শির্ক কী ও কেন? দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী ১ টি
তাওহীদী বিশ্বাস কোন বিবর্তিত চিন্তার ফসল নয়

সুদূর অতীতকাল থেকেই মানুষের মাঝে আল্লাহ ও ধর্মীয় বিশ্বাস বর্তমান থাকার সত্যতা ও বাস্তবতা প্রমাণের পর এবার নিম্নে কতিপয় দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের কথার উদ্ধৃতি প্রদানের মাধ্যমে আমরা একথার প্রমাণ পেশ করবো যে, অনন্তকাল থেকেই মানুষের মাঝে আল্লাহর ব্যাপারে তাওহীদী চিন্তা ভাবনা বিরাজমান ছিল এবং এ বিষয়টি মানুষের মাঝে চিন্তার ক্ষেত্রে বিবর্তনের কোনো ফসল নয়।

প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মুহাম্মদ আল-গাযালী[1] এ প্রসঙ্গে বলেন : ‘‘মানুষের মধ্যে যে সকল নির্বোধরা এ ধারণা পোষণ করে যে, মেধা শক্তির আবদ্ধতা থেকেই নাকি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের জন্ম হয়েছে, অথবা যারা বলে যে, মানবিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে অধিক পারদর্শিতা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের মৌলনীতিকে নড়বড়ে করে দেয় এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ককে অতীব দুর্বল করে দেয়, তাদের এ জাতীয় ধারণা তাদের মূঢ়তা ও নির্বুদ্ধিতারই ফসল। এদের বুদ্ধিহীনতা প্রমাণের জন্য তিনি অষ্টাদশ শতকের দার্শনিক ও আকাশবিদ স্যার উইলিয়াম হরসেল (Sir William Hershel)[2]-এর বক্তব্য উপস্থাপন করেন।

হরসেল বলেছেন : ‘‘জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিধি যতই বিস্তৃত হবে ততই একজন অসীম শক্তিধর সৃজনশীল প্রজ্ঞাময়ের বর্তমান থাকার উপর প্রমাণাদি অধিক হতে থাকবে। ভূতত্ত্ববিদ, জ্যোতির্বিদ, পদার্থবিজ্ঞানী ও গণিত শাস্ত্রবিদগণ তাদের বিবিধ প্রচেষ্টা ও আবিষ্কারের দ্বারা সৃষ্টিকর্তার কথা সমুন্নত করার জন্য একটি বিজ্ঞানাগার প্রস্তুত করতে যা প্রয়োজন, তা সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত রয়েছেন’’।[3]

এর পর তিনি দার্শনিক সক্রেটিস[4] এর এ সম্পর্কিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন, যা সক্রেটিস তাঁর ছাত্র প্লেটোকে লিখে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর সে পত্রের মধ্যে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব তাঁর একত্ববাদ এবং তিনিই যে এ জগত সৃষ্টি করেছেন, সে সবের স্বীকৃতি পাওয়া যায়।

সক্রেটিস লিখেছিলেন : ‘‘এ জগত আমাদেরকে প্রকাশ করে দিচ্ছে যে, এখানে হঠাৎ করে অপরিকল্পিতভাবে কিছুই হয়ে যায় নি; বরং এর প্রতিটি অংশই একটি লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর এই লক্ষ্য তার চেয়েও উচ্চতর লক্ষ্যপানে এগিয়ে চলেছে। এ ভাবে পরিশেষে একটি চূড়ান্ত একক লক্ষ্যের দিকে পৌঁছোনো যায়। জগতের এই পূর্ণাঙ্গ বিধান তার খুঁটিনাটিসহ কোথা থেকে তৈরী হলো, যা প্রতিটি দিক থেকেই মহত্বের দ্বারা বেষ্টিত? হঠাৎ করে এমনিতেই হওয়াতো সম্ভবপর নয়। আমাদের পক্ষে যদি এ কথা বলা সম্ভব হয় যে, তা এমনিতেই তৈরী হয়েছে, তা হলে আমাদের পক্ষে এ কথাও বলা সঠিক হবে যে, নদীর বুকে ভাসমান নৌকার তক্তাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই অস্তিত্ব লাভ করেছে।

আমরা যখন জগত পরিবেষ্টিত উপাদানগুলোর দিকে তাকাই, তখন তা পরিমাণে এতো বেশী দেখতে পাই যা বুদ্ধির দ্বারা সীমাবদ্ধ করা সম্ভবপর নয়। এ সব কিছু এমনিতেই হয়ে গেছে বলে আমরা ধরে নিতে পারি না। এ জন্য একজন মহাজ্ঞানীর অস্তিত্ব মেনে নেয়া জরুরী হয়ে দাঁড়ায়...আর সে বুদ্ধিমান অস্তিত্বই হচ্ছে একক সৃষ্টিকর্তা। কারণ, প্রকৃতির সর্বত্রই এমন এক মহান সৃষ্টিকর্তার একত্ববাদের নিদর্শন বিরাজ করছে যিনি চিন্তা করার সাথে সাথেই তাঁর সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়ে যায়। তাতে ভুল-ভ্রান্তি হওয়ার কোনই অবকাশ নেই।

তিনি উপস্থিত, সর্বজ্ঞাত ও সামর্থ্যবান, তা সত্ত্বেও তাঁকে ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা অসম্ভব...তাঁর দৃষ্টান্ত সূর্যের মত যা সমস্ত দৃষ্টিশক্তিকে স্পর্শ করে, অথচ সে কাউকে তার নিজেকে দেখার অধিকার দেয় না।’’[5]

আল্লামা ইবনু কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ সক্রেটিস সম্পর্কে বলেন :

‘‘সৃষ্টিকর্তার গুণাবলী স্বীকৃতির ক্ষেত্রে তাঁর মতামত আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলী স্বীকৃতি দানকারীদের মতের কাছাকাছি ছিল। তিনি (সক্রেটিস) বলেছেন: ‘‘তিনি (সৃষ্টিকর্তা) সকল বস্তুর উপাস্য, সৃষ্টিকর্তা, নিরূপক ও পরাক্রমশালী। তাঁর উপর কেউ বিজয়ী হতে পারেনা। তিনি মহা বিজ্ঞানী। তাঁর জ্ঞান, শক্তি ও হিকমত এতই অসীম যে, তা বুদ্ধির দ্বারা ব্যক্ত করা যাবে না।

তিনি (সক্রেটিস) রাসূলগণকে স্বীকৃতি প্রদানের নিকটবর্তী ছিলেন। সৃষ্টির শুরু, পূনরুত্থান ও সৃষ্টিকর্তার গুণাবলীর ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য নবীগণের বক্তব্যের নিকটতম ছিল।’’[6]

সক্রেটিসের শিষ্য দার্শনিক প্লেটোও (জন্ম খৃ.পূর্ব ৪৩০) একত্ববাদের স্বীকৃতি প্রদানের ব্যাপারে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। তিনি বলতেন :

‘‘এ জগতের একজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছেন। তিনি অনাদি ও অনন্তকাল থেকে নিজ থেকেই আছেন। তিনি সকল জ্ঞানের আধার।’’[7]

ইংরেজ বৈজ্ঞানিক স্পেন্সার (Spencer)[8]এ প্রসঙ্গে বলেন :

‘‘আমরা এ কথার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য যে, এ মহা বিশ্বের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা প্রবাহ আমাদেরকে এমন এক মহাশক্তিমান সত্তার সন্ধান দেয়, যাঁকে অনুধাবন করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। ধর্মই সর্বপ্রথম এ সর্বশক্তিমান সত্তাকে গ্রহণ এবং মানব জাতিকে তাঁর সম্পর্কে জ্ঞান দান করে।’’[9]

স্পেন্সার আরো বলেন : ‘‘বিজ্ঞান কুসংস্কারের বিরোধী, তবে ধর্মের বিরোধী নয়, পদার্থ বিজ্ঞানের অনেক ক্ষেত্রে ধর্ম বিরোধী চেতনা পাওয়া যায়, তবে সঠিক বিজ্ঞান যা ভাসাভাসা জ্ঞানকে অতিক্রম করেছে এবং প্রকৃত জ্ঞানের গভীরে প্রবেশ করেছে, তা উপর্যুক্ত ধর্ম বিরোধী চেতনা থেকে মুক্ত। আর পদার্থ বিজ্ঞান ধর্ম বিরোধী নয়।’’[10]

যারা আল্লাহ ও ধর্মে বিশ্বাস করে না এবং জীব জগত এলোমেলোভাবে এমনিতেই সৃষ্টি ও উন্নতি লাভ করেছে বলে মনে করে, ইংরেজ বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন (Kelvin)[11] তাদের সংগে বিদ্রূপ করেন এবং আল্লাহর বর্তমান থাকা এবং তাঁর একত্ববাদের উপর হিকমত ও প্রকৃতির বিধানের মাঝে যে সব অকাট্য দলীল প্রমাণাদি রয়েছে, কোন কোন বিজ্ঞানীদের এ সবের প্রতি কোনো দৃষ্টি না দেয়াতে তিনি আশ্চর্য বোধ করে বলেন : ‘‘মানুষের পক্ষে এ কথা কল্পনা করাই কঠিন যে, কোন পরিকল্পনাকারী, সৃজনশীল শক্তির বর্তমান থাকা ছাড়াই জীবনের আরম্ভ বা তা চলমান থাকতে পারে। আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি যে, কোনো কোনো বৈজ্ঞানিক জীব সম্পর্কিত তাদের তাথ্যিক গবেষণার ক্ষেত্রে এ জগতের বিধানসমূহে (সৃষ্টিকর্তার পরিচয়ের) যে সব অকাট্য প্রমাণাদি রয়েছে, তা তারা অস্বাভাবিকভাবে এড়িয়ে গেছেন। কারণ, আমাদের চারপার্শ্বে হাজারো রকমের অকাট্য প্রমাণ উপস্থিত রয়েছে যা এক মহাশক্তিশালী ও কুশলী ব্যবস্থাপকের অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন করছে। প্রকৃতির মাঝে বর্তমান এ সব দলীল আমাদেরকে এক স্বাধীন সার্বভৌম সত্তার সন্ধান দেয়। এই প্রমাণগুলো আমাদের বলে দিচ্ছে- প্রতিটি জীবই এক, অদ্বিতীয় এবং চিরস্থায়ী মহান স্রষ্টার সৃষ্টি এবং সবাই তাঁরই উপর নির্ভরশীর।’’[12]

বৈজ্ঞানিক নিউটন বলেনঃ ‘‘সৃষ্টিকর্তা বর্তমান থাকার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ করো না; কারণ, আকস্মিক হওয়া একটি ঘটনা নিজ থেকেই এ সৃষ্টির মূল হওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই বুঝে আসার মত বিষয় নয়।’’[13]

আল্লাহকে অস্বীকারকারীদের সাথে বিদ্রূপ করে বিজ্ঞানী ফুলটির বলেন :

‘‘আল্লাহর ব্যাপারে সন্দেহ করছো কেন, তিনি যদি না থাকতেন, তবে আমার স্ত্রী আমার সাথে বেইমানী করতো, আমার খাদেম আমার সম্পদ চুরি করতো।’’[14]

বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আব্দুর রহীম (মৃত ১৯৮৭ খ্রি.) এ প্রসঙ্গে বলেন :

‘‘বস্তুত দূর অতীতকাল থেকে মানব প্রকৃতির অধ্যয়ন চালালে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ধর্মবিশ্বাস মানব প্রকৃতির গভীরে নিহিত রয়েছে। মূল আল্লাহর অস্তিত্ব বিশ্বাসেও বস্তুর্ধ্ব জগতের প্রতি লক্ষ্য আরোপে কোনো বিরোধ কোনো দিনই ছিল না। বিরোধ দেখা গেছে এ বিশ্বাসের বিশেষত্ব ও পদ্ধতি পর্যায়ে মাত্র। তার অর্থ, মূল বিশ্বাসে অতীত কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কোনো পার্থক্য বা বিরোধ দেখা দেয় নি, তার খুঁটিনাটি বিস্তারিত ব্যাপারের মধ্যেই বিরোধ সীমাবদ্ধ রয়েছে। তার অর্থ আল্লাহর অস্তিত্ব বিশ্বাসের ব্যাপারে বিশ্ব মানবতার যে পরম ঐক্য অর্জিত হয়েছে, তা চিরকাল ইতিহাসের প্রত্যেকটি পর্যায়েই লক্ষ্য করা যায়।’’[15]

তিনি এ পর্যায়ে আরো বলেন : ‘‘বহু বিশেষজ্ঞই দাবী করেছেন যে, এই বিশ্বলোকে আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফুর্ত ব্যাপার। আর কুরআনের আয়াত থেকে এ সত্য উদঘাটন অতীব সুস্পষ্ট, সে জন্য কোনো যুক্তি-প্রমাণ অবতারণার আদৌ কোনো প্রয়োজন পড়ে না। বিশেষভাবে কোনো চিন্তা-ভাবনা গবেষণারও কোনো আবশ্যকতা নেই। এ প্রসঙ্গে তিনি ইংরেজ দার্শনিক থমাস কাবেল এর বক্তব্য উদ্ধৃত করেন। থমাস বলেছেন :

‘‘যাঁরা আল্লাহর অস্তিত্ব যুক্তি-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণ করতে চেষ্টা করে, তাদের অবস্থা এ থেকে ভিন্নতর নয় যে, তারা আকাশে দৃশ্যমান সূর্যকে প্রদীপ দিয়ে দেখতে চেষ্টা করে মাত্র।’’[16]

প্রকৃতকথা হচ্ছে, যারা আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, তারা অপরিপক্ক জ্ঞানের অধিকারী। তারা এ ক্ষেত্রে যে সব ধারণার অনুসরণ করছে, পরিপক্ক জ্ঞানীদের নিকট সে সব ধারণার কোনই মূল্য নেই। তারা তাদের চিন্তা ও কথার দ্বারা আমাদেরকে আল্লাহর একথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে :

﴿ وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يُجَٰدِلُ فِي ٱللَّهِ بِغَيۡرِ عِلۡمٖ وَلَا هُدٗى وَلَا كِتَٰبٖ مُّنِيرٖ ٨ ﴾ [الحج: ٨]

‘‘মানুষের মাঝে এমনও কতক লোক রয়েছে যারা কোন জ্ঞান, প্রমাণ, ও উজ্জ্বল কিতাব ছাড়াই আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্ক করে।’’[17]

এ সব নাস্তিকদের ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে- কোনো একটি বস্তুর অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় বা তার অস্তিত্ব থাকার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা যায় যদি তা প্রমাণের জন্য কোনো দলীল প্রমাণাদি না থাকে। আল্লাহর বর্তমান থাকার বিষয়টি তো সে পর্যায়ে পড়ে না; কারণ, তাঁর অস্তিত্বের যাবতীয় প্রমাণাদি চক্ষুষ্মানদের জন্য পরিষ্কার হয়ে রয়েছে। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এ দু’য়ের মধ্যে যা কিছু রয়েছে সবাই মিলে আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর একত্ববাদেরই সাক্ষ্য প্রদান করছে। সে জন্য একজন কবি বলেছেন :

ألا كل شيء ما خلا الله باطل * وكل نعيم لا محالة زائل

و في كل شيء لــــــه آية * تدل على أنه الـــــــــواحد

‘‘আল্লাহ ব্যতীত সকল বস্তুই বাতিল, সকল নেয়ামত অবশ্যই বিলীন হয়ে যাবে, প্রত্যেক বস্তুতেই রয়েছে তাঁর নিদর্শন, যা তাঁর একত্ববাদের প্রতিই ইঙ্গিত বহন করছে।’’

আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর একত্ববাদের উপর অজস্র দলীল প্রমাণাদি থাকা সত্ত্বেও যখন কিছু সংখ্যক চেতনাহীন মানুষ তাঁর অস্তিত্বের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছে, সে-জন্য আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ আচরণে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন :

﴿أَفِي ٱللَّهِ شَكّٞ فَاطِرِ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ﴾ [ابراهيم: ١٠]

‘‘যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা সে আল্লাহর ব্যাপারে কি কোন সন্দেহ আছে।’’[18]

اللهم لا না, তাঁর ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশের কোনই অবকাশ নেই। সন্দেহ পোষণকারীরা তাঁকে স্বীকার করুক আর না-ই করুক, তিনি অনন্তকাল থেকে আছেন, চিরকাল ধরেই থাকবেন।

পরিশেষে আল্লাহকে অস্বীকারকারীদের বলবো : তারা যদি নিজেদের অস্তিত্বকে কোনো দিন সম্পূর্ণ অস্বীকার বা তাতে কোনো সন্দেহ পোষণ করতে পারে, তা হলে তারা আল্লাহর ব্যাপারেও তা করতে পারে- আর তা যদি না পারে এবং অবশ্যই তারা তা কস্মিনকালেও পারবে না- তা হলে তাদের পক্ষে আল্লাহকে শুধু স্বীকার করাই উচিত নয়, তাঁকে স্বীকার করে নেয়ার পাশাপাশি তাঁকে ভয় করাও উচিত। তারা যেন তাদের নিজেদের মধ্যে একটু লক্ষ্য করে; কারণ, তাদের নিজেদের অস্তিত্বের মধ্যেই তাঁর অস্তিত্বের প্রচুর প্রমাণপঞ্জী বিদ্যমান রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন :

﴿ وَفِيٓ أَنفُسِكُمۡۚ أَفَلَا تُبۡصِرُونَ ٢١ ﴾ [الذاريات: ٢١]

‘‘তোমাদের নিজেদের মধ্যেও আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ রয়েছে, তবুও কি তোমরা তা লক্ষ্য করবে না।’’[19]

তারা যেন তাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে নিহিত আল্লাহর অস্তিত্বের নিদর্শনাদির প্রতি লক্ষ্য করে অন্যান্যদের মত আল্লাহকে স্বীকার করে নেয়। এইতো পরমাণু বিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিদ, প্রাণী বিজ্ঞানী ও গণিতশাস্ত্রবিদগণ অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছেন যে, তাঁদের কাছে অনেক দলীল প্রমাণাদি রয়েছে যা এমন এক মহান অস্তিত্বের প্রমাণ করে, যিনি এই সৃষ্টি জগতকে নিয়ন্ত্রণ করছেন এবং তিনি তাঁর অসীম জ্ঞান ও করুণার দ্বারা অত্যন্ত যত্নের সাথে তা পরিচালনা করছেন।[20]

এ ছাড়া তাদের পূর্বে বিজ্ঞানের জনক সক্রেটিস ও প্লেটো যেখানে আল্লাহ ও তাঁর একত্ববাদের কথা অকপটে স্বীকার করে গেছেন, সেখানে তাদের অস্বীকৃতিতে অল্লাহর কিছুই যায় আসে না। বরং এতে তাঁকে অস্বীকারকারীদেরই মার্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

জগত শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিকদের স্বীকৃতি দ্বারা আল্লাহ ও ধর্মের সত্যতা ও বাস্তবতা প্রমাণ করার পর এবার আমরা আমাদের মূল আলোচনায় ফিরে যাবো। আর তা হলো-

সৃষ্টির সূচনালগ্নে মানুষেরা কোন্ চিন্তায় বিশ্বাসী ছিল?

এ প্রশ্নের জবাবে বলবো : হ্যাঁ, মানুষের মাঝে সর্বপ্রথম তাওহীদী চিন্তা-ভাবনাই বিরাজমান ছিল। এ বিষয়টি আমরা ঐশী বাণী ও যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করতে পারি।

ঐশী প্রমাণাদি :

আমাদের নিকট কুরআন ও হাদীসের প্রচুর প্রমাণাদি রয়েছে যা এ কথারই সত্যতা প্রমাণ করে। আর কেমন করেই বা তা হবে না! কারণ; এ কথাতো কোনভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না যে, আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করবেন, অতঃপর তাদেরকে কোনো প্রকার হেদায়াত না দিয়েই লাগামহীনভাবে ছেড়ে দেবেন। ফলে তারা যা ইচ্ছা চিন্তা করবে! কে তাদের সৃষ্টি করলো, কেনইবা করলো, কোথায় তাদের প্রস্থান? এ সব বিষয়ে তাদেরকে কিছুই না জানিয়ে এমনিতেই ছেড়ে দেয়া হবে?

কুরআনুল কারীম আমাদেরকে এ কথার প্রমাণ দিচ্ছে যে, আল্লাহ তা‘আলা মানব সৃষ্টির সূচনাতেই তাদের প্রকৃতিতে তাঁর পরিচয়ের ব্যাপারটি অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে প্রোথিত করে দিয়েছেন এবং তিনি তাঁর পরিচয়ের উপর তাদের নিকট থেকে শক্ত প্রতিশ্রুতিও নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

﴿ فَأَقِمۡ وَجۡهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفٗاۚ فِطۡرَتَ ٱللَّهِ ٱلَّتِي فَطَرَ ٱلنَّاسَ عَلَيۡهَاۚ لَا تَبۡدِيلَ لِخَلۡقِ ٱللَّهِۚ ذَٰلِكَ ٱلدِّينُ ٱلۡقَيِّمُ وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَ ٱلنَّاسِ لَا يَعۡلَمُونَ ٣٠ ﴾ [الروم: ٣٠]

‘‘তুমি নিজেকে একনিষ্ঠভাবে দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখো, এটাই আল্লাহর নিকট গৃহীত প্রকৃতি, যার উপর তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই, এটাই সরল দ্বীন; কিন্তু অধিকাংশ লোকেরা তা জানে না।’’[21]

এআয়াতে (فطر الناس عليها) এ বাক্যের দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা দ্বীন গ্রহণ ও তাঁর তাওহীদের স্বীকৃতি প্রদানের যোগ্য করে মানুষকে সৃষ্টি করার কথাই ব্যক্ত করেছেন। তাঁর তাওহীদের স্বীকৃতি দানের উপর তাদের নিকট থেকে গৃহীত প্রতিশ্রুতি প্রসঙ্গে বলেছেন :

﴿ وَإِذۡ أَخَذَ رَبُّكَ مِنۢ بَنِيٓ ءَادَمَ مِن ظُهُورِهِمۡ ذُرِّيَّتَهُمۡ وَأَشۡهَدَهُمۡ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ أَلَسۡتُ بِرَبِّكُمۡۖ قَالُواْ بَلَىٰ شَهِدۡنَآۚ أَن تَقُولُواْ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ إِنَّا كُنَّا عَنۡ هَٰذَا غَٰفِلِينَ ١٧٢ ﴾ [الاعراف: ١٧٢]

‘‘আর স্মরণ কর সেই সময়ের কথা যখন তোমার পালনকর্তা বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ হতে তাদের সন্তানদের বের করলেন এবং তাদেরকে এ প্রতিজ্ঞা করালেন যে, আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই? তারা সকলেই বললো : হ্যাঁ, আপনি আমাদের পালনকর্তা, আমি তোমাদের এ প্রতিশ্রুতির উপর সাক্ষ্য গ্রহণ করলাম যাতে কেয়ামতের দিন তোমরা এ কথা বলতে না পারো যে, এ বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না।’’[22]

অনুরূপভাবে কুরআনুল কারীম আমাদেরকে আরো বলে দিচ্ছে যে, প্রথম মানব আদম ও হাওয়া ‘আলাইহিস সালাম মানব প্রকৃতির সে বিধান মোতাবেক তাঁদের প্রতিপালকের তাওহীদের স্বীকৃতি প্রদান করতেন। সে জন্যেই তাঁরা দু’জনে জান্নাত থেকে বেরিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করার পর তাঁদের প্রতিপালকের নিকট তাঁদের অপরাধকে স্বীকার করেছিলেন এবং এককভাবে কেবল তাঁরই নিকট তাঁদের কৃত অপরাধের জন্য মার্জনা কামনা করেছিলেন। তাও আবার এমন কিছু বাক্য পাঠ করার মাধ্যমে, যা তাঁরা তাঁদের প্রতিপালকের নিকট থেকেই শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তাঁরা উভয়েই এই বলে দু‘আ করেছিলেন :

﴿رَبَّنَا ظَلَمۡنَآ أَنفُسَنَا وَإِن لَّمۡ تَغۡفِرۡ لَنَا وَتَرۡحَمۡنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٢٣ ﴾ [الاعراف: ٢٣]

‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের প্রতি জুলুম করেছি, যদি আপনি আমাদেরকে মার্জনা না করেন এবং আমাদের প্রতি দয়া না করেন, তা হলে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে শামিল হয়ে যাবো।’’[23]

এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আদম ও হাওয়া আলাইহিস সালাম যদি তাঁদের প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর তাওহীদ সম্পর্কে অবগত না হতেন, তা হলে তাঁরা ‘হে আমাদের প্রতিপালক’ (ربنا) বলে এ ভাবে এককভাবে তাঁরই নিকট তাঁদের অপরাধের স্বীকৃতি ও তা মার্জনার জন্য তাঁকে আহ্বান করতেন না।

আদম ও হাওয়া আলাইহিস সালাম যখন তাঁদের একক প্রতিপালককে চিনতেন ও জানতেন, তখন স্বাভাবিক অবস্থার দাবী হচ্ছে তাঁরা এ বিষয়টি তাঁদের সন্তানদেরকেও অবহিত করে থাকবেন। এ ছাড়া আল্লাহ তা‘আলা যে সকল মানুষের রূহের নিকট থেকে তাঁর পরিচিতির ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন, তা তো আমরা একটু আগেই অবগত হয়েছি। মানুষকে যে আল্লাহ কর্তৃক গৃহীত সে প্রতিশ্রুতির উপরেই সৃষ্টি করা হয়ে থাকে সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

«كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ عَلَى الفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ، أَوْ يُنَصِّرَانِهِ، أَوْ يُمَجِّسَانِهِ»

‘‘প্রত্যেক সন্তানই তাঁর প্রতিপালক আল্লাহর স্বীকৃতি দানের প্রকৃতির উপরেই জন্মলাভ করে, অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইয়াহূদী, খ্রিষ্টান বা অগ্নিপূজকে পরিণত করে।’’[24]

প্রথম মানুষ আদম ও হাওয়া আলাইহিমাস সালাম যখন আল্লাহর তাওহীদে বিশ্বাসী ছিলেন, সে সময় যখন অপর কোনো ধর্ম ছিল না, কোনো কিছুতে বিকৃতিও যখন একদিনে হয় না, তখন সুদীর্ঘ সময় পর্যন্ত আদম সন্তানরা যে তাওহীদী বিশ্বাসের উপরেই থাকবে, এটাই যুক্তি ও বাস্তবতার দাবী। কুরআনুল কারীম থেকেও এ যুক্তি ও বাস্তবতার সত্যতা প্রমাণিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ

﴿ كَانَ ٱلنَّاسُ أُمَّةٗ وَٰحِدَةٗ فَبَعَثَ ٱللَّهُ ٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ مُبَشِّرِينَ وَمُنذِرِينَ﴾ [البقرة: ٢١٣]

‘‘মানুষেরা (প্রথমে একই চিন্তা লালনকারী) একই জাতির্ভুক্ত ছিল। অতঃপর (তারা বিভক্ত হয়ে গেলে) আল্লাহ তা‘আলা নবীদেরকে সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে প্রেরণ করেন।’’[25]

এ-আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন :

«كَانَ بَيْنَ نُوْحٍ وَ آدَمَ عَشَرَةُ قُرُوْنٍ كُلُّهُمْ عَلَى شَرِيْعَةِ الْحَقِّ فَاخْتَلَفُوْا فَبَعَثَ اللهُ النَّبِيِّيْنَ مُبَشِّرِيْنَ وَ مُنْذِرِيْنَ»

‘‘আদম ও নূহ আলাইহিস সালাম-এর মধ্যকার দশ যুগ বা প্রজন্মের সকলেই সত্য ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, অতঃপর তারা ধর্মীয় বিষয়ে মতবিরোধে লিপ্ত হয়, ফলে তাদেরকে সত্য ধর্মের উপর পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা নবীদেরকে সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারীস্বরূপ প্রেরণ করেন।’’[26]

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা যা বলেছেন তার সত্যতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

«كَانَ بَيْنَ آَدَمَ وَ نُوْحٍ عَشَرَةُ قُرُوْنٍ كُلُّهُمْ عَلَى الإسْلاَمِ»

‘‘আদম ও নূহ আলাইহিস সালাম-এর মধ্যবর্তী দশ যুগ বা প্রজন্ম পর্যন্ত সবাই ইসলামের উপরেই প্রতিষ্ঠিত ছিল।’’[27]

মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে যে একনিষ্ঠ তাওহীদের উপরেই সৃষ্টি করেছেন, তা নিম্নোক্ত হাদীসে কুদসীর দ্বারাও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

«إِنِّيْ خَلَقْتُ عِبَادِيْ حُنَفَاءَ كُلَّهُمْ، وَإِنَّهُمْ أَتَتْهُمُ الشَّيْطَانُ فَاجْتَالَتْهُمْ عَنْ دِيْنِهِمْ، وَحَرَّمَتْ عَلَيْهِمْ مَا أَحْلَلْتُ لَهُمْ ، وَأَمَرَتْهُمْ أَنْ يُشْرِكُوْا بِيْ مَا لَمْ أَنْزِلْ بِه سُلْطَانًا»

‘‘আমি আমার বান্দাদের সকলকেই একনিষ্ঠ তাওহীদে বিশ্বাসী করেই সৃষ্টি করেছি, শয়তান এসে তাদেরকে তাদের ধর্ম থেকে বিচ্যুত করেছে, আমি তাদেরকে যা হালাল করেছিলাম সে তা তাদেরকে হারাম করেছে, আমি যে শির্ক করার ব্যাপারে কোনো দলীল অবতীর্ণ করি নি, আমার সাথে সে শির্ক করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ করেছে’’।[28] উপর্যুক্ত এ সব আয়াত ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আদম আলাইহিস সালাম থেকে পরবর্তী দশ যুগ বা প্রজন্ম পর্যন্ত তাঁর সন্তানরা তাওহীদী চিন্তা চেতনার উপরেই প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং অংশীবাদী চিন্তা-ভাবনা তাদের মধ্যে প্রথম দশ যুগ বা প্রজন্মের পরের মানুষের মাঝে অনুপ্রবেশ করেছে, যা সংশোধনের নিমিত্তে আল্লাহ তা‘আলা নূহ আলাইহিস সালামকে প্রথম রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন।

যৌক্তিক প্রমাণ :

এটা কোনো যৌক্তিক কথা হতে পারে না যে, আল্লাহ তা‘আলা প্রথমে আদম আলাইহিস সালাম-কে সৃষ্টি করার পর কিছুকাল পর্যন্ত তাঁকে তাঁর সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে কোনো জ্ঞান না দিয়েই ফেলে রাখবেন; ফলে আদম এ ব্যাপারে যা খুশী চিন্তা করতে থাকবে এবং যাকে মনে হয় তাকে তাঁর রব ও উপাস্য বানিয়ে নেবে। অনুরূপভাবে এ কথাও বিবেক সম্পন্ন হতে পারে না যে, আদম আলাইহিস সালাম নিজে তাঁর প্রতিপালককে চিনবেন ও জানবেন, অথচ তিনি তাঁর সন্তানদেরকে এ ব্যাপারে কিছুই বলবেন না; কারণ, পিতা সর্বদাই তার সন্তানকে সে উপদেশই দিয়ে থাকেন যা তার সন্তানদের জন্য একান্ত উপকারী। নিজের প্রতিপালকের পরিচয় জানা যেহেতু সকল উপকারের চেয়ে বড় উপকারের কথা; সেহেতু আদম আলাইহিস সালাম তাঁর সন্তানদেরকে যে এ বিষয়টি জানিয়ে থাকবেন, তা অন্তত নিশ্চিত করে বলা যায়।

প্রকৃতকথা হচ্ছে, যারা অংশীবাদের উপর একত্ববাদের প্রচলন হওয়ার দাবী উত্থাপন করে থাকেন, তারা তাদের ধারণানুযায়ী বিবর্তনবাদের নীতির বিশুদ্ধতার উপর নির্ভর করেই এ দাবী উত্থাপন করে থাকেন। তারা বলেন :

‘‘এক আল্লাহ সম্পর্কিত মতবাদটি মূলত একাধিক আল্লাহর চিন্তার বিবর্তিত একটি উন্নত রূপ, তবে এ বিবর্তনটি তার সরল পথ হারিয়ে একটি অজানা পথের দিকে অগ্রসর হওয়ার ফলে তা জ্ঞানীদেরকে হয়রানির মাঝে ফেলে দিয়েছে, যেমনভাবে তা একাধিক আল্লাহ এর চিন্তা থেকে এক আল্লাহর চিন্তায় ভ্রান্তভাবে বিবর্তিত হওয়ার কারণে নিজেকে একটি বিভ্রান্তির মাঝে ফেলে দিয়েছে। একাধিক আল্লাহর ধারণা একটি সামাজিক মূল্যবোধ বহন করতো, যার পরিণতি ছিল বিভিন্ন আল্লাহতে বিশ্বাসীগণ পারস্পরিক স্বীকৃতির মাধ্যমে তারা নিরাপদে ও শান্তিতে বসবাস করবে; কিন্তু এক আল্লাহর চিন্তা সর্বোচ্চ ধর্মের মতবাদ সৃষ্টি করার ফলে এ সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে দিয়েছে। এ মতবাদের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির মাঝে এমন সব অকল্যাণকর যুদ্ধ বিগ্রহ শুরু হয়েছে, যার কোনো শেষ নেই। এক আল্লাহর ধারণাটি এভাবে উল্টো দিকে বিবর্তিত হওয়ার ফলে নিজেই নিজেকে নির্মূল করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। আর এ ধরনের বিবর্তনকেই বিবর্তনবাদ বলা হয়।’’[29]

আল্লামা ওয়াহীদ উদ্দিন খান[30] তাদের এ চিন্তাধারার প্রতিবাদ করে বলেন :

‘‘আমরা কিন্তু কার্যত এ ক্ষেত্রে মূল বাস্তবতাকে এড়িয়ে চলেছি। সর্বজনবিদিত ইতিহাস এ কথা প্রমাণ করছে যে, সকলেরই এ কথা জানা যে, প্রথম প্রেরিত পুরুষ [রাসূল] ছিলেন নূহ আলাইহিস সালাম, আর তিনি জনগণকে এক আল্লাহর দিকেই আহ্বান জানাতেন। অনুরূপভাবে আমরা আরো জানি যে, একাধিক আল্লাহর মধ্যে সকলেই এক পদমর্যাদার ছিলেন না, যার অর্থ দাড়ায়: মানুষেরা বড় ইলাহ এর সাথে অন্যান্য (ছোট) ইলাহদের শরীক করে নিয়েছিল এ উদ্দেশ্যে যে, তারা (ছোট ইলাহরা) তাদেরকে বড় ইলাহ এর নিকটতম করে দেবে, তাদের জন্য দু‘আ ও শাফা‘আত করবে। এ সকল মৌলিক বিষয়াদি বর্তমান থাকার ফলে বিবর্তনবাদের মতবাদটি একটি প্রমাণবিহীন দাবীতে পরিণত হয়ে যেতে বাধ্য।’’[31]

এর পর তিনি বিবর্তনবাদ সম্পর্কে স্যার আরসর কীস এর বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি বলেছেন :

‘‘বিবর্তনবাদের মতবাদটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয় এবং দলীল প্রমাণাদি দ্বারা এর সত্যতা প্রমাণ করারও কোনো উপায় নেই। তা সত্ত্বেও আমরা এ মতবাদে বিশ্বাসী কেবল এ জন্যে যে, এতে বিশ্বাস না করলে আমাদের সামনে সরাসরি সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকে না। অথচ আমাদের পক্ষে এ বিশ্বাসের ব্যাপারে কোন চিন্তা করাও সম্ভবপর নয়।’’[32]

আমরা পশ্চিমা এ চিন্তাবিদের বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে দেখতে পেলাম যে, তারা মূলত ধর্মের চিন্তা থেকে পলায়ন করার জন্যেই এ বিবর্তনবাদের মতবাদে বিশ্বাসী হয়েছে। এটি যে একটি প্রমাণিত সত্য মতবাদ, সে জন্যে নয়।

বিবর্তনবাদের মতবাদটি যখন স্বয়ং এর প্রবক্তাদের নিকটেই সঠিক ও বিশ্বাসযোগ্য নয়, তখন এ ভ্রান্ত মতবাদের উপর নির্ভর করে কী করে এ কথা বলা যায় যে, পৃথিবীতে মানুষের সূচনা লগ্নে তাওহীদের পূর্বে অংশীবাদ এর প্রচলন ছিল। না, কস্মিনকালেও তা বলা ও বিশ্বাস করা যায় না। প্রকৃত কথা হলো: এ মতবাদে বিশ্বাসীরা মূলত ধর্ম থেকে পলায়নের জন্যেই এ ধরনের দাবী উত্থাপন করেছে মাত্র, যেমনটি আমরা স্যার আরসর কীস এর বক্তব্যের দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই বুঝতে পারলাম।

সর্বশেষে এ প্রসঙ্গে ইমাম আবু যাহরাহ[33] এর একটি বক্তব্য উল্লেখ করে এ প্রসঙ্গের ইতি টানবো। তিনি এ প্রসঙ্গে বলছেন :

‘‘ব্রাহ্মণ (হিন্দু) ধর্ম অতি প্রাচীন হওয়ায় তা ইতিহাসের গভীর থেকে গভীর পরতে প্রবেশ করেছে। এ ধর্মের অনুসারীরা প্রারম্ভে জগত ও এর পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী একটি শক্তির উপাসনা করতো, এর একত্ববাদেও তারা বিশবাস করতো, যদিও সে শক্তিকে তারা ইসলামী পরিভাষার ন্যায় আল্লাহ বলে নামকরণ করতো না এবং সেটাকে ঠিক সে ধরনের একক বলেও বিশ্বাস করতো না যেমনভাবে মুসলিমরা আল্লাহর ব্যাপারে বিশ্বাস করেন। অতঃপর তারা সে শক্তিকে দেহ সর্বস্ব করে নেয় এবং কোনো কোনো দেহে তা প্রবেশ করেছে বলেও বিশ্বাস করে। যার পরিণতিতে তারা মূর্তি পূজায় লিপ্ত হয়। এতে তাদের দেবতাদের সংখ্যা একাধিক হয়ে গিয়ে তেত্রিশটি দেবতায় পৌঁছায়। এরপর তাদের বিশ্বাসে আরো পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধিত হয়ে পরিশেষে তাদের দেবতা তিন অংশের মাঝে সীমাবদ্ধ হয় :[34]

১. ব্রহ্মা (পরমেশ্বর) : তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী দেবতার ব্রহ্মা নামের এ অংশই হলো সৃষ্টিকর্তা ও জীবনদাতা। এটি এমন শক্তি যে, সকল বস্তু এত্থেকেই জন্ম লাভ করে, সকল জীব-জন্তু তারই দয়া কামনা করে থাকে। সূর্যের সম্পর্ক রয়েছে তারই সাথে যার ফলে তাপ অর্জিত হয়, দেহসমূহ জীবনী-শক্তি লাভ করে এবং তাদের ধারণামতে জীব ও তরুলতায় এর কারণেই জীবন প্রবাহিত হয়ে থাকে।

২. শিব : তাদের ধারণামতে দেবতার এ অংশের কাজ হলো সবকিছু ধ্বংস করা। এর কারণেই সবুজ পাতা হলুদ বর্ণ হয়, যৌবনের পর বার্ধক্য আসে।

৩. বিষ্ণু : তাদের বিশ্বাস মতে দেবতার এ অংশ সকল সৃষ্টির মধ্যে প্রবেশ করে থাকে। এরই কারণে জগত পূর্ণাঙ্গভাবে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়।

তাদের ধারণামতে এ তিন দেবতা এক দেবতার অংশ বিশেষ, আর সেই এক দেবতা হলেন মহাত্মা (الروح الأعظم), তাদের ভাষায় যার নাম হলো ‘আতমা’ বা ‘আত্মা’।

পৃথিবীর বুকে বসবাসকারী একটি অতি প্রাচীনতম জাতির যদি আল্লাহ সম্পর্কে এ ধারণা হয়, তা হলে আমরা কী করে সে লোকদের দাবী সত্য বলে বিশ্বাস করতে পারি যারা বলে যে, এক আল্লাহর বিশ্বাসের পূর্বে মানুষের মাঝে একাধিক আল্লাহর বিশ্বাসই প্রচলিত ছিল।’’[35]

অবশেষে বলবো : পৃথিবীতে মানুষের সূচনা লগ্নে আল্লাহ সম্পর্কিত তাদের চিন্তাধারায় তাওহীদী চিন্তা-ভাবনা থাকার পরিবর্তে তাদের মাঝে অংশীবাদী চিন্তা-ভাবনা থাকার এ ধারণাটি সঠিক নয়; কেননা, তা কোনো প্রামাণ্য দলীল প্রমাণাদির উপর নির্ভরশীল নয়। যারা এই ধারণার অনুসারী তারা মূলত আল্লাহ ও ধর্মকে অস্বীকার করার জন্যেই এ আওয়াজ উঠিয়েছেন। এ সব লোকদের আল্লাহ ও ধর্মকে অস্বীকার করার পিছনে যে কারণ রয়েছে, সেটিকে মোট তিনভাবে চিহ্নিত করা যায় :

১. ধর্মের প্রতি একপেশে দৃষ্টি দান করার ফলে তারা ধর্মকে বাঁকা দেখতে পেয়েছেন।

২. তারা প্রচলিত সকল ধর্মগুলোকে একপাত্রে রেখে মূল্যায়ন করেছেন, তাই সকল ধর্মই তাদের দৃষ্টিতে মিথ্যা বলে মনে হয়েছে। তারা যদি ইসলামকে নিয়ে পৃথকভাবে ভাবতেন, তা হলে এর সত্যতা তাদের কাছে প্রমাণিত হতো।

৩. তারা ধর্ম ও আল্লাহর অস্বীকৃতির এ-দাবী উত্থাপন করেছেন তাদের নিজ নিজ দেশে অবস্থিত গির্জাসমূহের কর্তৃত্ব ও এর জুলুমের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যে। এ অস্বীকৃতি মূলত কোনো সত্য প্রাপ্তি ও তা প্রচারের জন্যে নয়।অতএব এ কথা অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা যায় যে, পৃথিবীর বুকে প্রথম মানুষের সময় থেকেই মহাবিজ্ঞ ও পরাক্রমশালী এক আল্লাহর বিশ্বাসই মানুষের মাঝে বিরাজমান ছিল। বিভিন্ন কারণবশত পরবর্তী সময়ে মানুষের মাঝে তাওহীদী ধ্যান-ধারণার স্থলে অংশীবাদী ধ্যান-ধারণা অনুপ্রবেশ করেছে। তা সত্ত্বেও কারো পক্ষে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী জাতিসমূহের ইতিহাস থেকে এ কথা প্রমাণ করা সম্ভব হবে না যে, মানুষেরা যাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক করে নিয়েছিল, মর্যাদার দিক থেকে তারা তাদেরকে আল্লাহর চেয়ে অধিক মর্যাদাবান বা তাঁর সমতুল্য মনে করতো, বরং বাস্তব অবস্থা এ কথাই প্রমাণ করে যে, তারা তাদের ব্যাপারে এ ধারণা পোষণ করেছিল যে, এরা তাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেওয়ার মাধ্যম ও শাফা‘আতকারী। সুদূর অতীত ও তৎপরবর্তী জাতিসমূহের ইতিহাস থেকে এ তথ্যই প্রমাণিত হয়েছে। তাই এ কথা বলা যায় যে, তাওহীদের পূর্বে মানুষের মাঝে অংশীবাদের প্রচলন ছিল বলে যারা দাবী করেন, তাদের এ দাবী সম্পূর্ণভাবে কল্পনাপ্রসূত।

[1]. তিনি মিশরের ইখওয়ানুল মুসলিমীন ইসলামী দলের একজন প্রখ্যাত নেতা ও ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন।- লেখক

[2]. হারসেল একজন ইংরেজ জ্যোতির্বিদ ছিলেন। ১৭৮১ সালে তিনি ইউরেনাস গ্রহ আবিষ্কার করেন। টেলিসকোপও তাঁরই আবিষ্কার। ১৭৩৮ থেকে ১৮২২ সাল পর্যন্ত ছিল তাঁর যুগ।- লেখক

[3]. মুহাম্মদ আল-গাযালী, ‘আক্বীদাতুল মুসলিম; (কায়রো : দারুল কুতুবিল ইসলামিয়্যাহ, সংস্করণ বিহীন, ১৯৮০ খ্রি.), পৃ. ২২; ইনসাক্লোপেডিয়া ‘‘আজাদী’’, ‘ইলাহ’ শব্দমূল, ১ম খন্ড, পৃ. ৫০৩।

[4]. তিনি একজন প্রখ্যাত গ্রীক বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ছিলেন। খৃষ্টপূর্ব ৪৭১ সালে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। আল্লাহ ও তাঁর একত্ববাদ সম্পর্কে তিনি যে সব তাত্ত্বিক কথা-বার্তা বলেছেন, তা নবী ও রাসূলগণের কথার সাথে মিলে যায়। দেখুন : গংগোহী, মাওলানা মুহাম্মদ হানীফ, জাফারুল মুহাসসিলীন বি আহওয়ালিল মুআললিফীন; (করাচী : দারুল এশা‘আত, ১ম সংস্করণ, সন বিহীন), পৃ. ১৪১।

[5]. প্রাগুক্ত।

[6]. ইবনু কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লহফান ফী মাকাইদিস শয়তান; ২/২০৯, ২১০।

[7]. প্রাগুক্ত।

[8]. স্পেন্সার (Spencert, Herber, ১৮২০-১৯০৩) একজন বৃটিশ দার্শনিক । তিনি মনস্তত্ত্বও সমাজতত্ত্বের উপর বই লেখেন।- লেখক

[9]. মুহাম্মদ আল-গাযালী, প্রাগুক্ত; পৃ. ২৩।

[10]. আস-সাইয়্যিদ আস-সাবেক, প্রাগুক্ত ; পৃ. ৫০।

[11]. Kelvin William Thomson Lord (১৮২৪-১৯০৭ খ্রি.), তিনি একজন প্রখ্যাত ইংরেজ পদার্থ বিজ্ঞানী ছিলেন। লেখক

[12]. মুহাম্মদ আল-গাযালী, প্রাগুক্ত; পৃ.২৪।

[13]. হাসানুল বান্না, মাজমূ‘আতু রাসাইলিল ইমাম আশ-শহীদ; (বৈরুত : আল-মুআছ্ছাছাতুল ইসলামিয়্যাহ, সংস্করণ বিহীন, তারিখ বিহীন), পৃ, ৩১৯।

[14]. ড. আমহদ শালাবী, মুক্বারানাতুল আদইয়ান; (কায়রো : মাকতাবাতুন নুহদাতিল মিসরীয়্যাহ, ৮ম সংস্করণ, ১৯৮৯ খ্রি.), পৃ. ৯৩।

[15]. মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুর রহীম, শির্ক ও তাওহীদ; (ঢাকা : খায়রুন প্রকাশনী, ২৫তম সংস্করণ, ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দ.) পৃ. ৩৩।

[16]. তদেব।

[17]. আল-কুরআন, সূরা হজ্জ : ৮।

[18]. আল-কুরআন, সূরা ইব্রাহীম : ১০।

[19]. আল-কুরআন, সূরা যা-রিয়াত : ২১।

[20]. মুহাম্মদ আল-গাযালী স্বীয় আক্বীদাতুল মুসলিম গ্রন্থের ২৮ পৃষ্ঠায় এ-তথ্যটি বর্ণনা করেছেন। যা রয়টার সংবাদ সংস্থার উদ্ধৃতি দিয়ে মিসরের কোনো এক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

[21]. আল-কুরআন, সূরা রূম : ৩০।

[22]. আল-কুরআন, সূরা আ‘রাফ : ১৭২।

[23]. আল-কুরআন, সূরা আরাফ : ২৩।

[24]. মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুল কদর, বাব নং:৫, হাদীস নং ২৬৫৮; ৪/২০৪৭; ইমাম আহমদ, প্রাগুক্ত; ২/২৫৩।

[25].আল-কুরআন, সূরা বাক্বারাহ : ২১৩।

[26].আত-ত্ববারী, আবু জা‘ফর মুহাম্মদ ইবন জারীর, জামিউল বয়ান ফী তাফছীরিল কুরআন; (বৈরুত : দ্বারুল ফিকর, সংস্করণ বিহীন, ১৪০৫হি:), ২/৩৩৪; আন-নীসাপুরী, আবু আব্দুল্লাহ আল-হাকিম, আল-মুসতাদরাক ‘আলাস সহীহাইন; (বৈরুত : দ্বারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৯৯০ খ্রিৃ.), ২/৫৯৬।

[27]. আত-ত্ববারী, প্রাগুক্ত; ২/৩৩৪; আল-হাকিম, প্রাগুক্ত; ২/৫৯৬; ইমাম হাকিম বলেন : ইমাম বুখারীর শর্তানুযায়ী এ হাদীসটি সহীহ। ইমাম জাহাবীও তাঁর এ মতকে সমর্থন করেছেন। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে ‘ঊফী কর্তৃক বর্ণিত অপর একটি হাদীস রয়েছে। তাতে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেছেন :

كان الناس أمة واحدة، يقول : كفارا...

‘মানুষেরা সকলেই এক জাতি ছিল। এ বাক্যের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন : তারা সকলেই কাফির ছিল..., এ মর্মে বর্ণিত হাদীসটি বিশুদ্ধ নয়; কারণ, ‘ঊফী একজন দুর্বল বর্ণনাকারী, তার বর্ণনা দ্বারা দলীল গ্রহণ করা যায় না। ইমাম ইবন কাছীর বলেন : ইবন ‘আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত প্রথম বক্তব্যটি সনদ ও অর্থের দিক থেকে বিশুদ্ধ কারণ, প্রতিমা পূজার পূর্ব পর্যন্ত মানুষেরা সকলেই আদম আলাইহিস সালামের ধর্মে বিশ্বাসী ছিল। মূর্তি পূজা শুরু হলে অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নূহ আলাইহিস সালামকে প্রেরণ করেন। ফলে তিনি পৃথিবীর জনগণের প্রতি আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক প্রেরিত প্রথম রাসূল ছিলেন। দেখুন : তাফছীরুল কুরআনিল ‘আযীম; ১/২৫০; ইবন কাইয়্যিম আল জাওযিয়্যাহ ও ইবন কাছীর এর কথাটি সঠিক হওয়ার স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। দেখুন : ইবনে কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লহফান; ২/১৬০।

[28]. মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুল জান্নাতি..., বাব নং ১৬, হাদীস নং ২৮৬৫, ৪/২১৯৭; ইমাম আহমদ, প্রাগুক্ত; ৪/১৬২।

[29]. ওয়াহীদ উদ্দিন খাঁন, প্রাগুক্ত; পৃ. ৫১-৫২। তিনি এ কথাগুলো Man of the modern world বই এর ১১২ পৃষ্টা থেকে উদ্ধৃত করেছেন।

[30]. ঊনিশ শতকে ভারতের একজন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ।

[31]. তদেব।

[32]. তদেব। এ বক্তব্যটি তিনি একটি প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত করেছেন, যা Islamic thought পত্রিকায় ডিসেম্বর ১৯৬১ খ্রি. প্রকাশিত হয়েছে।

[33]. ইমাম আবু যাহরাহ বিংশ শতাব্দির শেষার্ধের একজন প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন। ইসলামের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ নিয়ে বিশেষ করে ইসলামকে যুগোপযোগী করার ক্ষেত্রে তাঁর বহু লিখনী প্রকাশিত হয়েছে ।- লেখক।

[34]. তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন :

ومنشأ الوثنية في الديانة البرهمية أنهم كانوا يعبدون القوى المؤثرة في الكون وتقلباته في زعمهم، ثم لم يلبثوا أن جسدوا تلك القوى، بأن اعتقدوا حلولها في بعض الأجسام، فعبدوا والأصنام لحلولها فيها، و تعددت آلهتهم حتى وصلت إلى ثلاثة و ثلاثين إلها = ثم عرا عقائدهم التغيير والتبديل حتى انحصر الآلهة في ثلاثة أقانيم، وذلك أنهم توهموا أن للعالم ثلاثة آلهة...إلى آخر ما قال.

ইমাম আবু যাহরাহ, মুকারানাতুল আদইয়ান; (কায়রো : দারুল ফিকরিল ‘আরাবী, সংস্করণ বিহীন, ১৯৯১ খ্রি.), পৃ. ২৩।

[35]. তদেব; পৃ. ১৯-২৪।