নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি
আবুবকর (রাঃ)-এর ধৈর্যশীল ভূমিকা (الموقف الحلمى لأبى بكر رضــ)

শোকাহত ছাহাবায়ে কেরামের দিশাহারা অবস্থার মধ্যে ধৈর্য ও স্থৈর্যের জীবন্ত প্রতীক হযরত আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) মসজিদে নববী থেকে এক মাইল দূরে শহরের উঁচু সুন্হ (السُّنْحُ) এলাকায় অবস্থিত স্বীয় বাসগৃহ থেকে বের হয়ে ঘোড়ায় চড়ে দ্রুত আগমন করেন এবং মসজিদে নববীতে প্রবেশ করেন। অতঃপর কাউকে কিছু না বলে সোজা কন্যা আয়েশার গৃহে গমন করেন। এ সময় রাসূল (ছাঃ)-এর দেহ একটি জরিদার ইয়ামনী চাদর(بُرْدُ حِبَرَةٍ) দ্বারা আবৃত ছিল। তিনি গিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর চেহারার উপর থেকে চাদর সরিয়ে চুম্বন করলেন ও কেঁদে ফেললেন। অতঃপর বললেন, بِأَبِى أَنْتَ وَأُمِّىْ، وَاللهِ لاَ يَجْمَعُ اللهُ عَلَيْكَ مَوْتَتَيْنِ، أَمَّا الْمَوْتَةُ الَّتِىْ كُتِبَتْ عَلَيْكَ فَقَدْ ذُقْتَهَا ‘আপনার উপরে আমার পিতা-মাতা উৎসর্গীত হৌন! আল্লাহ আপনার উপরে দু’টি মৃত্যুকে একত্রিত করবেন না। অতঃপর যে মৃত্যু আপনার জন্য নির্ধারিত ছিল, তার স্বাদ আপনি আস্বাদন করেছেন’ (বুখারী হা/১২৪১)। অন্য বর্ণনায় এসেছে,بِأَبِى أَنْتَ وَأُمِّى طِبْتَ حَيًّا وَمَيِّتًا، وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لاَ يُذِيقُكَ اللهُ الْمَوْتَتَيْنِ أَبَدًا ‘আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎস্বর্গিত হৌন! আপনার জীবন ও মরণ সুখময় হৌক! যার হাতে আমার জীবন তাঁর কসম করে বলছি, কখনোই আল্লাহ আপনাকে দু’টি মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করাবেন না’ (বুখারী হা/৩৬৬৭)। এরপর তিনি মুখ ঢেকে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। এমন সময় ওমর (রাঃ) সম্ভবতঃ স্বীয় বক্তব্যের পক্ষে লোকদের কিছু বলছিলেন। আবুবকর (রাঃ) তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,أَيُّهَا الْحَالِفُ عَلَى رِسْلِكَ ‘হে কসমকারী! থামো’। কিন্তু তিনি থামলেন না (বুখারী হা/৩৬৬৭)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, اجْلِسْ ‘তুমি বস। কিন্তু তিনি বসলেন না’ (বুখারী হা/১২৪২)। অতঃপর তিনি মসজিদে নববীতে প্রবেশ করলেন। লোকেরা সব ওমরকে ছেড়ে তাঁর সাথে সাথে মসজিদে এলো। তখন তিনি লোকদের উদ্দেশ্যে দেওয়া সংক্ষিপ্ত ভাষণের শুরুতে হামদ ও ছানার পর রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করলেন। অতঃপর গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন,

أَيُّهَا النَّاسُ! إِنَّهُ مَنْ كَانَ مِنْكُمْ يَعْبُدُ مُحَمَّدًا فَإِنَّ مُحَمَّدًا قَدْ مَاتَ، وَمَنْ كَانَ يَعْبُدُ اللهَ فَإِنَّ اللهَ حَىٌّ لاَ يَمُوْتُ، قَالَ اللهُ تَعَالَى وَمَا مُحَمَّدٌ إِلاَّ رَسُوْلٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِن مَّاتَ أَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ وَمَنْ يَّنْقَلِبْ عَلَىَ عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَّضُرَّ اللهَ شَيْئاً وَسَيَجْزِي اللهُ الشَّاكِرِيْنَ-

‘হে লোক সকল! তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের পূজা করে, সে জেনে রাখুক যে, মুহাম্মাদ মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করে, সে জেনে রাখুক যে, আল্লাহ চিরঞ্জীব তিনি মরেন না। তিনি বলেছেন, ‘মুহাম্মাদ একজন রাসূল ব্যতীত কিছু নন। তাঁর পূর্বে অনেক রাসূল গত হয়ে গেছেন। এক্ষণে যদি তিনি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তাহ’লে তোমরা কি পিছন পানে ফিরে যাবে? যে ব্যক্তি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে ফিরে যাবে, সে ব্যক্তি আল্লাহর কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। সত্বর আল্লাহ তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দাদের পুরস্কৃত করবেন’ (আলে ইমরান ৩/১৪৪)। অতঃপর লোকেরা উক্ত আয়াতটি বারবার পাঠ করতে থাকে’ (বুখারী হা/১২৪২)

ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, আবুবকর (রাঃ)-এর উক্ত ভাষণ শোনার পর সকলে রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গেলেন। সবার মনে হ’ল যেন আবুবকরের মুখে শোনার আগে উক্ত আয়াতটি তারা জানতেনই না। অতঃপর যেই-ই শোনেন, সেই-ই আয়াতটি পড়তে থাকেন’। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব বলেন, ওমর বললেন, আল্লাহর কসম! আবুবকরের মুখে উক্ত আয়াত শুনে আমি আমার দু’পা স্থির রাখতে পারিনি। অবশেষে আমি মাটিতে পড়ে গেলাম এবং আমি নিশ্চিত হ’লাম যে, রাসূল (ছাঃ) মারা গেছেন (বুখারী হা/৪৪৫৪)। ওমর (রাঃ) আবুবকরের ভাষণ শুনে বসে পড়েন এবং বলেন,فَلَكَأَنِّى لَمْ أَقْرَأْهَا إِلاَّ يَوْمَئِذٍ ‘আমার মনে হচ্ছিল যেন আয়াতগুলি আমি এদিন ব্যতীত ইতিপূর্বে কখনো পাঠ করিনি’। আমি প্রথম আবুবকরের মুখে এটি শুনলাম এবং নিশ্চিত হ’লাম যে, রাসূল (ছাঃ) মৃত্যুবরণ করেছেন’।[1] আনাস (রাঃ) বলেন,مَا رَأَيْتُ يَوْماً قَطُّ كَانَ أَحْسَنَ وَلاَ أَضْوَأَ مِنْ يَوْمٍ دَخَلَ عَلَيْنَا فِيهِ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَمَا رَأَيْتُ يَوْماً كَانَ أَقْبَحَ وَلاَ أَظْلَمَ مِنْ يَوْمٍ مَاتَ فِيهِ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যেদিন আমাদের নিকটে আগমন করেছিলেন, সেদিনের চাইতে সুন্দর ও উজ্জ্বলতম দিন আমি কখনও দেখিনি। পক্ষান্তরে যেদিন তিনি মৃত্যুবরণ করলেন, সেদিনের চাইতে মন্দ ও অন্ধকারময় দিন আমি আর দেখিনি’।[2]

[1]. ইবনু মাজাহ হা/১৬২৭; ইবনু হিশাম ২/৬৫৬।

[2]. দারেমী হা/৮৮; মিশকাত হা/৫৯৬২, সনদ ছহীহ।