যাণ বা শাস্তি দেন তাদের উপর, যারা ঈমান আনে না (সূরা আল-আনআম-১২৫)। এখানে رجس অর্থ العذاب (শাস্তি)। (২) অন্যত্র মহান আল্লাহ্‌ মুনাফিকদের ব্যাপারে বলেন:﴾ ﴿ إِنَّهُمْ رِجْسٌ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُনিশ্চয়ই তাদের আমল মন্দ এবং জাহান্নাম হলো তাদের আশ্রয়স্থল (সূরা তাওবা ৯৫)। এখানে উদ্দেশ্য হলো: তাদের আমল নিকৃষ্ট বা মন্দ। অত্র আয়াতে رجس অর্থ قبيح (মন্দ)। (৩) আল্লাহ্‌র বাণী: ﴾ فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الْأَوْثَانِ ﴿ সুতরাং মূর্তিপূজার শাস্তি হতে বিরত থাক (সূরা হাজ্জ্ব-৩০), অত্র আয়াতে أوثَانِ (মূর্তীসমূহ) কে رجس নামে নামকরণ করা হয়েছে। কেননা তা শাস্তির কারণ। এর দ্বারা نجاسة حسية বা অনুভূতি সূচক নাপাক উদ্দেশ্য নয়। কেননা স্বয়ং পাথর ও মূর্তীসমূহ নাপাক নয়।

আল্লাহ্‌র বাণী:

﴿قُلْ لَا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّمًا عَلَى طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ إِلَّا أَنْ يَكُونَ مَيْتَةً أَوْ دَمًا مَسْفُوحًا أَوْ لَحْمَ خِنْزِيرٍ فَإِنَّهُ رِجْسٌ﴾

আপনি বলে দিন: যা কিছু বিধান ওহীর মাধ্যমে আমার কাছে পৌঁছেছে, তন্মধ্যে আমি কোন হারাম খাদ্য পাই না কোন ভক্ষণকারীর জন্যে, যা সে ভক্ষণ করে; কিন্তু মৃত অথবা প্রবাহিত রক্ত অথবা শুকরের মাংস ব্যতীত, নিশ্চয় তা অপবিত্র । (সূরা আল-আনআম :১৪৫) অত্র আয়াতে رجس অর্থ নাপাক হওয়াটা সম্ভাবনাময়।

(ঘ) আয়াতে خمر (মদ) শব্দটি أنصاب ও أزلام এর সাথে উল্লেখ হওয়ায় رجس এর অর্থ শারঈ নাপাক না হওয়ার দিকেই ইঙ্গিত করে। এরূপভাবে আল্লাহ্‌র বাণী-﴾ إِنَّمَا الْمُشْرِكُونَ نَجَسٌ ﴿ মুশরিকগণ নাপাক (সূরা তাওবা-২৮)। অত্র আয়াতে মুশকিদের نجس বা নাপাক বলা হলেও এমন সহীহ দলীল রয়েছে যা মুশরিকদের সত্ত্বাকে নাপাক না হওয়া প্রমাণ করে।

(ঙ) মদ হারাম হওয়ার কারণে তা নিজে নাপাক হওয়াকে আবশ্যক করে না। তবে নাপাক জিনিস মাত্রই অনিবার্যভাবে হারাম। পুরুষের জন্য রেশম ও স্বর্ণ হারাম। অথচ এদুটোই শারঈভাবে ও সর্বসম্মতিক্রমে পবিত্র।

(চ) অত্র আয়াতে الرجس শব্দটি শয়তানের আমলের সাথে নির্দিষ্ট। অতএব তা আমল গত ভাবে رجس । সুতরাং এর অর্থ হতে পারে- قبيح (মন্দ), محرم (নিষিদ্ধ) অথবা إثم (পাপ)। এর দ্বারা প্রকৃত رجس বা নাপাক উদ্দেশ্য নয়, যার ফলে এর কারণে এই বস্ত্তগুলো নাপাক হবে।

(২) মদ পবিত্র হওয়ার ব্যাপারে দলীল:

মদ হারাম হওয়ার ঘটনায় আনাস (রাঃ) এর হাদীসে বলা হয়েছে-

فأمر رسول الله ﷺ مُنَادِيا يُنَادِي :أَلَا إِنَّ الْخَمْرَ قَدْ حُرِّمَتْ، ... قَالَ: فخرجت فأهرقتها فَجَرَتْ فِي سِكَكِ الْمَدِينَةِ

অতঃপর রাসূল (ﷺ) একজন ঘোষণাকারীকে ঘোষণা দিতে বললেন, ‘‘শুনে নাও! এখন থেকে মদ হারাম করা হয়েছে।’’আনাস বলেন, অতএব আমি গিয়ে সমস্ত মদ ফেলে দিলাম। সে দিন মদিনার অলিতে-গলিতে মদের স্রোত বয়ে গেছিল।[2]

(৩) ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে বর্ণিত হাদীস, যার কাছে দু‘মশক মদ ছিল। রাসূলুল­াহ্ (ﷺ) তাকে বললেন:

«إِنَّ الَّذِي حَرَّمَ شُرْبَهَا حَرَّمَ بَيْعَهَا، فَفَتَحَ الرجل الْمَزَادَتَيْنِ، حَتَّى ذَهَبَ مَا فِيهِمَا»

যিনি এটা পান করা হারাম করেছেন তিনিই এটা বিক্রি করাও হারাম করেছেন। অতঃপর ব্যক্তিটি মশক দু‘টি খুলে সম্পূর্ণ মদ ঢেলে ফেললেন।[3]

যদি মদ নাপাক হতো তাহলে অবশ্যই মহানাবী (ﷺ) জমিনে পানি ঢেলে তা পবিত্র করার আদেশ দিতেন, যেমনটি তিনি জনৈক বেদুঈন লোকের পেশাব করার কারণে তাতে পানি ঢেলে দেয়ার আদেশ দিয়েছিলেন এবং তা থেকে সতর্কতা অবলম্বন করতে নির্দেশ দিয়েছেন । আর যদি তা নাপাক হতো তাহলে মশক ওয়ালা ব্যক্তিকে তার মদ ঢেলে ফেলার পর মশক দু’টি ধুয়ে ফেলতে বলতেন।

(৪) মূলতঃ মদ পবিত্র। পবিত্র ছাড়া ভিন্ন কিছু গ্রহণ করা যাবে না, যতক্ষণ না সহীহ দলীল পাওয়া যাবে। যেহেতু এটা নাপাক হওয়ার ব্যাপারে দলীল পাওয়া যায় না, সুতরাং মদ মূলত পবিত্র হওয়ার উপর বহাল থাকবে। আল্লাহ্‌ই সর্বাধিক অবগত।

[1] ইবনে আসীর প্রণীত নিহায়্যাহ, লিসানুল আরাব, মুখতারম্নস সিহাহ ও তাফসীর সমূহ।

[2] বুখারী হা/ ২৩৩২; মুসলিম হা/ ১৯৮০

[3] মুসলিম হা/ ১২০৬; মুয়াত্তা মালেক হা/ ১৫৪৩