الشفاعة অর্থ হলো উপায়, মাধ্যম উসীলা, ব্যবস্থা ইত্যাদি। আর শরী‘আতের পরিভাষায় শাফা‘আত অর্থ হলো, سؤال الخير للغير অন্যের জন্য কল্যাণের আবেদন করা। الشفاعة শব্দটি الشفع থেকে নেওয়া হয়েছে। ইহা الوتر শব্দের বিপরীত। شفع অর্থ জোড় আর وتر অর্থ বেজোড়। শাফা‘আতকারী তার আবেদনের সাথে সুপারিশ প্রার্থীর আবেদনকেও শামিল করে নেয় বলেই তাকে সুপারিশকারী বলা হয়। অথচ এর আগে সে ছিল একাকী।
কুরআন ও হাদীছের দলীল দ্বারা এমন শাফা‘আত সত্য বলে সাব্যস্ত, যার শর্তাদি বাস্তবায়ন হয়।
(১) আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে শাফা‘আত করার অনুমতি পাওয়া এবং শাফা‘আত প্রার্থীর উপর আল্লাহর সন্তুষ্টি বিদ্যমান থাকা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَكَم مِّن مَّلَكٍ فِي السَّمَاوَاتِ لَا تُغْنِي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا إِلَّا مِن بَعْدِ أَن يَأْذَنَ اللَّهُ لِمَن يَشَاءُ وَيَرْضَىٰ﴾
‘‘আসমানে অনেক ফেরেশতা আছে, যাদের সুপারিশও কোনো কাজে আসবে না। যতক্ষণ না আল্লাহ নিজ ইচ্ছায় যাকে খুশি তার জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দান করেন’’। (সূরা আন্ নাজম: ২৬) এ আয়াত দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে যে দু’টি শর্তে শাফা‘আত উপকারে আসবে।
প্রথম শর্ত: শাফ‘আতকারীকে শাফা‘আত করার পূর্বে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে শাফা‘আতের অনুমতি লাভ করতে হবে।
কেননা শাফা‘আত আল্লাহ তা‘আলার সম্পূর্ণ মালিকানাধীন। আল্লাহ তা‘আলা সূরা যুমারের ৪৪ নং আয়াতে বলেন, ﴿قُلْ لِلَّهِ الشَّــفَاعَةُ جَمــِيعًا﴾ ‘‘বলো, সমস্ত শাফা‘আত কেবল আল্লাহরই মালিকানাধীন’’।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,﴿ مَنْ ذَاالَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ﴾ ‘‘কে আছে আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত তার কাছে সুপারিশ করবে?’’ (সূরা বাকারা: ২৫৫)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,﴿مَا مِن شَفِيعٍ إِلَّا مِن بَعْدِ إِذْنِهِ﴾ ‘‘কোনো শাফায়াতকারী এমন নেই, যে তার অনুমতি ছাড়া শাফায়াত করতে পারে।
দ্বিতীয় শর্ত: যার জন্য সুপারিশ করা হবে তার প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকা অপরিহার্য। অর্থাৎ তাকে তাওহীদপন্থী হতে হবে। কেননা মুশরেকের জন্য সুপারিশ কোনো উপকারে আসবেনা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴾ فَمَا تَنفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ ﴿ ‘‘সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কাজে আসবে না’’।
কবরপূজারীরা বর্তমানে মৃতদের কাছে যে শাফা‘আত চাচ্ছে এবং বিভিন্ন প্রকার ইবাদতের মাধ্যমে যারা কবরবাসীদের নৈকট্য হাসিলের চেষ্টা করে উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে তাদের কর্ম-কান্ড বাতিল প্রমাণিত হলো। এসব কবরপূজারীদের পূর্বসূরীদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ﴾
‘‘আর তারা ইবাদত করে আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে এমন বস্তুর, যা তাদের কোনো ক্ষতি সাধন করতে পারে না এবং তাদের কোনো উপকারও করতে পারে না। তারা বলে, এরা তো আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী। বলো, তোমরা কি আল্লাহ্কে এমন বিষয়ে অবহিত করছ, যা তিনি অবহিত নন আসমান ও যমীনের মাঝে? তিনি পবিত্র ও মহান সেসব বস্তু থেকে যাকে তোমরা শরীক করছো’’। (সূরা ইউনুস: ১৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿أَمِ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ شُفَعَاءَ قُلْ أَوَلَوْ كَانُوا لَا يَمْلِكُونَ شَيْئًا وَلَا يَعْقِلُونَ قُلْ لِلَّهِ الشَّــفَاعَةُ جَمــِيعًالَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ﴾
‘‘তবে কি ওরা আল্লাহকে ছেড়ে অন্যদেরকে সুপারিশকারী স্থির করে নিয়েছে? বলো, ওদের কোনো ক্ষমতা না থাকলে এবং ওরা না বুঝলেও কি? বলো, সমস্ত শাফা‘আত কেবল আল্লাহরই মালিকানাধীন। আকাশ-মন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই। অতঃপর তার নিকটেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে’’। (সূরা যুমার: ৪৩-৪৪)
আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাফা‘আত করবেন। যার জন্য তাকে শাফা‘আত করার অনুমতি দেয়া হবে তিনি তার জন্য তা করবেন।
শাইখুল ইসলাম বলেন, কিয়ামতের দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তিনটি শাফা‘আত হবে।
১) শাফা‘আতে উয্মা: এ শাফা‘আত হবে মাকামে মাহমুদে। তিনি হাশরের মাঠে উপস্থিত সকলের জন্য শাফা‘আত করবেন। যাতে তাদের মধ্যে দ্রুত ফায়ছালা করা হয়। নবীগণ যেমন আদম, নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিমুস সালাম এর কাছে সুপারিশ করার আবেদন নিয়ে যাওয়ার পর তারা সবাই যখন অপারগতা প্রকাশ করবে তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে আসা হবে।
২) জান্নাতীদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানোর শাফা‘আত: হিসাবের পর জান্নাতীদেরকে দ্রুত জান্নাতে প্রবেশের অনুমতির জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর নিকট শাফা‘আত করবেন। উপরোক্ত দুই প্রকারের শাফা‘আত কেবল তার জন্যই নির্দিষ্ট হবে।
৩) তাওহীদ পন্থীদের মধ্য হতে যাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত হয়ে যাবে, তাদেরকে তথায় না পাঠানোর শাফা‘আত: যেসব গুনাহগারদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত হয়ে যাবে, তাদেরকে জাহান্নামে না পাঠানোর জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবেন। তিনি ছাড়া অন্যান্য নবীগণ, সিদ্দীক এবং অন্যরাও এ প্রকার শাফা‘আত করার সুযোগ পাবেন। যারা জাহান্নামে যাওয়ার হকদার হয়ে গেছে, তাদেরকে জাহান্নামে না দেয়ার জন্য সুপারিশ করবেন এবং যারা জাহান্নামে প্রবেশ করেছে, তাদেরকে বের করে আনার জন্যও সুপারিশ করবেন।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, তার উম্মতের কবীরা গুনাহকারীদের জন্য সুপারিশ করার বিষয়টি সাহাবী, উত্তমভাবে তাদের অনুসরণকারী তাবেঈ, মুসলিমদের চার ইমাম এবং অন্যান্য আলেমদের ঐক্যমত দ্বারা সমর্থিত। কিন্তু অনেক বিদআতী যেমন খারেজী, মু‘তাযিলা এবং যায়েদীয়া সম্প্রদায় পাপীদের জন্য শাফা‘আত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে যে, যারাই জাহান্নামে যাবে তারা আর সেখান থেকে বের হবে না। কারো শাফা‘আতের মাধ্যমেও না এবং অন্যভাবেও না। তাদের কাছে কথা একটাই। যারা জান্নাতে যাবে, তারা আর কখনো জাহান্নামে যাবেনা এবং যারা জাহান্নামে যাবে তারা আর কখনো জান্নাতে যাবেনা। তাদের মতে একই ব্যক্তির নিকট পুরস্কার ও আযাব একত্রিত হতে পারে না।