নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি

১. জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, এদিন(يَوْمُ النَّحْرِ) সূর্য ঢলার পর ‘আযবা (الْعَضْبَاء) উটনীর পিঠে বসে কংকর নিক্ষেপ শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সকলের উদ্দেশ্যে বলেন,

خُذُوا عَنِّى مَنَاسِكَكُمْ فَإِنِّى لاَ أَدْرِى لَعَلِّى أَنْ لاَ أَحُجَّ بَعْدَ حَجَّتِى هَذِهِ-

(১) হে জনগণ! তোমরা আমার নিকট থেকে হজ্জ ও কুরবানীর নিয়ম-কানূন শিখে নাও। হয়তবা এ বছরের পর আমার পক্ষে আর হজ্জ করা সম্ভব হবে না’।[1] এভাবে বিদায় নেওয়ার কারণে লোকেরা একে হাজ্জাতুল বিদা‘(حَجَّةُ الْوَدَاع) বা বিদায় হজ্জ বলে (যাদুল মা‘আদ ২/২৩৮)

২. আবু বাকরাহ (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি আরও বলেন,

إِنَّ الزَّمَانَ قَدِ اسْتَدَارَ كَهَيْئَتِهِ يَوْمَ خَلَقَ اللهُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ وَالسَّنَةُ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ثَلاَثَةٌ مُتَوَالِيَاتٌ ذُو الْقَعْدَةِ وَذُو الْحِجَّةِ وَالْمُحَرَّمُ وَرَجَبٌ شَهْرُ مُضَرَ الَّذِىْ بَيْنَ جُمَادَى وَشَعْبَانَ- أَىُّ شَهْرٍ هَذَا؟ قُلْنَا اللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، فَسَكَتَ حَتَّى ظَنَنَّا أَنَّهُ سَيُسَمِّيهِ بِغَيْرِ اسْمِهِ. قَالَ أَلَيْسَ هَذَا ذَا الْحِجَّةِ؟ قُلْنَا بَلَى. قَالَ فَأَىُّ بَلَدٍ هَذَا؟ قُلْنَا اللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، فَسَكَتَ حَتَّى ظَنَنَّا أَنَّهُ سَيُسَمِّيهِ بِغَيْرِ اسْمِهِ. قَالَ أَلَيْسَتِ الْبَلْدَةَ؟ قُلْنَا بَلَى. فَأَىُّ يَوْمٍ هَذَا؟ قُلْنَا اللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، فَسَكَتَ حَتَّى ظَنَنَّا أَنَّهُ سَيُسَمِّيهِ بِغَيْرِ اسْمِهِ. قَالَ أَلَيْسَ يَوْمَ النَّحْرِ؟ قُلْنَا بَلَى. قَالَ فَإِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ وَأَعْرَاضَكُمْ عَلَيْكُمْ حَرَامٌ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا فِى بَلَدِكُمْ هَذَا فِى شَهْرِكُمْ هَذَا- وَسَتَلْقَوْنَ رَبَّكُمْ فَيَسْأَلُكُمْ عَنْ أَعْمَالِكُمْ، أَلاَ فَلاَ تَرْجِعُوْا بَعْدِى ضُلاَّلاً، يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ- أَلاَ هَلْ بَلَّغْتُ؟ قَالُوْا نَعَمْ. قَالَ اللَّهُمَّ اشْهَدْ، فَلْيُبَلِّغِ الشَّاهِدُ الْغَائِبَ، فَرُبَّ مُبَلَّغٍ أَوْعَى مِنْ سَامِعٍ-

(২) ‘কালচক্র আপন নিয়মে আবর্তিত হয়, যেদিন থেকে আসমান ও যমীন সৃষ্টি হয়েছে। বছর বারো মাসে হয়। তার মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস। তিনটি পরপর, যুলক্বা‘দাহ, যুলহিজ্জাহ ও মুহাররম এবং রজবে মুযার’[2] যা হ’ল জুমাদা ও শা‘বানের মধ্যবর্তী।[3] অতঃপর তিনি বলেন, (৩) এটি কোন মাস? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল অধিক জ্ঞাত। অতঃপর তিনি চুপ থাকলেন। আমরা ভাবলাম হয়ত তিনি এর পরিবর্তে অন্য কোন নাম দিবেন। তিনি বললেন, এটা কি যুলহিজ্জাহ নয়? আমরা বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, এটি কোন শহর? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল অধিক জ্ঞাত। অতঃপর তিনি চুপ থাকলেন। আমরা ভাবলাম হয়ত তিনি এর পরিবর্তে অন্য কোন নাম দিবেন। তিনি বললেন, এটা কি মক্কা নয়? আমরা বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আজ কোন দিন? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল অধিক জ্ঞাত। অতঃপর তিনি চুপ থাকলেন। আমরা ভাবলাম হয়ত তিনি এর পরিবর্তে অন্য কোন নাম দিবেন। তিনি বললেন, আজ কি কুরবানীর দিন নয়? আমরা বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, জেনে রেখ, তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ, তোমাদের ইয্যত তোমাদের উপরে ঐরূপ হারাম যেরূপ আজকের এই দিন, এই শহর, এই মাস তোমাদের জন্য হারাম (অর্থাৎ পরস্পরের জন্য উক্ত তিনটি বস্ত্ত সর্বদা হারাম)। (৪) ‘সত্বর তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সাথে মিলিত হবে। অতঃপর তিনি তোমাদের আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। সাবধান! আমার পরে তোমরা পুনরায় ‘পথভ্রষ্ট’ (ضُلاَّلاً) হয়ে ফিরে যেয়ো না এবং একে অপরের গর্দান মেরো না’। (৫) ‘হে জনগণ! আমি কি তোমাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছি (দু’বার)? লোকেরা বলল, হ্যাঁ। রাসূল (ছাঃ) বললেন, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক! আর তোমাদের উপস্থিতগণ যেন অনুপস্থিতগণকে কথাগুলি পৌঁছে দেয়। কেননা উপস্থিত শ্রোতাদের অনেকের চাইতে অনুপস্থিত যাদের নিকট এগুলি পৌঁছানো হবে, তাদের মধ্যে অধিক জ্ঞানী ব্যক্তি থাকতে পারেন’।[4]

একই রাবীর অন্য বর্ণনায় এসেছে,لاَ تَرْجِعُوا بَعْدِى كُفَّارًا يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ ‘সাবধান! আমার পরে তোমরা পুনরায় ‘কাফের’ হয়ে ফিরে যেয়ো না এবং একে অপরের গর্দান মেরো না’।[5] ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এটি ছিল উম্মতের জন্য তাঁর অছিয়ত স্বরূপ (বুখারী হা/১৭৩৯)

এই ‘কাফের’ অর্থ কর্মগত কাফের অর্থাৎ অবাধ্য। আক্বীদাগত কাফের নয়, যা মুসলমানকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশের উপর ঈমান আনবে ও কিছু অংশে কুফরী করবে’?[6] রাসূল (ছাঃ) বলেন,سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوقٌ، وَقِتَالُهُ كُفْرٌ ‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেক্বী এবং তাকে হত্যা করা কুফরী’ (বুখারী হা/৪৮)। এসময় তাঁকে কংকর নিক্ষেপ, কুরবানী ও মাথা মুন্ডনে আগপিছ হয়ে গেলে করণীয় কি হবে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন,افْعَلُوا وَلاَ حَرَجَ ‘করে যাও। কোন সমস্যা নেই’ (মুসলিম হা/১৩০৬)

৩. আবু উমামাহ বাহেলী (রাঃ) বলেন, এদিন আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,

أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّهُ لاَ نَبِيَّ بَعْدِي، وَلاَ أُمَّةَ بَعْدَكُمْ، وَاعْبُدُوا رَبَّكُمْ، وَصَلُّوا خَمْسَكُمْ، وَصُومُوا شَهْرَكُمْ، وَأَدُّوا زَكَاةَ أَمْوَالِكُمْ طَيِّبَةً بِهَا أَنْفُسُكُمْ وَأَطِيعُوا وُلاَةَ أَمْرِكُمْ تَدْخُلُوا جَنَّةَ رَبِّكُمْ-

(৬) ‘হে জনগণ! শুনে রাখ আমার পরে কোন নবী নেই এবং তোমাদের পরে কোন উম্মত নেই। অতএব (৭) তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ইবাদত কর। পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় কর। রামাযান মাসের ছিয়াম পালন কর। সন্তুষ্ট চিত্তে মালের যাকাত দাও। তোমাদের শাসকদের আনুগত্য কর। তোমাদের প্রতিপালকের জান্নাতে প্রবেশ কর’। অন্য বর্ণনায় এসেছে,اتَّقُوا اللهَ رَبَّكُمْ وَصَلُّوا خَمْسَكُمْ وَصُومُوا شَهْرَكُمْ وَأَدُّوا زَكَاةَ أَمْوَالِكُمْ وَأَطِيعُوا ذَا أَمْرِكُمْ تَدْخُلُوا جَنَّةَ رَبِّكُمْ ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় কর। পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় কর। রামাযান মাসের ছিয়াম পালন কর। তোমাদের মালের যাকাত দাও। তোমাদের আমীরের আনুগত্য কর। তোমাদের প্রতিপালকের জান্নাতে প্রবেশ কর’।[7]

[1]. আহমাদ হা/১৪৪৫৯, ২০০৮৬-৮৭; নাসাঈ হা/৩০৬২; আবুদাঊদ হা/১৯৫৪; মুসলিম হা/১২৯৭ (৩১০); মিশকাত হা/২৬১৮।

[2]. মুযার গোত্রের দিকে সম্পর্কিত করে ‘রজবে মুযার’ বলা হয়েছে। কারণ তারা ছিল রজব মাসের নিষিদ্ধতার প্রতি সারা আরবের মধ্যে সর্বাধিক কঠোরতা আরোপকারী (মির‘আত হা/২৬৮৩-এর আলোচনা)।

[3]. বুখারী হা/৪৪০৬; মুসলিম হা/১৬৭৯; মিশকাত হা/২৬৫৯।

[4]. বুখারী হা/১৭৪১, ৪৪০৬ আবু বাকরাহ হ’তে, ‘মিনার দিনসমূহের ভাষণ’ অনুচ্ছেদ; মুসলিম হা/১৬৭৯; মিশকাত হা/২৬৫৯। একইরূপ বর্ণনা ইবনু আববাস ও ইবনু ওমর (রাঃ) থেকেও এসেছে (বুখারী হা/১৭৩৯, ১৭৪২)।

[5]. মুসলিম হা/১৬৭৯ (২৯) আবু বাকরাহ হ’তে; বুখারী হা/১৭৩৯, ৪৪০৫ ইবনু আববাস ও জারীর হ’তে।

[6]. বাক্বারাহ ২/৮৫; আলোচনা দ্রষ্টব্য, ফাৎহুল বারী হা/৪৮-এর ব্যাখ্যা ‘ঈমান’ অধ্যায় ৩৬ অনুচ্ছেদ।

[7]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/৭৫৩৫; আবুদাঊদ হা/১৯৫৫; আহমাদ হা/২২২১৫; তিরমিযী হা/৬১৬; মিশকাত হা/৫৭১; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৮৬৭, ৩২৩৩; আল-বিদায়াহ ৫/১৯৮।