শির্ক কী ও কেন? চতুর্থ পরিচ্ছেদ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী ১ টি
১২. নিম্নজগতের উপর উর্ধ্বজগতের তারকারাজির প্রভাবে বিশ্বাস করা

তারকারাজি সৃষ্টির পিছনে মহান আল্লাহর কী উদ্দেশ্য রয়েছে, প্রথম অধ্যায়ে জ্ঞানগত শির্কের আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা তা আলোচনা করেছি। এখানে যে কথাটি বলতে চাই তা হলো- নিম্ন জগতের উপর উর্ধ্বজগতের তারকা ও গ্রহের প্রভাবের এ ধরনের বিশ্বাস যে শুধু জ্যোতির্বিদ ও সাধারণ মানুষের মধ্যেই রয়েছে তা নয়, অনেক পীর ও দরবেশগণের মাঝেও এ-জাতীয় বিশ্বাস রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ চরমোনাই এর প্রথম পীর জনাব সৈয়দ মোহাম্মদ এছহাক (রহ.)-এর কথাই বলা যায়। তিনি মুরীদের প্রতি পীরের দৃষ্টির প্রভাবের কথা প্রমাণ করা প্রসঙ্গে বলেন :

‘‘প্রত্যেকটি জমীনের ক্ষমতা আছে স্বর্ণ পয়দা করার, কিন্তু ঐ জমীনেই স্বর্ণ পয়দা হইবে যেই জমীনের প্রতি ঐ তারকার দৃষ্টি পড়িয়াছে, যেই তারকার দৃষ্টিতে স্বর্ণ পয়দা হয়।’’[1]

পীর সাহেবের উক্ত কথার দ্বারা সহজেই প্রমাণিত হয় যে, কোনো একটি তারকার প্রভাবে জমীনে স্বর্ণ সৃষ্টি হয় বলে তিনি বিশ্বাস করেন। অথচ এ বিষয়টি কোনোভাবেই শরী‘আত স্বীকৃত নয়। যার প্রমাণ আমরা জ্ঞানগত শির্কের আলোচনা প্রসঙ্গে ইতোপূর্বে দিয়ে এসেছি। যারা এ জাতীয় বিশ্বাস পোষণ করে, তাদের ব্যাপারে ড. বরীকান বলেন :

‘‘কেউ যদি মনে করে যে তারকা নিজেই কিছু পরিবর্তন করে বা নিজেই কোনো কিছুর উপরে প্রভাব বিস্তার করে অথবা মনে করে যে, তা আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে কোনো কিছুতে প্রভাব বিস্তার করে, তা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মুশরিক হয়ে যাবে এবং তার এ জাতীয় ধারণা শির্কে আকবার হিসেবে গণ্য হবে। আর যদি মনে করে যে, তারকার উদয় বা অস্ত ইত্যাদির সাথে পৃথিবীতে বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ হয়ে থাকে, তা হলে তার এ শির্কটি শির্কে আসগার হিসেবে গণ্য হবে, যা পূর্ণ তাওহীদের পরিপন্থী। শির্কে আসগর হিসেবে গণ্য হবে এ কারণে যে, তারকারাজি যে নিম্ন জগতের উপর প্রভাব বিস্তার করে, এ-কথাটি শরী‘আত দ্বারা স্বীকৃত নয়। অতএব তারকার ব্যাপারে এ ধরনের কথা বলা আল্লাহর উপর না জেনে কথা বলার শামিল।’’[2]

মানুষের উপর কোনো গ্রহের প্রভাব থাকা মিথ্যা হওয়ার বাস্তব প্রমাণ :

২০০৪ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন তিনজন। তন্মধ্যে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় জর্জ ডব্লিউ বুশ আর চেলেঞ্জার জন কেরির মধ্যে। সকল মানুষেরই ধারণা ছিল এ নির্বাচনে জন কেরিই জয়ী হবেন। এ অবস্থা দৃশ্যে ভারতীয় জ্যোতিষীরাও বিশ্বজনমতের সাথে সুর মিলিয়ে এ কথাই বলেছিলেন। এ প্রসঙ্গে দিল্লীর এষ্ট্রোলজি ষ্টাডি এণ্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের প্রধান জ্যোতিষী শাস্ত্র লেখক লক্ষণ দাস মদন জানান:

‘‘মাস খানেক ধরে যুক্তরাষ্টের জনগণের মতামত জরিপে প্রেসিডেন্ট বুশ ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী জন কেরির পক্ষে সমর্থন প্রায় কাঁধে কাঁধ সমান রেখে চলছে। কিন্তু গ্রহরাশির পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, বুশ পুনরায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফিরে আসতে পারবেন না। অন্যদিকে জন কেরির রাশিফল বিশ্লেষণে দেখা যায় যে শনি গ্রহ বর্তমানে চাঁদ থেকে সরে তৃতীয় কক্ষে অবস্থান করছে যা তার জন্য সর্বাধিক অনুকূলে।

তিনি আরো বলেন, কেরির উপর প্রভাব বিস্তারকারী বুধ ও মঙ্গলগ্রহ যথাক্রমে পঞ্চম এবং তৃতীয় অক্ষ থেকে সাফল্যজনকভাবে পারস্পরিক অবস্থান পরিবর্তন করেছে। এটা মার্কিন নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্ষমতা পরিবর্তনের প্রতি ইঙ্গিতবহ। এতে উপলব্ধি হচ্ছে জন কেরি হবেন আগামী মার্কিন প্রেসিডেন্ট।’’[3]এই হচ্ছে একজন বিশিষ্ট জ্যোতিষীর মার্কিন নির্বাচন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল তার এ ভবিষ্যদ্বাণী সম্পূর্ণ মিথ্যা। নির্বাচনে জন কেরির পরিবর্তে বুশই পুনরায় বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হলেন। এতে প্রমাণিত হয়ে গেল যে, মানুষের উপর গ্রহের প্রভাব থাকার ব্যাপারে জ্যোতিষীরা আবহমান কাল থেকে যা বলে আসছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

>
[1]. সৈয়দ মোহাম্মদ এছহাক, ভেদে মা’রেফত; (ঢাকা : আল-এছহাক প্রকাশনী, সংশোধিত সংস্করণ, ১৪০২ বাংলা), পৃ. ৪৪।

[2]. ড. ইব্রাহীম আল-বরীকান, প্রাগুক্ত; পৃ. ১৪৬।

[3]. দেখুন : দৈনিক ইনকিলাব, ৩০ অক্টোবর, শনিবার, ২০০৪ খ্রি., পৃ.৬।