শির্ক কী ও কেন? দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী ১ টি
চতুর্থ প্রকার : এমন সব কেন্দ্র যেখানে কোনো কবর বা নিদর্শন কিছুই নেই

আমাদের দেশে এমনও কিছু ভুয়া কবর রয়েছে যেখানে প্রকৃত পক্ষে কোনো ওলি বা দরবেশের কোনো কবর বা নিদর্শন নেই। এ জাতীয় ভুয়া কবর মূলত এক শ্রেণীর লোকেরা জনগণের অর্থ কড়ি লুন্টন করার জন্য মিছেমিছি গড়ে তুলেছে। এ জাতীয় মিথ্যা কবরের বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে চট্রগ্রাম জেলায় অবস্থিত সূফী সম্রাট বায়েজীদ বুস্তামী -এর কবর। এ সূফী সাধক সে অঞ্চলে কেন স্বয়ং বাংলাদেশের মাটিতেই আগমন করেছিলেন কি না, এ নিয়ে বিজ্ঞজনদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। সঠিক মতানুসারে তিনি এদেশে কখনও আগমন করেন নি।[11] ইরান দেশের ‘বুস্তাম’ নামক স্থানে তিনি ইহধাম ত্যাগ করেছেন। সেখানেই রয়েছে তাঁর কবর। তা সত্ত্বেও চট্রগ্রামের নাসিরাবাদ এলাকায় তাঁর একটি স্মারক কবর রয়েছে। যার উদ্দেশ্যে সাধারণ মানুষেরা দূর-দূরান্ত থেকে তাদের মানতের টাকা কড়ি ও জীব-জন্তু নিয়ে আগমন করে।

এ জাতীয় কেন্দ্রের আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে কুমিল্লা জেলার ‘বরুড়া’ উপজেলার ‘মুগুতী’ নামক গ্রামের ফকীর রহীম আলী’র কবর। এ কবরটি মূলত সে ফকীরের বসার স্থানের উপর নির্মাণ করা হয়েছে। এ স্থানে সে বসতো। হঠাৎ একদিন সে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। প্রতারক ও সুযোগ সন্ধানীরা অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে তার বসার স্থলে কবর নির্মাণ করে এবং এখানে মানত ও শিরনী প্রেরণ করতে আরম্ভ করে। এভাবে তা মানত পূর্ণ ও প্রয়োজন পূরণের স্থানে পরিণত হয়ে যায়।

একইভাবে মাদারীপুর জেলার ‘দরগা খুলা’ নামক স্থানে ‘শাহ মাদার দরগা’ নামে আরেকটি ভুয়া কবর রয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে, শাহ মাদার নামে একজন সৎ মানুষ ছিলেন। তিনি মূলত ভারতের অধিবাসী ছিলেন। বিভিন্ন স্থান সফরের এক পর্যায়ে তিনি এখানে এসেছিলেন। অতঃপর নিজ দেশে চলে যান এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তুস্বার্থান্বেষী মহল পরবর্তীতে তাঁর বসার স্থানে একটি মাযার তৈরী করে নেয়।

পঞ্চম প্রকার : এমন সব কেন্দ্র যা বড় বড় গাছকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে

এ জাতীয় কবর দেশের সর্বত্রই কম-বেশী রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ঝিনাইদহ জেলার কোট চাঁদপুর উপজেলার ‘ফুলবাড়ী’ নামক গ্রামে এ ধরনের একটি কবর রয়েছে। যার নাম ‘ফুলবাড়ীর দরগা’। এ কবর বা দরগাটি মূলত একটি বড় পুকুর এবং এ পুকুরের পার্শ্বে অবস্থিত একটি বড় গাছ ও এর নিচে নির্মিত একটি টিনের ঘর, এ-সবের সমন্বয়ে গঠিত। এলাকার সাধারণ লোকেরা এ গাছটিকে পবিত্র মনে করে এর সম্মান করে। নিকট ও দূর থেকে এখানে মানত নিয়ে আসে এবং এ গাছের নিকট বিভিন্ন রকমের রোগ মুক্তি কামনা করে। অনেক সময় রোগীরা এ গাছের নিচে শুয়ে থাকে।

অনুরূপভাবে যশোর জেলার ‘মনিরামপুর’ উপজেলার ‘মাজিয়ালী’ নামক গ্রামেও একটি পুরাতন বড় গাছ রয়েছে, যার নিকটে রয়েছে জনৈক হিন্দু লোকের একটি ঘর। হিন্দুরা এ গাছের পূজা করে। অনেক মুসলিমও বিভিন্ন সময়ে তাদের কামনা বাসনা ও প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে এখানে মানত নিয়ে আগমন করে। মনস্কামনা পূরণের জন্য এ গাছের ডালে কোনো কোনো বস্তু ঝুলিয়ে রাখে।

অনুরূপভাবে যশোর জেলার ‘মনিরামপুর’ উপজেলার ‘মান্দারডাঙ্গা’ পীরের কবরেও একটি পুরাতন গাছ রয়েছে। সে কবরের পার্শ্বে রয়েছে একটি কুঁড়েঘর ও কয়েকটি ভুয়া কবর। এর পার্শ্বে প্রায় একশটি চুলা তৈরী করে রাখা আছে জনগণের মানতের পশু যবাই করে পাকানোর জন্যে। সাধারণ মুসলিমরা সেখানে তাদের মানতের ষাঁড় ও ছাগল নিয়ে যায় এবং তা যবাই করে সে সব চুলাতে পাক করে সবাই মিলে খায়। কোনো মহিলার সন্তান না হলে সন্তান প্রাপ্তির আশায় মাথায় কাপড় বেঁধে সে গাছের নিচে বসে থেকে গাছের একটি পাতা বা ফল নিচে পতিত হওয়ার আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। পাতা বা ফল পতিত হলে সন্তান লাভের এক রাশ আশা নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। আর কিছুই পতিত না হলে নিরাশ হয়ে ফিরে যায়।

এমনিভাবে ফরিদপুর জেলার কালেক্টরেট এলাকার সাথে সংলগ্ন একটি স্থানে যশোর রোডের নিকটে একটি বড় গাছ রয়েছে। কথিত আছে যে, শেখ ফরীদ নামের একজন ভারতীয় সাধক অত্র এলাকায় আগমন করে তাঁর সাথীদের সাথে এ গাছের নিচে বসেছিলেন। মানুষেরা পরে এ গাছের নিচে একটি মাযার তৈরী করে নেয় এবং নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই তাদের প্রয়োজন শেখ ফরীদের নিকট পেশ করার জন্য এখানে আগমন করে।[12]

ষষ্ঠ প্রকার : এমন সব কেন্দ্র যা কোনো কবর ও তৎ সংলগ্ন গাছকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে :

এ জাতীয় কেন্দ্রের উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সাতক্ষিরা জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার ‘কামারঘাতি’ নামক গ্রামে একটি কবর রয়েছে, যার নাম ‘কামারঘাতি ছোট মিয়ার দরগা’। লোকেরা এ ব্যক্তির কবরকে কেন্দ্র করে এ মাযারটি তৈরী করে থাকলেও তারা এ ব্যক্তির সঠিক নাম ও তার ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানে না। এ কবরের পার্শ্বে রয়েছে একটি বড় গাছ। লোকেরা এ কবরে যেয়ে সেখানে তাদের বিনয়ভাব প্রকাশ করে, অত্যন্ত অনুনয় বিনয় করে দো‘আ করে ছোট মিয়ার নিকট সন্তান কামনা করে। রোগ থেকে মুক্তি চায়। কবরের পার্শ্বের বড় গাছের ডালে পাথর ও ইট বেঁধে ঝুলিয়ে রাখে।

এ প্রকারের উদাহরণস্বরূপ আরো বলা যায় যে, চট্রগ্রামের বায়েজীদ বুস্তামীর ভুয়া কবরের ডান পার্শ্বে একটি গাছ রয়েছে, এ গাছের কাছে লোকের বিভিন্ন উদ্দেশ্যে আগমন করে সেখানে সুতায় একাধিক গিঁঠ দেয়। একটি উদ্দেশ্য পূর্ণ হলে এসে একটি গিঁট খুলে দেয়। এক ব্যক্তিকে গাছের গোড়ায় সুতা ঝুলিয়ে গিঁট দেয়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে সে ব্যক্তি বললো: এখানে লোকেরা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে সুতায় গিঁট দেয়। কেউ দেয় সন্তান লাভের আশায়, কেউবা দেয় ভালো চাকরী প্রাপ্তির আশায়, আবার কেউবা দেয় মানসিক প্রশান্তি লাভের আকাঙ্ক্ষায়।

এক ব্যক্তি বায়েজীদ বুস্তামীর ওসীলায় আল্লাহর নিকট দো‘আ করা প্রসঙ্গে একটি কাগজে কিছু কথা লিখে গাছের সাথে তা ঝুলিয়ে রাখে। সে তার দো‘আয় লিখেছে: ‘‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম, ওহে সূফী সম্রাট বা-এজীদ বুস্তামী! আল্লাহর নিকট আমার দো‘আ মাকবুল হওয়ার জন্য আমি আপনার মাধ্যমে ওসীলা করছি। তোমার নিকট কামনা করছি তুমি আমাকে নিরাপদে গাড়ী চালাবার তৌফিক দাও, আমাকে যাবতীয় বিপদ থেকে মুক্তি দাও এবং ভাল একটি কর্ম পাইয়ে দাও, আর এ এতীমের দো‘আ কবুল কর।’’

আমাদের দেশের ছোট বড় সাধারণ গোরস্থানগুলোতে এমনিতেই প্রাকৃতিকভাবে যে সব গাছ-পালার জন্ম হয়, সাধারণত জনগণের নিকট এগুলোর কোনো গুরুত্ব থাকে না; পক্ষান্তরে কোনো সত্যিকারের ওলি বা কথিত কোনো ওলির কবরের উপর বা নিকটে যদি কোনো বড় ধরনের গাছ বিশেষ করে কোনো বড় বট গাছ থাকে, তা হলে জনগণের কাছে এ গাছের গুরুত্ব বেড়ে যায়। তারা ওলির কবরের সম্মানের পাশাপাশি এ গাছেরও সম্মান করতে আরম্ভ করে। এ গাছের শিকড়ে সুতা বাঁধলে, এর মূল কাণ্ডে তারকাঁটা মারলে বিভিন্ন রকমের মনস্কামনা পূরণ হয় বলে তারা ধারণা করে। সিলেটের শাহ পরানের কবরে গেলে এর জ্বলন্ত প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায়।

জনগণ মনে করে ওলিদের মৃত্যুর পর তাঁদের কবরের উপর বা এর সংলগ্ন গাছের মাধ্যমে তাঁদের বিভিন্ন রকমের কারামত প্রকাশিত হয়। এ জাতীয় গাছের একটি সুন্দর উদাহরণ হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার ‘হিরনাল’ গ্রামের শাহ আলম আল-হাদী এর কবর সংলগ্ন গাছটি। এ গাছের ব্যাপারে অত্র এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে যে, কেউ এ গাছের ডাল কাটলে অথবা এর পাতা ছিড়লে সে ব্যক্তির পেটে বেদনা হয়, এর পার্শ্ব দিয়ে চলার সময় কারো পা পিঁছলে গেলে সে ব্যক্তির জ্বর হয়। আমি এ কবরের খাদেমকে এ গাছ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তখন সে বললো :

‘‘বৃটিশ শাসনামলের কোনো এক সময় ঝড়ের কারণে এ গাছের একটি ডাল ভেঙ্গে পড়ে, লোকেরা এ ডালটি সরিয়ে নিতে চাইলে তাদের পক্ষে তা সম্ভব হয় নি, বরং এর ফলে তারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। এ এলাকার সে সময়কার প্রতাপশালী হিন্দুরা হাতীর সহযোগিতায় এ ডালটি সে স্থান থেকে সরিয়ে নিতে চাইলে হাতীর দ্বারাও তা সরানো সম্ভব হয় নি। হাতীর গলায় বেধে দেয়ার পর যখন হাতী তা জোরে টান মেরেছিল তখন হাতী অস্বাভাবিক রকমের চিৎকার করেছিল। খাদেম আরো বললো : ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে কিছু লোক সে ডালটি তার পূর্ব স্থান থেকে সরিয়ে সে গাছের কাছে নিতে পেরেছিল। এরপর তারা এ ডালটিকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতে চাইলে তারা তা পোড়াতে পারে নি।

পরে আমরা এ ডালটিকে রাতের বেলা ওলির কবর ও সে গাছের মধ্যখানে একটি কুঁড়ে ঘরে রেখেছিলাম, সকালে উঠে আমরা সে ডালটি আর সে ঘরে দেখতে পাই নি’’। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের অন্তরে এ গাছের মর্যাদা ও গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। এ কবরের খাদেম ও এর ভক্তরা মনে করে এ গাছ এবং এর ডালকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত যে সব অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে, সবই হয়েছে কবরস্থ এ ওলির কারণে, এ সব তাঁর কারামত বৈ আর কিছুই নয়!!

উক্ত কবরের খাদেম এ গাছের ডাল সম্পর্কিত যা কিছু বলেছে তা যদি সত্যিই হয়ে থাকে, তা হলে শর‘য়ী দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে হবে যে, এ গাছের ডালটি কারো পক্ষে সরাতে না পারার অর্থ এ নয় যে, কবরস্থ অলিই তাঁর কারামত প্রকাশের জন্য প্রথমে তা সরাতে বারণ করেছেন; বরং ডালটি এর স্থান থেকে সরাতে না পারার পিছনে রয়েছে শয়তানের কারসাজি। শয়তান জিনরাই দীর্ঘকাল এ ডালটিকে সরাতে দেয় নি, আবার এ জিন শয়তানরাই এ ঘর থেকে অবশেষে তা রাতের আঁধারে সরিয়ে নিয়েছে।

উদ্দেশ্য এর দ্বারা সাধারণ মানুষদের নতুন করে বিভ্রান্ত করা। যাতে তারা এ গাছকে আরো বেশী করে গোপনে ভয় করে এবং আরো বেশী করে এর তা‘যীম করে, এর দ্বারা আরো বেশী করে কল্যাণের আশা করে। এভাবে তারা যেন এ গাছকে কেন্দ্র করে শির্কী চিন্তা ও কর্মের মধ্যে সর্বদা লিপ্ত থাকে। উল্লেখ্য যে, এ গাছে যে জিনের বসতি রয়েছে তাও বাস্তব একটি ঘটনার দ্বারা প্রমাণিত। একদা এক ব্যক্তির এক মেয়েকে রাতের আঁধারে জিনরা উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সে গাছে। অতঃপর ফজরের সময় তারা দূরবর্তী এক বাড়ীর আঙ্গিনায় তাকে অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে যায়।

মেয়েটি জ্ঞান ফিরে পেলে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে বললো : আমাকে কিছু অপরিচিত ব্যক্তিরা ‘হিরনাল’ এর কবরের নিকটতম গাছের ডালে নিয়ে বসিয়ে রেখেছিল।[13] এ বাস্তব ঘটনাটি আমাদের জন্য উত্তম সাক্ষ্য বহন করছে যে, এ কবরের ডাল কাটলে বা এর নিকটে কেউ হোছট খেয়ে পড়ে গেলে অসুখ হলে তা এ সব শয়তান জিনের অশুভ দৃষ্টির কারণেই আল্লাহর হুকুমে হয়েছে। এ জাতীয় সকল গাছে বসবাসকারী দুষ্ট জিনেরা সাধারণ মানুষের ঈমান নষ্ট করার জন্যে কখনও কারো কল্যাণ করে, কখনও কারো অকল্যাণ করে। আর সাধারণ মানুষদের এ কুমন্ত্রণা দেয় যে, এ সবই হচ্ছে কবরস্থ এ ওলির কারণে।

সপ্তম প্রকার : এমন সব কেন্দ্রসমূহ যা বেলায়েতের দাবীদারদের কবরে তৈরী করা হয়েছে

বেলায়েত লাভ করা বা আল্লাহর তা‘আলার ওলি হওয়া একটি উচ্চ মর্যাদা প্রাপ্তির ব্যাপার। যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভালবেসে একান্ত এখলাস ও একাগ্রতার সাথে তাঁর সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে শরী‘আতের যাবতীয় বিধি-বিধান যথাসাধ্য পালন করেন, কেবল তাঁরাই সে মর্যাদায় আরোহণ করতে পারেন। যে কেউ এ পথের পথিক হওয়ার জন্য চেষ্টা ও সাধনা করতে পারেন। তবে যেহেতু এ সাধনার উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন মুক্তি; সে জন্য শর‘য়ী দৃষ্টিকোণ থেকে কেউ এ পথে অনেক দূর অগ্রসর হলে তিনি জনগণের কাছে তা প্রকাশ করতে পারেন না। বা এ দাবীও করতে পারেন না যে, আমি আল্লাহর ওলি হয়ে গেছি। যদি কেউ নিজের জন্য এ ধরনের দাবী করেন, তবে তিনি কোনভাবেই প্রকৃত ওলি হতে পারেন না।

কিন্তু আফসোসের বিষয় এ ধরনের বেলায়েতের দাবীদারদের সংখ্যাই আমাদের দেশে অধিক। তারা মনে করেন, কোনো পীরের হাতে বায়‘আত গ্রহণ করলে এবং নিজ বাড়ীতে একটি খানকা বানিয়ে নিজ পীরের তরীকানুযায়ী মাথায় লম্বা চুল, গলায় লম্বা তসবীহ, আর গায়ে লাল সালু পরিধান করলে, জনগণের সাথে উঠা-বসা থেকে বিরত থাকলে, সপ্তাহে কমপক্ষে একদিন ভক্তদের সাথে একত্রিত হয়ে উচ্চৈঃস্বরে যিকির করলে, নিজ পীর, বড়পীর আব্দুল কাদির জীলানী ও খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী এর বার্ষিক ওরস পালন করে সেখানে কিছু গান-বাজনা, মদ ও গাঁজা খেলে ওলি হওয়া যায়। এ জাতীয় স্বঘোষিত ওলি বা পীরদের সংখ্যাই সমাজে অধিক।

প্রকৃতপক্ষে তারা পার্থিব উপার্জনের একটি সহজ পথ মনে করে এটাকে একটি পেশা হিসেবে গ্রহণ করে নিয়ে থাকে। সে জন্যেই আদম শুমারিতে তারা নিজেদের পেশাগত পরিচয় পীর বলে দিয়ে থাকেন।[14] এরা নিজেদের জীবদ্দশায় যেমন সুকৌশলে সাধারণ মানুষের ঈমান হনন করে সম্পদ অর্জন করে থাকেন, তেমনি তাদের মৃত্যুর পরেও তাদের বংশধরদের জন্য তার কবরকে পার্থিব উপার্জনের একটি সহজ উপায় হিসেবে রেখে যান। সাধারণ লোকেরা তাদের জীবদ্দশায় যেমন তাদের নানাবিধ প্রয়োজন ও মনস্কামনা পূরণের জন্য হাদিয়া, তুহফা ও মানত নিয়ে তাদের দরবারে আগমন করতো, তাদের মৃত্যুর পরেও ঠিক সেভাবেই বরং পূর্বের চেয়েও অধিক হারে আগমন করে থাকে।

অষ্টম প্রকার : এমন সব কেন্দ্র যা জীবিত বেলায়েতের দাবীদাররা নির্মাণ করেছে

অতীতে যারা বেলায়েত লাভের জন্য সাধনা করতেন, তারা সাধারণত নিজেদের প্রচার করা থেকে বিরত থাকতেন। তাঁদের কবরকে কবরে পরিণত করা থেকে আরম্ভ করে এর উপর গম্বুজ নির্মাণ করা, তাঁদের কবরকে কাপড় দ্বারা ঢাকা, উপরে সামিয়ানা টাঙ্গানো, তাঁদের উদ্দেশ্যে ইসালে সাওয়াবের নামে বার্ষিক ওরস পালন ইত্যাদি যা কিছুই বর্তমানে করা হয়ে থাকে, সে সবের জন্য তাঁরা মোটেও দায়ী নন। এ-জন্য যে, তাঁরা তো কাউকে এ সব করতে বলেন নি। কিন্তু কালের পরিক্রমায় পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আমাদের দেশে এখন বেলায়েতের দাবীদার এমন অনেক পীর রয়েছে যারা নিজেদের জন্য খানকা তৈরী করে ‘বিশ্ব জাকের মঞ্জিল’ ও ‘বাবে রহমত’ ইত্যাদি চমকপ্রদ নাম দিয়ে সেখানে ‘বিশ্ব আশেকে রাসূল সম্মেলন’র নামে ওরস পালন করে। তারা নিজেদের বাহ্যিক পোশাকাদি, মিলাদ মাহফিল ও যিকির-আযকারের অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে সাধারণ লোকদের বুঝাতে চায় যে, তারা আসলেই আল্লাহর ওলি ও তাঁর কামেল বান্দা; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা পাকা প্রতারক, ধোঁকাবাজ ও অর্থ-সম্পদের দাস।

কেননা, তাদের মধ্যে বাহ্যিক বেশভূষা ছাড়া দ্বীনের আর কিছুই নেই। তারা মূলত দুনিয়ার গোলাম ও কবর পূজারী। সে জন্যেই তারা মাঝে মধ্যে আজমীর ও বাগদাদে গমন করে। তারা বাহ্যিক কিছু কর্মকাণ্ড দ্বারা সাধারণ জনগণকে ধোঁকা দিয়ে থাকে। বাহ্যত তা তাদের কারামত মনে হলেও আসলে তা শয়তানী চক্রান্ত বৈ আর কিছুই নয়। সাধারণ লোকদেরকে প্রতারণা করার জন্য তারা শয়তানের সহযোগিতায় তা প্রকাশ করে থাকে। এ সব ধোঁকাবাজদের মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে দেওয়ানবাগের স্বঘোষিত পীর মাহবুবে খোদা দেওয়ানবাগী। সে এ মর্মে দাবী করেছে যে, সে আল্লাহ তা‘আলাকে একটি যুবকের আকৃতিতে দেখেছে। আরো দাবী করেছে যে, সে স্বপ্নের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দেহকে উলঙ্গ অবস্থায় ঢাকা ও ফরিদপুর জেলার মধ্যবর্তী একটি আবর্জনার মধ্যে পড়ে থাকতে দেখেছে।[15]

অপর এক স্বপ্নে দেখেছে: ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-তাঁর সাথে কা‘বা শরীফসহ তার আরামবাগস্থ ‘বাবে রহমত’ নামক খানকাতে আগমন করে তাকে লক্ষ্য করে বলেছেন: দেওয়ানবাগী হজ্জ করে নি বলে লোকেরা যা বলে, তা সঠিক নয় কারণ, আমি (রাসূল) সর্বক্ষণ তার সাথে রয়েছি, আর কা‘বা শরীফ সর্বদা তার সামনে রয়েছে, সে মানুষের মাঝে আমার ধর্ম প্রচার করছে, এমতাবস্থায় তার হজ্জ করার কোনো প্রয়োজন নেই।’’[16] ‘বিশ্ব আশেকে রাসূল সম্মেলন’ নামে প্রতি বছর সে তার দেওয়ানবাগের খানকাতে একটি ওরস পালন করে। রাষ্ট্রের কোনো কোনো পদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে তার গোপন আঁতাত রয়েছে। সে জন্য দেওয়ানবাগ এলাকায় সে জনগণের জমি অবৈধ দখলসহ যে সব অপরাধমূলক কর্ম করেছে, জনগণের পক্ষে এর কোনো প্রতিকার করা সম্ভব হয় নি। কা‘বা শরীফের ‘বাবে রহমত’ নামের দরজার নামে আরামবাগের খানকার নাম রাখার পিছনে ভাবটা যেন এমন যে, যারা তার এ খানকায় আগমন করবে তাদের মক্কা শরীফ যাওয়া হয়ে যাবে।

আল্লাহর রহমতে অবশেষে কিছুটা হলেও তার গোপন তথ্য ফাঁস হয়েছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে সে তার আস্তানা থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তার আস্তানা থেকে পুলিশ অনেক অস্ত্রশস্ত্রসহ কতিপয় ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীকেও পাকড়াও করেছিল।[17] তার পালিয়ে যাওয়ার পর আমি সেখানে গিয়ে এলাকার লোকজনকে তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তারা বললো: সে জমির দলীল জাল করে অনেক সাধারণ মানুষের জমি বলপূর্বক দখল করে নিয়ে এ বিশাল দরবার তৈরী করেছে। এলাকার লোকেরা তাকে পছন্দ করে না। তারা আরো বললো: প্রত্যেক জুমু‘আর দিনে এ খানকাতে তার ভক্তরা বিভিন্ন স্থান থেকে এসে সমবেত হয়। তারা তাকে সেজদা করে, নগদ টাকা দান করে এবং সে সেজদাকারীদের পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়।

এরকম পীরদের মধ্যে আরেক পীর হচ্ছে দেওয়ান মুহাম্মদ সাঈদ উদ্দিন সাঈদাবাদী।[18] যার খানকা ও আস্তানা ঢাকার সাঈদাবাদ বাস ষ্টেশনের পূর্বে অবস্থিত। কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র জ্ঞান না থাকলেও অনেকের দৃষ্টিতে সে প্রথম সারির একজন ওলি ও সাধক। সে জন্যে তার দরবারে দেশের বহু লোক তাদের সমস্যাদি সমাধান ও মনস্কামনা পূরণের জন্য ভিড় জমায়। কখনও আজমীর ও বাগদাদে গেলে জনগণের যোগাযোগের সুবিধার্থে তা পত্রিকান্তরে প্রকাশ করে যায়। আবার আগমন করলে তাও পত্রিকার মাধ্যমে জনগণকে জানিয়ে দেয়া হয়।

জনগণ তার নিকট থেকে ঝাড়ফুঁক থেকে আরম্ভ করে তার দো‘আ কামনা, সন্তান প্রাপ্তি ও সমস্যা সমাধানের জন্য যেয়ে থাকে। তার কাছে যেয়ে সন্তান লাভকারীরা মাঝে মধ্যে পত্রিকান্তরে তাদের সন্তান লাভের সংবাদটি প্রচার করে আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি তারও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং যারা এখনও তার কাছে যায় নি তাদেরকে তার নিকট যাবার উৎসাহ যোগায়। তার এ জাতীয় প্রচারাভিযান দ্বারা সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, সে সূফী হওয়াকে নিজের জন্য জনগণের সম্পদ আত্মসাতের একটি সহজ উপায় হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে।

[11]. সূফী সম্রাট বায়েজীদ বুস্তামী চট্রগ্রাম জেলায় ইসলাম প্রচারে আগমনের সংবাদটি ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত নয়। তা সত্ত্বেও এ অঞ্চলে তাঁর আগমনের জনশ্রুতি রয়েছে। আগমনের জনশ্রুতি থাকলেও তিনি যে ৭৯৪ হিজরীতে ইরানের ‘বুস্তাম’ নামক স্থানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন এবং সেখানেই তাঁর সমাধি রয়েছে, এ ব্যাপারে সকলেই একমত। তা সত্ত্বেও চট্রগ্রামের নাসিরাবাদ এলাকার একটি পাহাড়ের উপর তাঁর একটি স্মারক মাজার রয়েছে। আব্দুল মান্নান তালিব, প্রাগুক্ত; পৃ. ৯৩-৯৪।

[12]. গোলাম সাকলায়েন, প্রাগুক্ত; পৃ. ১৯৮।

[13]. হিরনালের কবরের নিকটতম ‘কাকিনীবাগ’ গ্রামের মুহাম্মদ ফরহাদ উদ্দিন দেওয়ান এর নিকট থেকে এ তথ্যটি সংগ্রহ করা হয়েছে। ঘটনাটি তার নিজের সামনে ঘটিত হয়েছে বলে সে জানায়।

[14] ১৯৮১ সালে পরিচালিত বাংলাদেশের আদম শুমারির পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২৯৮০০০ ব্যক্তি তাদের পেশাগত পরিচয় দিতে যেয়ে বলেছেন তাদের পেশা হচ্ছে পীর। দৈনিক ‘করতোয়া’ নামক একটি পত্রিকা এ সংবাদটি প্রকাশ করে এ মন্তব্য করেছে যে, এ সংখ্যাকে বাংলাদেশের মোট গ্রামের মধ্যে ভাগ করলে প্রতি গ্রামের ভাগে মোট চারজন করে ‘পীর’ পড়বে। এতে প্রমাণিত হয় যে, ‘পীর’ পেশাই এখন অন্যান্য সকল পেশার চেয়ে লাভজনক। দেখুন : দৈনিক ‘করতোয়া’, (বগুড়া : ১৮/১২/১৯৮৭ খ্রি.), পৃ.৩।

[15]. মাহবুবে খোদা দেওয়ানবাগী, রাসূল সত্যই কি গরীব ছিলেন; (ঢাকা : সূফী ফাউন্ডেশন, আরামবাগ, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), পৃ. ১২।

[16]. মাহবুবে খোদা দেওয়ানবাগী, আল্লাহ কোন্ পথে; (ঢাকা : সূফী ফাউন্ডেশন, আরামবাগ, ৩য় সংস্করণ, সন বিহীন), পৃ. ১৯৮।

[17]. দেখুন : দৈনিক ইনকিলাব, ১ম পৃষ্ঠা, তারিখ : ২৬/১২/১৯৯৯ খ্রি.।

[18]. অনেকের সাথে আলাপ করে এ ব্যক্তি সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো : এ লোকটি একজন সাধারণ মানুষ, কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে তার কোনো জ্ঞান নেই। আজমীর ও বাগদাদ গমনের মাধ্যমে সে মা‘রিফাত ও সুলুকের পথ ধরে। ধীরে ধীরে জনগণের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। তার নিকট দেশের সাধারণ জনগণের মত অনেক রাজনীতিবিদরাও গমন করে থাকেন। প্রতি সপ্তাহে জুমু‘আর নামাজের পর মিলাদ মাহফিল করা হলো তার একটি সাধারণ রীতি।