এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿يَٰعِبَادِ لَا خَوۡفٌ عَلَيۡكُمُ ٱلۡيَوۡمَ وَلَآ أَنتُمۡ تَحۡزَنُونَ ٦٨ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ بَِٔايَٰتِنَا وَكَانُواْ مُسۡلِمِينَ ٦٩ ٱدۡخُلُواْ ٱلۡجَنَّةَ أَنتُمۡ وَأَزۡوَٰجُكُمۡ تُحۡبَرُونَ ٧٠ يُطَافُ عَلَيۡهِم بِصِحَافٖ مِّن ذَهَبٖ وَأَكۡوَابٖۖ وَفِيهَا مَا تَشۡتَهِيهِ ٱلۡأَنفُسُ وَتَلَذُّ ٱلۡأَعۡيُنُۖ وَأَنتُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٧١ وَتِلۡكَ ٱلۡجَنَّةُ ٱلَّتِيٓ أُورِثۡتُمُوهَا بِمَا كُنتُمۡ تَعۡمَلُونَ ٧٢ لَكُمۡ فِيهَا فَٰكِهَةٞ كَثِيرَةٞ مِّنۡهَا تَأۡكُلُونَ ٧٣﴾ [الزخرف: ٦٨، ٧٣]
“হে আমার বান্দাগণ, আজ তোমাদের কোনো ভয় নেই এবং তোমরা চিন্তিতও হবে না। যারা আমার আয়াতে ঈমান এনেছিল এবং যারা ছিল মুসলিম। তোমরা সস্ত্রীক সানন্দে জান্নাতে প্রবেশ কর। স্বর্ণখচিত থালা ও পানপাত্র নিয়ে তাদেরকে প্রদক্ষিণ করা হবে, সেখানে মন যা চায় আর যাতে চোখ তৃপ্ত হয় তা-ই থাকবে এবং সেখানে তোমরা হবে স্থায়ী। আর এটিই জান্নাত, নিজদের আমলের ফলস্বরূপ তোমাদেরকে এর অধিকারী করা হয়েছে। সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে অনেক ফলমূল, যা থেকে তোমরা খাবে। [সূরা যুখরুফ, আয়াত: ৬৮-৭৩]
এ আয়াতগুলো থেকে আমরা যা জানতে পারলাম:
এক. জান্নাতবাসীদের কোনো ভয় থাকবে না আর থাকবে না কোনো দু:শ্চিন্তা। দুনিয়ার জীবনে মানুষ যত সম্পদের অধিকারী হোক না কেন আর সে যতই সুখী হোক, তার ভয় থাকে, থাকে দু:শ্চিন্তা। কিন্তু জান্নাতে এক অনন্য বৈশিষ্ট হলো, সেখানে কোনো পেরেশানী, দু:খ-কষ্ট, উদ্বেগ, দুঃশ্চিন্তা ভয় কিছুই থাকবে না।
দুই. ঈমান ও ইসলাম দুটো দুই বিষয়। যেমন, এ আয়াতে দুটোকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তিন. যারা জান্নাতের অধিকারী হবে তাদের স্ত্রী, স্বামী ও সন্তান-সন্তদি যদি ঈমানদার ও সৎকর্মশীল হয় তাহলে তারা জান্নাতে একত্রেই থাকবে। যেমন এ আয়াতে স্বামী ও স্ত্রীসহ জান্নাতে প্রবেশ করতে বলা হবে বলে বাণী এসেছে।
অন্য আয়াত আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَٱتَّبَعَتۡهُمۡ ذُرِّيَّتُهُم بِإِيمَٰنٍ أَلۡحَقۡنَا بِهِمۡ ذُرِّيَّتَهُمۡ وَمَآ أَلَتۡنَٰهُم مِّنۡ عَمَلِهِم مِّن شَيۡءٖۚ كُلُّ ٱمۡرِيِٕۢ بِمَا كَسَبَ رَهِينٞ ٢١ وَأَمۡدَدۡنَٰهُم بِفَٰكِهَةٖ وَلَحۡمٖ مِّمَّا يَشۡتَهُونَ ٢٢ يَتَنَٰزَعُونَ فِيهَا كَأۡسٗا لَّا لَغۡوٞ فِيهَا وَلَا تَأۡثِيمٞ ٢٣ ۞وَيَطُوفُ عَلَيۡهِمۡ غِلۡمَانٞ لَّهُمۡ كَأَنَّهُمۡ لُؤۡلُؤٞ مَّكۡنُونٞ ٢٤ وَأَقۡبَلَ بَعۡضُهُمۡ عَلَىٰ بَعۡضٖ يَتَسَآءَلُونَ ٢٥ قَالُوٓاْ إِنَّا كُنَّا قَبۡلُ فِيٓ أَهۡلِنَا مُشۡفِقِينَ ٢٦﴾ [الطور: ٢٠، ٢٥]
“আর যারা ঈমান আনে এবং তাদের সন্তান-সন্তুতি ঈমানের সাথে তাদের অনুসরণ করে, আমরা তাদের সাথে তাদের সন্তানদের মিলন ঘটাব এবং তাদের কর্মের কোনো অংশই কমাব না। প্রত্যেক ব্যক্তি তার কামাইয়ের ব্যাপারে দায়ী থাকবে। আর আমি তাদেরকে অতিরিক্ত দেব ফলমূল ও মাংস যা তারা কামনা করবে। তারা পরস্পরের মধ্যে পানপাত্র বিনিময় করবে; সেখানে থাকবে না কোনো বেহুদা কথাবার্তা এবং কোনো পাপকাজ। আর তাদের সেবায় চারপাশে ঘুরবে বালকদল; তারা যেন সুরক্ষিত মুক্তা। আর তারা একে অপরের মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে, তারা বলবে, পূর্বে আমরা আমাদের পরিবারের মধ্যে শঙ্কিত ছিলাম। অতঃপর আল্লাহ আমাদের প্রতি দয়া করেছেন এবং আগুনের আযাব থেকে আমাদেরকে রক্ষা করেছেন”। [সূরা আত-তূর, আয়াত: ২১-২৭]
চার. জান্নাতে মনে যা চায় ও চোখ যা দেখতে চায় তার সবকিছুই থাকবে। এমন নয় যে শুধু আল-কুরআন ও হাদীসে যা উল্লেখ করা হয়েছে শুধু সেগুলোই থাকবে। শুধু বাগান, নদী, গাছ, ফল-মুলই নয়। যা চায় মনে তার সবকিছু পাওয়া যাবে সেখানে। দুনিয়াতে একজন মানুষ যত প্রভাবশালী, ক্ষমতার অধিকারী ও ধন-সম্পদের মালিক হোক না কেন, মনে যা চায় সে তা পায় না। সে তা করতে পারে না; কিন্তু জান্নাত এ রকম নয়। সেখানে নেই কোনো সীমাবদ্ধতা।
জান্নাতে খাবার দাবার সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَٱلسَّٰبِقُونَ ٱلسَّٰبِقُونَ ١٠ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلۡمُقَرَّبُونَ ١١ فِي جَنَّٰتِ ٱلنَّعِيمِ ١٢ ثُلَّةٞ مِّنَ ٱلۡأَوَّلِينَ ١٣ وَقَلِيلٞ مِّنَ ٱلۡأٓخِرِينَ ١٤ عَلَىٰ سُرُرٖ مَّوۡضُونَةٖ ١٥ مُّتَّكِِٔينَ عَلَيۡهَا مُتَقَٰبِلِينَ ١٦ يَطُوفُ عَلَيۡهِمۡ وِلۡدَٰنٞ مُّخَلَّدُونَ ١٧ بِأَكۡوَابٖ وَأَبَارِيقَ وَكَأۡسٖ مِّن مَّعِينٖ ١٨ لَّا يُصَدَّعُونَ عَنۡهَا وَلَا يُنزِفُونَ ١٩ وَفَٰكِهَةٖ مِّمَّا يَتَخَيَّرُونَ ٢٠ وَلَحۡمِ طَيۡرٖ مِّمَّا يَشۡتَهُونَ ٢١ وَحُورٌ عِينٞ ٢٢ كَأَمۡثَٰلِ ٱللُّؤۡلُوِٕ ٱلۡمَكۡنُونِ ٢٣ جَزَآءَۢ بِمَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ٢٤ لَا يَسۡمَعُونَ فِيهَا لَغۡوٗا وَلَا تَأۡثِيمًا ٢٥ إِلَّا قِيلٗا سَلَٰمٗا سَلَٰمٗا ٢٦ وَأَصۡحَٰبُ ٱلۡيَمِينِ مَآ أَصۡحَٰبُ ٱلۡيَمِينِ ٢٧ فِي سِدۡرٖ مَّخۡضُودٖ ٢٨ وَطَلۡحٖ مَّنضُودٖ ٢٩ وَظِلّٖ مَّمۡدُودٖ ٣٠ وَمَآءٖ مَّسۡكُوبٖ ٣١ وَفَٰكِهَةٖ كَثِيرَةٖ ٣٢ لَّا مَقۡطُوعَةٖ وَلَا مَمۡنُوعَةٖ ٣٣ وَفُرُشٖ مَّرۡفُوعَةٍ ٣٤ إِنَّآ أَنشَأۡنَٰهُنَّ إِنشَآءٗ ٣٥ فَجَعَلۡنَٰهُنَّ أَبۡكَارًا ٣٦ عُرُبًا أَتۡرَابٗا ٣٧ لِّأَصۡحَٰبِ ٱلۡيَمِينِ ٣٨ ثُلَّةٞ مِّنَ ٱلۡأَوَّلِينَ ٣٩ وَثُلَّةٞ مِّنَ ٱلۡأٓخِرِينَ ٤٠﴾ [الواقعة: ١٠، ٤٠]
“আর অগ্রগামীরাই অগ্রগামী। তারাই সান্নিধ্যপ্রাপ্ত। তারা থাকবে নিআমতপূর্ণ জান্নাতসমূহে। বহুসংখ্যক হবে পূর্ববর্তীদের মধ্য থেকে, আর অল্পসংখ্যক হবে পরবর্তীদের মধ্য থেকে। স্বর্ণ ও দামী পাথরখচিত আসনে! তারা সেখানে হেলান দিয়ে আসীন থাকবে মুখোমুখি অবস্থায়। তাদের আশ-পাশে ঘোরাফেরা করবে চির কিশোররা, পানপাত্র, জগ ও প্রবাহিত ঝর্ণার শরাবপূর্ণ পেয়ালা নিয়ে। তা পানে না তাদের মাথা ব্যথা করবে, আর না তারা মাতাল হবে। আর (ঘোরাফেরা করবে) তাদের পছন্দ মতো ফল নিয়ে। আর পাখির গোশত নিয়ে, যা তারা কামনা করবে। আর থাকবে ডাগরচোখা হূর। যেন তারা সুরক্ষিত মুক্তা। তারা যে আমল করত তার প্রতিদানস্বরূপ। তারা সেখানে শুনতে পাবে না কোনো বেহুদা কথা এবং না পাপের কথা; শুধু এই বাণী ছাড়া, সালাম, সালাম। আর ডান দিকের দল; কত ভাগ্যবান ডান দিকের দল! তারা থাকবে কাঁটাবিহীন কুলগাছের নিচে, আর কাঁদিপূর্ণ কলাগাছের নিচে, আর বিস্তৃত ছায়ায়, আর সদা প্রবাহিত পানির পাশে, আর প্রচুর ফলমূলে, যা শেষ হবে না এবং নিষিদ্ধও হবে না। (তারা থাকবে) সুউচ্চ শয্যাসমূহে; নিশ্চয় আমি হূরদেরকে বিশেষভাবে সৃষ্টি করব। অতঃপর তাদেরকে বানাব কুমারী, সোহাগিনী ও সমবয়সী। ডানদিকের লোকদের জন্য। তাদের অনেকে হবে পূর্ববর্তীদের মধ্য থেকে। আর অনেকে হবে পরবর্তীদের মধ্য থেকে”। [সূরা আল-ওয়াকিয়া, আয়াত: ১০-৪০]
হাদীসে এসেছে: জাবির ইবন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন,
«إِنَّ أَهْلَ الْجَنَّةِ يَأْكُلُونَ فِيهَا وَيَشْرَبُونَ، وَلَا يَتْفُلُونَ وَلَا يَبُولُونَ وَلَا يَتَغَوَّطُونَ وَلَا يَمْتَخِطُونَ» قَالُوا: فَمَا بَالُ الطَّعَامِ؟ قَالَ: «جُشَاءٌ وَرَشْحٌ كَرَشْحِ الْمِسْكِ، يُلْهَمُونَ التَّسْبِيحَ وَالتَّحْمِيدَ، كَمَا تُلْهَمُونَ النَّفَسَ»
“জান্নাতবাসীরা জান্নাতে খাবে, পান করবে কিন্তু তারা থুথু ফেলাবে না, প্রসাব করবে না, পায়খানা করবে না, বমি করবে না। এ কথা শুনে সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, তাহলে খাবার দাবার কোথায় যাবে? তিনি বললেন, ঢেকুর হয়ে মৃগনাভীর সুগন্ধ নিয়ে বের হয়ে যাবে। যেভাবে শাস-প্রশ্বাস নেওয়া হয়, এভাবেই জান্নাতবাসীরা আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ ও তাহমীদ করতে থাকবে”।[1]
এ হাদীসটি থেকে আমরা জানতে পারলাম:
এক. জান্নাতবাসীরা খাওয়া-দাওয়া করবে কিন্তু এ জন্য তাদের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হবে না।
দুই. তাদের পানাহারকৃত বস্তুগুলো ঢেকুরের সাথে বের হয়ে যাবে। আর এ ঢেকুর কোনো বিরক্তির কারণ হবে না। বরং সুগন্ধ ছড়াবে।
তিন. জান্নাতবাসীরা আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা বা তাহমীদ ও পবিত্রতা বর্ণনা বা তাসবীহ আদায় করবে। কিন্তু এ জন্য তাদের আলাদা কোনো পরিশ্রম করতে হবে না। যেমন আমাদের শ্বাস প্রশ্বাস নিতে কোনো পরিশ্রম বা ইচ্ছা করতে হয় না।