প্রশ্নোত্তরে ফিকহুল ইবাদাত মুখবন্ধ অধ্যাপক মোঃ নূরুল ইসলাম ১ টি

আল্লাহ তাআলার হামদ ও রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরূদ পাঠ করে ইসলামী শরী'আর জীবনঘনিষ্ঠ একটি গ্রন্থের ভূমিকা শুরু করছি। জীবনকে শুদ্ধ-সঠিক পথে পরিচালনার জন্য, আল্লাহর রাস্তায় পথ চলার জন্য শরী'আর ইলম অর্জনের কোন বিকল্প নাই। ডাক্তার না হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হলে জীবন চলে, ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে ব্যবসায়ী হলেও চলে, ব্যবসায়ী না হয়ে কৃষক হলেও চলে। এর কোনটাই না হয়ে বেকার থাকলে কষ্টে হলেও জীবন চলে। কিন্তু ফিকহ শাস্ত্রের জ্ঞান অর্জন ছাড়া এ জগৎ ও পরজগৎ কোনটাই চলবে না। বরং, পরপার হবে বিভিষিকাময়।
তাই, এই শাস্ত্রের জ্ঞান অর্জন ফরজে আইন – সকলের জন্য, সকল নারী-পুরুষের জন্য, ছোট ও বড়দের জন্য। পরপারের যাত্রা শুভ ও সুন্দর করার জন্য। যারা তা শিখবে তারা হবে আল্লাহর কাছে সবিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত। মহানবী (স) বলেছেন, “আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে তিনি দীনের জ্ঞান দান করেন।” জীবনের পরতে পরতে পবিত্রতা, সালাত, সওম, যাকাত ও হজ্জ – এ বিষয়গুলো আষ্টেপিষ্ঠে জড়িত। এগুলো শুদ্ধ হলে জীবন শুদ্ধ, আর এতে ভুল হলে জীবন হয় ভুল, ফলে পরিণাম হয় মারাত্মক। এ জন্যই এ গ্রন্থটি প্রণয়ন এবং বিষয়গুলো একত্রে সন্নিবেশ করা হয়েছে। কিন্তু এগুলোর শুদ্ধাশুদ্ধি যাচাই ও বাছাইয়ে রয়েছে মতানৈক্য, মতবিরোধ, ইখতিলাফ ও দ্বিমত । শুরু হয়েছে সাহাবায়ে কেরামের যামানা থেকে। চলছে আজও, চলবে কিয়ামত পর্যন্ত। বাস্তবিকই, ফিকহ হলো মতবিরোধ ও মতানৈক্যের একটি শাস্ত্র । এখানে ঐকমত্যের সুযোগ খুব কমই । মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে কিছু লেখা এক ভয়ানক কাজ। বিষয়টি জীবনের সাথে ওঁতপ্রোতভাবে জড়িত বিধায় অনেকগুলো মাসআলা প্রতিদিনের আমলের সাথে জড়িত।

তাই অনেক ঝুঁকি নিয়ে গ্রন্থটিতে হাত দিলাম, যার পেছনে সময় লেগেছে অর্ধ যুগেরও বেশি। এ জন্য যেমনটি অধ্যয়ন করেছি, কুরআন, হাদীস ও ফিকহের গ্রন্থরাজি, তেমনি বাস্তবে এগুলোর আমল দেখেছি, মক্কা মুকাররমা ও মদীনা মনওয়ারার উলামায়ে কেরামের দৈনন্দিন জীবনে। রাসূল (স) বলেছেন, “মতবিরোধ করতে করতে আমার উম্মত এক সময় তিয়াত্তর ফিরকায় বিভক্ত হবে। এর মধ্যে বায়াত্তরটি ফিরকাই জাহান্নামী হবে; জান্নাতে যাবে মাত্র একটি ফিরকা। আর সে মুক্তিপ্রাপ্ত ফিরকাটি হবে তারা, যারা আমার ও আমার সাহাবীদের আমলের উপর অধিষ্ঠিত থাকবে”। মহান আল্লাহ বলেছেন, “যারা সব কথা শুনে, অতঃপর উত্তমগুলো আমল করে তারাই হলো হেদায়াতপ্রাপ্ত, আর তারাই বুদ্ধিমান।" (সূরা ৩৯; যুমার ১৮)।

ফিকহী মাসআলা গ্রহণ ও আমলের ক্ষেত্রে মাযহাবের ইমামগণের বিরাট অবদান রয়েছে । মাযহাবের সংখ্যা অনেক হলেও বিশ্বে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে চারটি মাযহাব। ইমামগণের সকলেরই লক্ষ্য ছিল, অধিকতর সঠিক কথা খুঁজে বের করা এবং সে অনুযায়ী আমল করা; কাউকে খাটো করে দেখা নয়। মাযহাব অর্থ কোন দল বা ফিরকা নয়; মাযহাব অর্থ হলো, মতামত। আমাদের উচিত ইমামগণের মতামতগুলোকে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করা, বুঝতে চেষ্টা করা। খুঁজে খুঁজে সহজগুলো আমল না করে দলীলের বিশুদ্ধতাকে প্রাধান্য দিয়ে উত্তমটিকে গ্রহণ করা। আমার ব্যক্তিকে নিয়ে ক’টি কথা বলছি। প্রথম জীবনে স্কুল-কলেজের ছাত্র ছিলাম, অধ্যয়ন করেছি বিজ্ঞান, শিক্ষক ছিলাম গণিতের। এরই মধ্যে দীনচর্চা শুরু করলাম। বিগত তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে কুরআন-হাদীস ও ফিকহ শাস্ত্র অধ্যয়ন ও পাঠদানের সাথে সম্পৃক্ত থাকার তাওফিক আল্লাহ তাআলা করে দিয়েছেন।

মহান আল্লাহর দয়ায় মক্কার উম্মুলকুরা ইউনির্ভাসিটিতে অধ্যয়ন ও কাবা শরীফের ক’জন ইমামের ছাত্র হওয়ার সুবাদে এশিয়া ও আফ্রিকা এবং আরব ও আজমের অনেক বিজ্ঞ উলামায়ে কিরামের সান্নিধ্যে উঠা-বসার সুযোগ হয়েছে । ফিকহী মাসআলা নিয়ে মতবিনিময় ও আলোচনা-পর্যালোচনায় সুযোগ হয়েছে। তাছাড়া মক্কা শরীফের উম্মুলকুরা ইউনিভার্সিটিতে প্রথমেই ফি পড়ি একজন হানাফী উস্তাযের কাছে। এরপর মালেকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী উস্তাযগণের কাছে ফিকহ ও কুরআনহাদীস অধ্যয়ন করি । দেখেছি, তাদের উদারতা, জ্ঞানের গভীরতা এবং পাণ্ডিত্য। এ গ্রন্থে কোন দল-উপদলের প্রতি প্রভাবিত হয়ে একতরফাভাবে কোন কিছু লিখা হয়নি । যেটাকেই সত্যের অধিকতর কাছাকাছি দেখেছি সেটিকেই প্রাধান্য দিয়েছি; কারো অন্ধ সমর্থন করে নয়। কোন কোন মাসআলা কারো কারো কাছে নতুন মনে হতে পারে। কিন্তু আমি সহীহ হাদীসকে প্রাধান্য দিয়েই তা লিখেছি। কোন হাদীসকে তো আমি গোপন করতে পারি না।

কেননা, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, “যারা হাদীস গোপন করবে আল্লাহ তাআলা তাদের মুখে আগুনের লাগাম পরিয়ে দেবেন।” আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে কোথাও যেন ভুল না করে ফেলি সেজন্য যতটুকু সম্ভব মেহনত করেছি । শুদ্ধাশুদ্ধি যাচাই ও দলীল সংযোজনে অনেক পরিশ্রম করেছি। আয়াত ও হাদীসের নাম্বারিং করেছি অধিকাংশ জায়গায়। কউমী, আলীয়া, দেওবন্দী, মক্কী ও মাদানী - মুফতী, মুহাদ্দেস, মুফাসির ও নবীন-প্রবীণ নানা স্তরের অনেক বিজ্ঞ আলেম-উলামার সাথে দেখা করেছি, মতবিনিময় করেছি। যেটি জানি না তা জানার চেষ্টা করেছি, যা বুঝি না তা বুঝার চেষ্টা করেছি, শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। এরপরও আমরা কেউই ভুলের উর্ধ্বে নই ।
সকল পাঠকবর্গের কাছে বিনীত অনুরোধ যেকোন প্রকার ভুল-ত্রুটি নযরে আসলে মেহরবানী করে নিম্ন ঠিকানায় আমাকে জানাবেন, যাতে পরবর্তী সংস্করণে সংশোধন করে নিতে পারি । ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ সালাত এবং তা আদায়ের পূর্বশর্ত হলো পবিত্রতা অর্জন । এর সাথে সাওম, যাকাত ও হজ্জ – ইসলামের এ গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভগুলো নিয়ে জিজ্ঞাসা ও জবাবের আকারে প্রণীত অতীব জরুরি একটি মাসায়েল গ্রন্থ এই প্রশ্নোত্তরে ফিকহুল ইবাদাত
‘সবুজপত্র পাবলিকেশন্স’কে ধন্যবাদ, এ ধরনের একটি মৌলিক ও অত্যাবশকীয় গ্রন্থ প্রকাশে এগিয়ে আসার জন্য। বইটি সকলের কাছে সমাদৃত হোক, ঘরে ঘরে পৌছুক। আর তা নাজাতের উছিলা হোক আমাদের সবার। আমীন!

অধ্যাপক মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম মক্কী
সভাপতি: সিরাজনগর উম্মুল কুরা মাদরাসা
পো: রাধাগঞ্জ বাজার, জেলা: নরসিংদী