কুরআনের অপূর্ব সাহিত্যিক মান, তুলনাহীন আলংকরিক বৈশিষ্ট্য, অনন্য সাধারণ বর্ণনাভঙ্গি এবং এর অলৌকিক প্রভাব যেকোন মানুষকে মুহূর্তের মধ্যে মোহিত করে ফেলে। পৃথিবীর কোন ধর্মগ্রন্থে এমন প্রভাবের কোন নযীর নেই।
(১) আবু জাহল, আবু সুফিয়ান, আখনাস বিন শারীক্ব-এর মত নেতারাও রাতের বেলা একে অপরকে লুকিয়ে গোপনে এসে রাসূল (ছাঃ)-এর তাহাজ্জুদে পঠিত কুরআন মুগ্ধ মনে শ্রবণ করত। পরপর তিনদিন একই ঘটনার পর আখনাস বিন শারীক্ব লাঠি হাতে হাঁটতে হাঁটতে আবু সুফিয়ানের বাড়ীতে এসে বললেন, হে আবু হানযালা! মুহাম্মাদের মুখ দিয়ে যা শুনলাম, সে বিষয়ে আপনার মতামত কি? তিনি বললেন, আমি ঐ কালাম বুঝতে পেরেছি এবং সেখানে যা চাওয়া হয়েছে, তাও বুঝেছি’। আখনাস বললেন, আমিও আপনার সাথে একমত। এবার তিনি হাঁটতে হাঁটতে আবু জাহলের বাড়ীতে গেলেন ও তাকে একই প্রশ্ন করলেন। জবাবে আবু জাহল বললেন, আসল কথা হ’ল, تَنَازَعْنَا نَحْنُ وَبَنُو عَبْدِ مَنَافٍ الشَّرَفَ... مِنَّا نَبِيٌّ يَأْتِيهِ الْوَحْيُ مِنَ السَّمَاءِ، فَمَتَى نُدْرِكُ مِثْلَ هَذِهِ؟ وَاللهِ لاَ نُؤْمِنُ بِهِ أَبَدًا وَلاَ نُصَدِّقُهُ ‘বনু ‘আব্দে মানাফের সাথে আমাদের বংশ মর্যাদাগত ঝগড়া আছে।... তারা বলে, আমাদের বংশে একজন নবী আছেন, যার নিকটে আসমান থেকে ‘অহি’ আসে। কবে আমরা এই মর্যাদা পাব? অতএব আল্লাহর কসম! আমরা কখনোই তার উপরে ঈমান আনব না এবং তাকে সত্য বলে বিশ্বাস করব না’। একথা শুনে আখনাস চলে এলেন’।[1] এতে বুঝা যায় যে, অতি বড় দুশমনও কুরআন দ্বারা প্রভাবিত হয়। কিন্তু যিদ ও হঠকারিতা বশে তারা পথভ্রষ্ট হয়।
(২) প্রসিদ্ধ কুরায়েশ নেতা উৎবা বিন রাবী‘আহ একদিন আবু জাহল ও অন্য নেতাদের পরামর্শ মতে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে এলেন। ইনি একই সাথে জাদুবিদ্যা, ভবিষ্যদ্বাণী ও কবিতায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি এসে রাসূল (ছাঃ)-এর অনেক প্রশংসা করলেন। অতঃপর তাকে তাওহীদ প্রচার বন্ধের বিনিময়ে নেতৃত্ব, দশজন সুন্দরী স্ত্রী ও বিপুল ধন-সম্পদ দানের লোভনীয় প্রস্তাব দিলেন। রাসূল (ছাঃ) সবকিছু শোনার পর তাকে সূরা হা-মীম সাজদাহ ১-১৩ আয়াত পর্যন্ত শুনালেন। এ সময় ওৎবা আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে তার মুখে হাত দিয়ে কুরআন পাঠ বন্ধ করতে বললেন। ফিরে আসার পর তিনি নেতাদের কাছে বলেন, আল্লাহর কসম! আমি এমন কথা শুনেছি, যা আমার দু’টি কান কখনো শোনেনি। আল্লাহর কসম! এটি জাদু নয়, এটি কবিতা নয়, এটি কোন ভবিষ্যৎ কথন নয়। হে কুরায়েশগণ! তোমরা আমার কথা শোন! তোমরা এ মানুষটিকে ছেড়ে দাও। যদি তিনি আরবদের উপর বিজয়ী হন, তাহ’লে তার রাজত্ব তোমাদের রাজত্ব। তার সম্মান তোমাদের সম্মান। তার মাধ্যমে তোমরা হবে সৌভাগ্যবান। তোমরা জানো মুহাম্মাদ কখনো মিথ্যা বলেন না। আমি ভয় পাচ্ছি তোমাদের উপর আল্লাহর গযব নাযিল না হয়’। জবাবে আবু জাহল বলল, আল্লাহর কসম! আপনাকে সে তার কথা দিয়ে জাদু করেছে’।[2]
(৩) একদিন কা‘বা চত্বরে উপস্থিত মক্কার মুশরিকদের একজন বাদে সকলে রাসূল (ছাঃ)-এর মুখে সূরা নাজম শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে সূরার শেষ ৬২তম সিজদার আয়াত শুনে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সিজদায় পড়ে যায়। রাবী ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, একজন বৃদ্ধ কেবল সিজদা করেনি। সে এক মুষ্টি মাটি তুলে নিজের কপালে ঠেকিয়ে বলেছিল, এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। পরে তাকে আমি (বদরের যুদ্ধে) কাফের অবস্থায় নিহত হ’তে দেখেছি।’ ঐ বৃদ্ধটি ছিল মক্কার অন্যতম নেতা উমাইয়া বিন খালাফ।[3]
(৪) রাসূল (ছাঃ)-এর দো‘আর বরকতে এবং কুরআনী সূরার অতুলনীয় প্রভাবে রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার উদ্দেশ্যে আগত ওমর নিমেষে কুরআনের খাদেমে পরিণত হয়ে যান’ (ইবনু হিশাম ১/৩৪২-৪৬)।
(৫) জা‘ফর বিন আবু ত্বালিবের মুখে সূরা মারিয়ামের সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলি শুনে হাবশার বাদশাহ আছহামা নাজাশী ও তাঁর সভাসদ খ্রিষ্টান নেতাদের চক্ষু দিয়ে অবিরল ধারে অশ্রু প্রবাহিত হয়েছিল। অতঃপর মদীনায় নাজাশী প্রেরিত পন্ডিতগণের সত্তুর জনের এক শাহী প্রতিনিধিদল রাসূল (ছাঃ)-এর মুখে সূরা ইয়াসীন শুনে কেঁদে আত্মহারা হয়ে পড়েন ও সেখানেই মুসলমান হয়ে যান। পরে বাদশাহ নাজাশীও মুসলমান হন।[4]
(৬) কুরায়েশ-এর সবচেয়ে বড় ধনী ও বড় কবি অলীদ বিন মুগীরাহ একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে গিয়ে কুরআন শুনতে চাইলেন। তখন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে সূরা নাহলের ৯০ আয়াতটি শুনিয়ে দেন।[5] অলীদ বিন মুগীরাহ আবার শুনতে চাইলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পুনরায় পড়লেন। আয়াতটি শুনে হয়রান হয়ে তিনি বলে ওঠেন وَاللهِ إِنَّ لَهُ لَحَلاَوَةً، وَإِنَّ عَلَيْهِ لَطَلاَوَةً، وَإِنَّ أَعْلاَهُ لَمُثْمِرٌ، وَإِنَّ أَسْفَلَهُ لَمُغْدِقٌ وَمَا يَقُوْلُ هَذَا بَشَرٌ ‘আল্লাহর কসম! এর রয়েছে এক বিশেষ মাধুর্য, এর মধ্যে রয়েছে বিশেষ সজীবতা, এর শাখা-প্রশাখা সমূহ ফলবন্ত। এর জড়দেশ সদা সরস। আর মানুষ কখনো এরূপ বলতে পারে না’ (আল-ইস্তী‘আব)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, وَإِنَّهُ لَيَعْلُوَ وَلاَ يُعْلَى، وَإِنَّهُ لَيَحْطِمُ مَا تَحْتَه ‘নিশ্চয় এটি বিজয়ী হবে, বিজিত হবে না। আর নিশ্চয় এটি তার নীচের সবকিছুকে চূর্ণ করে দিবে’। তার এরূপ প্রশংসাগীতি শুনে আবু জাহল বলল, আপনি যতক্ষণ মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে কিছু না বলবেন, ততক্ষণ আপনার কওম আপনার উপর খুশী হবে না। তখন তিনি বললেন, ছাড়! আমাকে একটু ভাবতে দাও। অতঃপর ভেবে-চিন্তে তিনি বললেন, هَذَا سِحْرٌ يُؤْثَرُ يَأْثُرُهُ عَنْ غَيْرِهِ ‘এটি অন্য থেকে প্রাপ্ত জাদু! (আল-বিদায়াহ ৩/৬১)। বস্ত্ততঃ অলীদের প্রথম কথাগুলি ছিল তার মনের কথা। আর শেষের কথাগুলি ছিল রাজনৈতিক। এ প্রসঙ্গে সূরা মুদ্দাছছির ১১-২৬ আয়াতগুলি নাযিল হয়।[6]
(৭) এর প্রভাব এত বেশী যে, ৩৬০টি দেবদেবীর পূজারী নিমেষে সবকিছু ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদতকারী বনে যান। কোন আইন মানতে যারা কখনোই বাধ্য ছিল না, সেই অবাধ্য মরু আরব নিমেষে আল্লাহর আইনের সামনে এসে মাথা পেতে দেয়। পুলিশ বা কোন বাহিনীর প্রয়োজন হয়নি, নিজেরা এসে মৃত্যুদন্ড গ্রহণের জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে এসে পীড়াপীড়ি করে। মা‘এয আসলামী, গামেদী মহিলা প্রমুখদের ঘটনা যার জাজ্বল্যমান প্রমাণ।[7]
(৮) বদরের যুদ্ধে বন্দীদের মুক্তির ব্যাপারে আলোচনার জন্য কুরায়েশ নেতা জুবায়ের বিন মুত্ব‘ইম মদীনায় উপনীত হয়ে মাগরিবের জামা‘আতে রাসূল (ছাঃ)-এর মুখে সূরা তূরের আয়াতগুলি শুনে দারুণভাবে প্রভাবিত হন। তিনি বলেন, এর দ্বারা আমার হৃদয়ে প্রথম ঈমান প্রবেশ করে’ (আল-ইছাবাহ, জুবায়ের ক্রমিক ১০৯৩)।
(৯) জাহেলী যুগের মু‘আল্লাক্বা খ্যাত কবি লাবীদ বিন রাবী‘আহ ‘আমেরী ইসলাম কবুল করার পর কবিতা লেখা বন্ধ করে দিলেন। খলীফা ওমর (রাঃ) কূফার গবর্ণরের মাধ্যমে তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, مَا كُنْتُ لِأَقُولَ بَيْتًا مِنَ الشِّعْرِ بَعْدَ إِذْ عَلَّمَنِي اللهُ الْبَقَرَةَ وَآلَ عِمْرَانَ ‘আমি এক লাইন কবিতাও আর বলতে চাই না যখন থেকে আল্লাহ আমাকে সূরা বাক্বারাহ ও আলে ইমরান শিক্ষা দিয়েছেন’। এ কথা শুনে ওমর (রাঃ) তার বার্ষিক ভাতা বৃদ্ধি করে দেন।[8]
(১০) আবু ত্বালহা আনছারী যখন কুরআনের আয়াত لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوْا مِمَّا تُحِبُّوْنَ ‘তোমরা কখনই কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমাদের প্রিয় বস্ত্ত তোমরা দান করবে’ (আলে ইমরান ৩/৯২) শোনার পর রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে এসে নিজের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান খেজুর বাগিচাটি আল্লাহর রাহে দান করে দিলেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর হুকুমে উক্ত বাগিচা আবু ত্বালহার নিকটাত্মীয় এবং চাচাতো ভাইদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হ’ল।[9]
(১১) শায়খ আব্দুল ক্বাহির জুরজানী (মৃ. ৪৭৪ হি./১০৭৮ খৃ.) বলেন, আরবরা কুরআনের সর্বোচ্চ আলংকরিক বৈশিষ্ট্য ছাড়াও তারা এর গভীর তাৎপর্যপূর্ণ আয়াত সমূহের কারণে প্রভাবান্বিত হয়েছিল। যেমন وَلَكُمْ فِي الْقِصَاصِ حَيَاةٌ يَا أُولِي الأَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ ‘সম পরিমাণ শাস্তি দানের মধ্যে তোমাদের জীবন নিহিত রয়েছে হে জ্ঞানীগণ! যাতে তোমরা সতর্ক হ’তে পারো’ (বাক্বারাহ ২/১৭৯)।[10]
[2]. বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ২/২০৩-০৬; ইবনু হিশাম ১/২৯৪; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ পৃঃ ১০৭; সনদ হাসান; আল-বিদায়াহ ৩/৬৩-৬৪।
[3]. বুখারী হা/৪৮৬৩; মুসলিম হা/৫৭৬; মিশকাত হা/১০৩৭ ‘কুরআনের সিজদা সমূহ’ অনুচ্ছেদ।
[4]. ইবনু কাছীর, সূরা মায়েদাহ ৮২ ও ক্বাছাছ ৫৩ আয়াতের তাফসীর; ইবনু হিশাম ১/৩৩৬।
[5]. إِنَّ اللهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করার নির্দেশ দেন এবং অশ্লীলতা, অন্যায় কাজ ও অবাধ্যতা হতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর’ (নাহল ১৬/৯০)।
[6]. বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ২/১৯৮-৯৯; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/৬১।
[7]. মুসলিম হা/১৬৯৫; মিশকাত হা/৩৫৬২ ‘দন্ডবিধিসমূহ’ অধ্যায়।
[8]. আল-ইছাবাহ, লাবীদ বিন রাবি‘আহ ক্রমিক ৭৫৪৭; আল-ইস্তী‘আব।
[9]. বুখারী হা/২৩১৮; মুসলিম হা/৯৯৮; মিশকাত হা/১৯৪৫ ‘যাকাত’ অধ্যায়।
[10]. ড. মুজীবুর রহমান, কুরআনের চিরন্তন মু‘জেযা, (ইফাবা, ঢাকা : ৪র্থ সংস্করণ ২০০৬) ১৩৫ পৃঃ।