নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি
বিনা যুদ্ধে শহীদ, যুল বিজাদায়েন (شهادة ذى البجادين من غير قتال)

তাবূকে অবস্থানকালীন সময়ে তরুণ ছাহাবী আব্দুল্লাহ যুল-বিজাদায়েন(عَبْدُ اللهِ ذُو الْبِجَادَيْنِ) এর মৃত্যু হয়। এই নিঃস্ব-বিতাড়িত শাহাদাত পিয়াসী মুহাজির তরুণের জীবন কাহিনী অতীব বেদনাময়, চমকপ্রদ ও শিক্ষাপ্রদ। শিশু অবস্থায় পিতৃহারা আব্দুল ‘উযযা মক্কায় তার চাচার কাছে প্রতিপালিত হন। তরুণ বয়সে চাচার উট-বকরী চরানোই ছিল তার কাজ। ইতিমধ্যে ইসলামের বাণী তার নিকটে পৌঁছে যায় এবং তিনি তাওহীদের প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু চাচার ভয়ে প্রকাশ করেননি। হঠাৎ মক্কা বিজয় সবকিছুকে ওলট-পালট করে দিল। যুবক আব্দুল ‘উয্যার লুক্কায়িত ঈমান ফল্গুস্রোত হয়ে বেরিয়ে এলো। চাচার সামনে গিয়ে ইসলাম কবুলের অনুমতি চাইলেন। চাচা তাকে সকল মাল-সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার হুমকি দিলেন। এমনকি তার দেহের পরিহিত বস্ত্র পর্যন্ত ছিনিয়ে নিলেন। ফলে নগ্ন অবস্থায় ছুটে মায়ের কাছে গেলেন। গর্ভধারিণী মা তার এ অবস্থা দেখে কেঁদে ফেললেন ও তাকে একটা কম্বল দিলেন। আব্দুল ‘উযযা সেটাকে ছিঁড়ে দু’ভাগ করে একভাগ দেহের নিম্নভাগে ও একভাগ ঊর্ধ্বভাগে পরিধান করে শূন্য হাতে চললেন মদীনা অভিমুখে। পক্ষকাল পরে মদীনা পৌঁছে ফজরের সময় মসজিদে নববীতে রাসূল (ছাঃ)-এর সম্মুখে উপস্থিত হ’লেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার সব কথা শুনে দুঃখে বিগলিত হ’লেন। তার আব্দুল ‘উযযা নাম পাল্টিয়ে রাখলেন ‘আব্দুল্লাহ’। লকব দিলেন ‘যুল বিজাদায়েন’(ذُو الْبِِجَادَيْنِ) ‘দুই টুকরা কম্বলওয়ালা’। অতঃপর মসজিদের সাথে অবস্থিত ‘আছহাবে ছুফফা’-র মধ্যে তাকে শামিল করা হ’ল। সেখানে তিনি বিপুল আগ্রহে কুরআন শিখতে থাকেন। তার কুরআনের ধ্বনি অনেক সময় মুছল্লীদের ছালাতে ব্যাঘাত ঘটাতো। একদিন ওমর ফারূক (রাঃ) এ বিষয়ে অভিযোগ করলে রাসূল (ছাঃ) বললেন, ওমর ওকে কিছু বলো না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল-এর জন্য সে সর্বস্ব ত্যাগ করে এসেছে’।

এমন সময় তাবূক যুদ্ধের ঘোষণা চলে আসে। আব্দুল্লাহ ছুটে রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে এসে যুদ্ধে যাবার অনুমতি চান। দয়ার নবী তাকে গাছের একটা ছাল নিয়ে আসতে বলেন। ছালটি নিয়ে রাসূল (ছাঃ) তার হাতে বেঁধে দিয়ে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করেন, ‘হে আল্লাহ! আমি কাফেরদের জন্য এর রক্ত হারাম করছি’। আব্দুল্লাহ বললেন, ‘হে রাসূল! আমি তো এটা চাইনি (অর্থাৎ আমি যে শাহাদাতের কাঙাল)’। রাসূল (ছাঃ) বললেন, যদি তুমি প্রচন্ড জ্বরে মারা যাও অথবা বাহন থেকে পড়ে তার আঘাতে মারা যাও, তথাপি তুমি শহীদ হিসাবে গণ্য হবে’। এতে বুঝা যায় যে, শাহাদাতের একান্ত কামনা নিয়ে বিছানায় মৃত্যুবরণ করলেও তিনি শহীদ হিসাবে গণ্য হবেন। তার ভাগ্যে সেটাই দেখা গেল। তাবূক পৌঁছে হঠাৎ গাত্রোত্তাপ বেড়ে গেলে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয় (ওয়াক্বেদী ৩/১০১৪)

বেলাল বিন হারেছ আল-মুযানী বলেন, রাত্রিতে তার দাফনকার্য সম্পন্ন হয়। রাসূল (ছাঃ)-এর মুওয়াযযিন বেলালের হাতে চেরাগ ছিল। আবুবকর ও ওমর তার লাশ বহন করে আনেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে কবরে নামেন এবং বলেন,أَدْنِيَا إِلَىَّ أَخَاكُمْ ‘তোমরা দু’জন তোমাদের ভাইকে আমার নিকটে এনে দাও’। অতঃপর তাকে কবরে কাত করে শোয়ানোর সময় তিনি বলেন,اللَّهُمَّ إِنِّيْ أَمْسَيْتُ رَاضِيًا عَنْهُ فَارْضِ عَنْهُ ‘হে আল্লাহ! আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি এ যুবকের উপরে খুশী ছিলাম। তুমিও এর উপরে খুশী হও’। তার দাফনকার্যের এই দৃশ্য দেখে আবুবকর (রাঃ) বলে ওঠেন, يَا لَيْتَنِيْ كُنْتُ صَاحِبَ الْحُفْرَةِ ‘হায়! এই কবরে যদি আমি হ’তাম’![1]

[1]. আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৪৮০৭; ত্বাবারাণী আওসাত্ব হা/৯১১১; মুসনাদে বাযযার হা/১৭০৬; মাজমাঊয যাওয়ায়েদ হা/৪২৩৭; ইবনু হিশাম ২/৫২৮; যাদুল মা‘আদ ৩/৪৭৩। সনদ মুনক্বাতি‘। তবে হাদীছ ‘হাসান’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৮৮৭)। ইবনু হিশাম ও অন্যান্য সীরাত গ্রন্থে আবুবকর (রাঃ)-এর স্থলে ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর নাম এসেছে।