নবীদের কাহিনী নবী চরিত ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দেহ সৌষ্ঠব (الصفات الْخَلقية للرسول صـــ)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দেহাবয়ব ছিল (১) মধ্যম গড়নের অতীব সুন্দর ও সুঠাম এবং গায়ের রং ছিল উজ্জ্বল ও গৌর-গোলাপী।[1] (২) প্রশস্ত মুখমণ্ডল এবং ঘন পাপড়িযুক্ত কিঞ্চিত রক্তাভ পটলচেরা সুরমা চক্ষু।[2] (৩) দীর্ঘ গ্রীবাবিশিষ্ট বড় আকৃতির মাথা।[3] যা ছিল ঘনকৃষ্ণ কেশশোভিত। যা না অধিক কোঁকড়ানো, না অধিক খাড়া।[4] যা বাবরী ছিল।[5] (৪) মৃত্যু অবধি মাথার মাঝখানের কিছু চুল, ঠোটের নিম্ন দেশের এবং চোখ ও কানের মধ্যবর্তী দাড়ির ও কানের মধ্যকার কিছু চুল শ্বেতবর্ণ ধারণ করেছিল।[6] সেকারণ তিনি চুলে খেযাব লাগাতেন না।[7] আনাস (রাঃ) বলেন, মৃত্যুকালে রাসূল (ছাঃ)-এর চুল ও দাড়ির বিশটি চুলও পাকেনি’।[8] তিনি নিয়মিত চিরুনী ব্যবহার করতেন এবং মাথার চুল দু’দিকে ভাগ করে দিতেন (তাতে মাঝখানে সিঁথি হয়ে যেত)[9] (৫) গোফ ছোট ও দাড়ি ছিল দীর্ঘ ও ঘন সন্নিবেশিত।[10] (৬) তিনি ছিলেন প্রশস্ত কাঁধ বিশিষ্ট।[11] যার বাম স্কন্ধমূলে ছিল কবুতরের ডিম্বাকৃতির ছোট্ট মাংসপিন্ড, যা ‘মোহরে নবুঅত’ বলে খ্যাত। যা ছিল গাত্রবর্ণ থেকে পৃথক সবুজ বা কালচে চর্মতিল সমষ্টি।[12] (৭) প্রসারিত বক্ষপুট হতে নাভিদেশ পর্যন্ত ছিল স্বল্প লোমের প্রলম্বিত রেখা।[13] (৮) দেহের জোড় সমূহ ছিল বড় আকারের এবং পায়ের পাতা ও হস্ত তালুদ্বয় ছিল মাংসল।[14] (৯) এছাড়া হাতের তালুদ্বয় ছিল প্রশস্ত ও মোলায়েম।[15] আর পায়ের গোড়ালি ছিল পাতলা।[16] চলার সময় সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে চলতেন। যেন কোন ঢালু স্থানে অবতরণ করছেন।[17] (১১) দেহ নিঃসৃত স্বেদবিন্দু সমূহ মুক্তার ন্যায় পরিদৃষ্ট হ’ত। যা ছিল মিশকে আম্বরের চাইতে সুগন্ধিময়।[18] (১২) প্রফুল্ল অবস্থায় তাঁর মুখমণ্ডল চন্দ্রের ন্যায় চমকিত হ’ত।[19] রাগান্বিত হ’লে তাঁর চেহারার গন্ডদ্বয় ডালিমের ন্যায় রক্তিম বর্ণ ধারণ করত।[20] (১৩) শক্ত, সমর্থ ও শক্তিশালী দেহ সৌষ্ঠবের অধিকারী এই সুন্দর মানুষটির দেহ বৃদ্ধ বয়সে কিছুটা ভারি হয়ে গিয়েছিল।[21]

(ক) রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্দর চেহারার প্রশংসায় আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) বলতেন,

أَمِينٌ مُصْطَفًى لِلْخَيْرِ يَدْعُو + كَضَوْءِ الْبَدْرِ زَايَلَهُ الظَّلاَمُ

‘বিশ্বস্ত, মনোনীত, কল্যাণের দিকে যিনি সদা আহবান করেন। পূর্ণচন্দ্রের জ্যোতির ন্যায় যা অন্ধকার দূরীভূত করে’।[22]

(খ) ওমর ফারূক (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর চেহারা দেখে মু‘আল্লাক্বাখ্যাত জাহেলী কবি যুহায়ের বিন আবু সুলমার নিম্নোক্ত কবিতা পাঠ করতেন, যা কবি তার নেতা হারাম বিন সেনানের প্রশংসায় বলেছিলেন।-

لَوْ كُنْتَ مِنْ شَيْءٍ سِوَى بَشَرٍ + كُنْتَ الْمُضِيَّ لِلَيْلَةِ الْبَدْرِ

‘যদি আপনি মানুষ ব্যতীত অন্য কিছু হ’তেন, তাহ’লে আপনিই পূর্ণিমার রাত্রির জন্য আলো দানকারী হ’তেন’।[23]

(গ) কা‘ব বিন মালেক (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন আনন্দিত হ’তেন, তখন তাঁর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে যেন চন্দ্রের টুকরা (قِطْعَةُ قَمَرٍ) হয়ে যেত’।[24]

(ঘ) হযরত আলী (রাঃ) এবং অন্যান্য প্রশংসাকারীর ভাষায় রাসূল (ছাঃ) ছিলেন, لَمْ أَرَ قَبْلَهُ وَلاَ بَعْدَهُ مِثْلَهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘তাঁর পূর্বে ও পরে তাঁর ন্যায় সুন্দর কাউকে আমি দেখিনি’।[25] ফারসী কবির ভাষায়,

حسن يوسف دم عيسى يد بيضا دارى + آنچہ خوبہ ہم دارند توتنها دارى

‘ইউসুফের রূপ, ঈসার ফুঁক ও মূসার শুভ্র তালু

সবই আছে তোমার মাঝে হে প্রিয় রাসূল’।

[1]. বুখারী হা/৩৫৪৭; মুসলিম হা/২৩৪০, ২৩৪৭। আনাস ও আবুত তুফায়েল (রাঃ) হ’তে।

[2]. মুসলিম হা/২৩৩৯; মিশকাত হা/৫৭৮৪। জাবের (রাঃ) হ’তে। বায়হাক্বী, ছহীহুল জামে‘ হা/৪৬২১। আলী (রাঃ) হ’তে।

[3]. তিরমিযী হা/৩৬৩৭, মিশকাত হা/৫৭৯০। আনাস (রাঃ) হ’তে।

[4]. বুখারী হা/৩৫৪৭; মুসলিম হা/২৩৪৭। আনাস (রাঃ) হ’তে।

[5]. মুসলিম হা/২৩৩৮, মিশকাত হা/৫৭৮২। জাবের (রাঃ) হ’তে।

[6]. বুখারী হা/৩৫৪৫, মুসলিম হা/২৩৪১, নাসাঈ হা/৫০৮৭। আনাস (রাঃ) হ’তে।

[7]. আহমাদ হা/১৩৩৯৬, সনদ ছহীহ। আনাস (রাঃ) হ’তে।

[8]. বুখারী হা/৩৫৪৭; মুসলিম হা/২৩৪৭। আনাস (রাঃ) হ’তে।

[9]. বুখারী হা/৩৫৫৮; মুসলিম হা/২৩৩৬; মিশকাত হা/৪৪২৫, ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে।

[10]. মুসলিম হা/২৩৪৪, নাসাঈ হা/৫২৩২, মিশকাত হা/৫৭৭৯। জাবের (রাঃ) হ’তে।

[11]. বুখারী হা/৩৫৫১, মুসলিম হা/২৩৩৭, মিশকাত হা/৫৭৮৩। বারা বিন ‘আযেব (রাঃ) হ’তে।

[12]. মুসলিম হা/২৩৪৪, ২৩৪৬, মিশকাত হা/৫৭৮০, আব্দুল্লাহ বিন সারজিস (রাঃ) হ’তে।

[13]. তিরমিযী হা/৩৬৩৭, মিশকাত হা/৫৭৯০। আলী (রাঃ) হ’তে।

[14]. তিরমিযী হা/৩৬৩৭, মিশকাত হা/৫৭৯০। আলী (রাঃ) হ’তে।

[15]. বুখারী হা/৩৫৬১, ৫৯০৭। আনাস (রাঃ) হ’তে।

[16]. মুসলিম হা/২৩৩৯। জাবের (রাঃ) হ’তে।

[17]. তিরমিযী হা/৩৬৩৭, মুসলিম হা/২৩৩০; মিশকাত হা/৫৭৮৭, ৫৭৯০। আলী ও আনাস (রাঃ) হ’তে।

[18]. বুখারী হা/১৯৭৩, মুসলিম হা/২৩৩০, মিশকাত হা/৫৭৮৭। আনাস (রাঃ) হ’তে।

একবার গ্রীষ্মের দুপুরে ঘুমন্ত রাসূল (ছাঃ)-এর দেহনিঃসৃত ঘর্মসমূহ বাটিতে জমা করেছিলেন খালা উম্মে সুলায়েম (রাঃ)। রাসূল (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি এগুলি আমাদের সুগন্ধির সাথে মিশাবো। কেননা এগুলি অধিক সুগন্ধিময়’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এর ব্যবহারের দ্বারা আমরা আমাদের বাচ্চাদের জন্য বরকত আশা করি। রাসূল (ছাঃ) বললেন, তুমি ঠিকই করেছ’ (মুসলিম হা/২৩৩১, মিশকাত হা/৫৭৮৮, উম্মে সুলায়েম (রাঃ) হ’তে)।

[19]. বুখারী হা/৩৫৫৬, মুসলিম হা/২৭৬৯, মিশকাত হা/৫৭৯৮।

[20]. তিরমিযী হা/২১৩৩, মিশকাত হা/৯৮।

[21]. মুসলিম হা/৭৩২, মিশকাত হা/১১৯৮।

[22]. বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত হা/২৩৮, ১/২৭০ পৃঃ।

[23]. বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ১/৩০১; কানযুল ‘উম্মাল হা/১৮৫৭০; ছাখাবী, আল-ওয়াফী বিল অফায়াত ২৯ পৃঃ।

[24]. বুখারী হা/৩৫৫৬; মিশকাত হা/৫৭৯৮ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় ২ অনুচ্ছেদ।

[25]. তিরমিযী হা/৩৬৩৭; মিশকাত হা/৫৭৯০; ইবনু হিশাম ১/৪০২।

শায়খ ছফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ) আলী (রাঃ)-এর বরাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দেহ সৌষ্ঠব বর্ণনায় যে দীর্ঘ হাদীছটি এনেছেন, সেটি যঈফ (তিরমিযী হা/৩৬৩৮; আর-রাহীক্ব ৪৭৯-৮০ পৃঃ; ঐ, তা‘লীক্ব ১৯৩ পৃঃ)। (২) একইভাবে আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে ‘রাসূল (ছাঃ)-এর চেহারায় যেন সূর্য খেলা করত’ মর্মে যে হাদীছ এনেছেন, সেটিও যঈফ (তিরমিযী হা/৩৬৪৮, আর-রাহীক্ব ৪৮১; ঐ, তা‘লীক্ব ১৯৩-৯৪ পৃঃ)। (৩) জাবের বিন সামুরাহ (রাঃ) থেকে ‘তাঁর পায়ের নলা সরু ছিল’... বলে যে হাদীছ এনেছেন, তা যঈফ (তিরমিযী হা/৩৬৪৫, আর-রাহীক্ব ৪৮২ পৃঃ, ঐ, তালীক্ব ১৯৪ পৃঃ)। (৪) জাবের (রাঃ) থেকে ‘তিনি রাস্তায় চলার সময় পিছনের ব্যক্তি তার দেহ থেকে সুগন্ধি পেত’... বলে যে হাদীছটি এনেছেন, তা যঈফ (দারেমী হা/৬৬; আর-রাহীক্ব ৪৮২ পৃঃ; ঐ, তালীক্ব ১৯৪ পৃঃ)। তবে রাসূল (ছাঃ) যখন সামনে আসতেন, তখন তাঁর দেহ থেকে সুগন্ধি বের হ’ত, মর্মে বর্ণিত হাদীছটি ‘হাসান’ (আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২১৩৭)। (৫) ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে ‘তার সামনের উপরস্থ দু’টি দাঁতের মাঝে ফাঁক ছিল। কথা বলার সময় সেখান থেকে নূর চমকাতো, মর্মে বর্ণিত হাদীছটি ‘খুবই যঈফ’ (দারেমী, মিশকাত হা/৫৭৯৭, যঈফাহ হা/৪২২০; আর-রাহীক্ব ৪৮২ পৃঃ; ঐ, তালীক্ব ১৯৫ পৃঃ)। (৬) হিন্দ বিন আবু হালাহ (রাঃ) থেকে রাসূল (ছাঃ)-এর গুণাবলী বর্ণনায় যে দীর্ঘ হাদীছ এনেছেন, সেটিও যঈফ (আলবানী, মুখতাছার শামায়েলে তিরমিযী হা/৬; আর-রাহীক্ব ৪৮৬-৮৭ পৃঃ; ঐ, তা‘লীক্ব ১৯৬-৯৭ পৃঃ)।