নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি
তাবূকে উপস্থিতি এবং রাসূল (ছাঃ)-এর সারগর্ভ উপদেশবাণী (نصائح بليغة لرسول الله صـ فى تبوك)

মুসলিম বাহিনী তাবূকে অবতরণ করার পর রাসূল (ছাঃ) জান্নাতপাগল সেনাদলের উদ্দেশ্যে একটি সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ(جَوَامِعُ الْكَلِمِ) ভাষণ দান করেন। যা ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য কল্যাণকর।

ভাষণটি সম্পর্কে ইবনু কাছীর বলেন, হাদীছটি ‘গরীব’। এর মধ্যে অপ্রাসঙ্গিক কথা (نكارة) রয়েছে এবং এর সনদে দুর্বলতা রয়েছে’ (আল-বিদায়াহ ৫/১৪)। আলবানী বলেন, এর সনদ ‘যঈফ’ (সিলসিলা যঈফাহ হা/২০৫৯)। আরনাঊত্ব বলেন, এর সনদ ‘অতীব দুর্বল’ (যাদুল মা‘আদ ৩/৪৭৪- টীকা)। আকরাম যিয়া উমারী বলেন, তাবূকের এই দীর্ঘ ভাষণটি বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়। যদিও এর বক্তব্যগুলি বিভিন্ন হাদীছ থেকে গৃহীত। যার কিছু ‘ছহীহ’ কিছু ‘হাসান’। এটি স্পষ্ট যে, কোন কোন রাবী ঐগুলি থেকে নিয়ে ভাষণটি সৌন্দর্য মন্ডিত করেছেন’ (সীরাহ ছহীহাহ ২/৫৩৪)।

সনদের বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও বক্তব্যগুলি বিভিন্ন ‘ছহীহ’ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হওয়ায় আমরা ভাষণটি উদ্ধৃত করলাম।

উক্ত ভাষণ থেকে ইবনুল ক্বাইয়িম তিনটি বাক্য (৩২-৩৪) বাদ দিয়েছেন। মানছুরপুরী ৩৫ ক্রমিক বাদ দিয়ে মোট ৫০টি ক্রমিকে ভাগ করে ভাষণটি পেশ করেছেন। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, বায়হাক্বী দালায়েল (৫/২৪১) ও হাকেম উক্ববা বিন ‘আমের (রাঃ) হ’তে হাদীছটি বর্ণনা করেন।-

হামদ ও ছানার পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

(1) فَإِنَّ أَصْدَقَ الْحَدِيْثِ كِتَابُ اللهِ (2) وَأَوْثَقَ الْعُرَى كَلِمَةُ التَّقْوَى (3) وَخَيْرَ الْمِلَلِ مِلَّةُ إبْرَاهِيْمَ (4) وَخَيْرَ السُّنَنِ سُنّةُ مُحَمَّدٍ (5) وَأَشْرَفَ الْحَدِيْثِ ذِكْرُ اللهِ (6) وَأَحْسَنَ الْقَصَصِ هَذَا الْقُرْآنُ (৭) وَخَيْرَ الْأُمُوْرِ عَوَازِمُهَا (8) وَشَرَّ الْأُمُوْرِ مُحْدَثَاتُهَا (9) وَأَحْسَنَ الْهَدْيِ هَدْيُ الْأَنْبِيَاءِ (10) وَأَشْرَفَ الْمَوْتِ قَتْلُ الشُّهَدَاءِ (11) وَأَعْمَى الْعَمَى الضَّلاَلَةُ بَعْدَ الْهُدَى (12) وَخَيْرَ الْأَعْمَالِ مَا نَفَعَ (13) وَخَيْرَ الْهُدَى مَا اُتَّبَعَ (14) وَشَرَّ الْعَمَى عَمَى الْقَلْبِ (15) وَالْيَدَ الْعُلْيَا خَيْرٌ مِنَ الْيَدِ السُّفْلَى (16) وَمَا قَلَّ وَكَفَى خَيْرٌ مِمَّا كَثُرَ وَأَلْهَى (17) وَشَرُّ الْمَعْذِرَةِ حِينَ يَحْضُرُ الْمَوْتُ (18) وَشَرُّ النّدَامَةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ (19) وَمِنَ النَّاسِ مَنْ لاَ يَأْتِي الْجُمُعَةَ إلاَّ دُبُرًا (20) وَمِنْهُمْ مَنْ لاَ يَذْكُرُ اللهَ إلاَّ هَجْرًا (21) وَمِنْ أَعْظَمِ الْخَطَايَا اللِّسَانُ الْكَذُوْبُ (22) وَخَيْرَ الْغِنَى غِنَى النَّفْسِ (23) وَخَيْرُ الزَّادِ التَّقْوَى (24) وَرَأْسُ الْحُكْمِ مَخَافَةُ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ (25) وَخَيْرُ مَا وَقَرَ فِي الْقُلُوبِ الْيَقِيْنُ (26) وَالإِرْتِيَابُ مِنَ الْكُفْرِ (27) وَالنِّيَاحَةُ مِنْ عَمَلِ الْجَاهِلِيَّةِ (28) وَالْغُلُوْلُ مِنْ جُثَا جَهَنَّمَ (29) وَالسَّكْرُ كَيٌّ مِنَ النَّارِ (30) وَالشِّعْرُ مِنْ إبْلِيسَ (31) وَالْخَمْرُ جِمَاعُ الْإِثْمِ ... (32) وَشَرُّ الْمَأْكَلِ مَالُ الْيَتِيْمِ (33) وَالسَّعِيْدُ مَنْ وُعِظَ بِغَيْرِهِ (34) وَالشَّقِيُّ مَنْ شَقِيَ فِي بَطْنِ أُمِّهِ ... (35) وَمَلاَكُ الْعَمَلِ خَوَاتِمُهُ (36) وَشَرُّ الرَّوَايَا رَوَايَا الْكَذِبِ (37) وَكُلُّ مَا هُوَ آتٍ قَرِيْبٌ (38) وَسِبَابُ الْمُؤْمِنِ فُسُوْقٌ (39) وَقِتَالُهُ كُفْرٌ (40) وَأَكْلُ لَحْمِهِ مِنْ مَعْصِيَةِ اللهِ (41) وَحُرْمَةُ مَالِهِ كَحُرْمَةِ دَمِهِ (42) وَمَنْ يَتَأَلَّ عَلَى اللهِ يُكَذِّبْهُ (43) وَمَنْ يَغْفِرْ يُغْفَرْ لَهُ (44) وَمَنْ يَعْفُ يَعْفُ اللهُ عَنْهُ (45) وَمَنْ يَكْظِمِ الْغَيْظَ يَأْجُرْهُ اللهُ (46) وَمَنْ يَصْبِرْ عَلَى الرَّزِيَّةِ يُعَوِّضُهُ اللهُ (47) وَمَنْ يَبْتَغِ السُّمْعَةَ يُسَمَّعِ اللهُ بِهِ (48) وَمَنْ يَتَصَبَّرْ يُضْعِفُ اللهُ لَهُ (49) وَمَنْ يَعْصِ اللهَ يُعَذِّبْهُ اللهُ (50) ثُمَّ اسْتَغْفَرَ ثَلاَثًا-

(১) সর্বাধিক সত্য বাণী হ’ল আল্লাহর কিতাব এবং (২) সবচেয়ে মযবুত হাতল হ’ল তাক্বওয়ার কালেমা। (৩) সবচেয়ে উত্তম দ্বীন হ’ল ইবরাহীমের দ্বীন। (৪) শ্রেষ্ঠ তরীকা হ’ল মুহাম্মাদের তরীকা (৫) সর্বোত্তম বাণী হ’ল আল্লাহর যিকর। (৬) সেরা কাহিনী হ’ল এই কুরআন। (৭) শ্রেষ্ঠ কর্ম হ’ল দৃঢ় সংকল্পের কর্মসমূহ এবং (৮) নিকৃষ্ট কর্ম হ’ল শরী‘আতে নব্যসৃষ্ট কর্মসমূহ। (৯) সুন্দরতম হেদায়াত হ’ল নবীগণের হেদায়াত। (১০) শ্রেষ্ঠ মৃত্যু হ’ল শহীদী মৃত্যু। (১১) সবচেয়ে বড় অন্ধত্ব হ’ল সুপথ পাওয়ার পরে পথভ্রষ্ট হওয়া। (১২) শ্রেষ্ঠ আমল তাই যা কল্যাণকর। (১৩) শ্রেষ্ঠ তরীকা সেটাই যা অনুসৃত হয়। (১৪) নিকৃষ্টতম অন্ধত্ব হ’ল হৃদয়ের অন্ধত্ব। (১৫) উপরের হাত নীচের হাতের চাইতে উত্তম। (১৬) অল্প ও পরিমাণমত সম্পদ অধিক উত্তম ঐ অধিক সম্পদ হ’তে যা (আল্লাহ থেকে) গাফেল করে দেয়। (১৭) নিকৃষ্ট তওবা হ’ল মৃত্যুকালীন তওবা। (১৮) সেরা লজ্জা হ’ল ক্বিয়ামতের দিনের লজ্জা। (১৯) লোকদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যারা জুম‘আয় আসে সবার শেষে। (২০) এমন কিছু লোক রয়েছে, যারা আল্লাহকে খুব কমই স্মরণ করে। (২১) সবচেয়ে বড় পাপ হ’ল মিথ্যা কথা বলা। (২২) শ্রেষ্ঠ প্রাচুর্য হ’ল হৃদয়ের প্রাচুর্য। (২৩) সেরা পাথেয় হ’ল আল্লাহভীরুতা। (২৪) সেরা প্রজ্ঞা হ’ল আল্লাহকে ভয় করা। (২৫) হৃদয়সমূহে যা সম্মান উদ্রেক করে, তা হ’ল দৃঢ় বিশ্বাস। (২৬) (আল্লাহ সম্পর্কে) সন্দেহ সৃষ্টি কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। (২৭) মৃতের জন্য উচৈচঃস্বরে শোক করা জাহেলী রীতির অন্তর্ভুক্ত। (২৮) (গণীমত থেকে) চুরির মাল জাহান্নামের স্ফুলিঙ্গ। (২৯) মাদকতা জাহান্নামের টুকরা। (৩০) (নষ্ট) কবিতা ইবলীসের অংশ। (৩১) মদ সকল পাপের উৎস।... (৩২) নিকৃষ্টতম খাদ্য হ’ল ইয়াতীমের মাল ভক্ষণ। (৩৩) সৌভাগ্যবান হ’ল সেই, যে অন্যের থেকে উপদেশ গ্রহণ করে। (৩৪) হতভাগা সেই যে মায়ের পেট থেকেই হতভাগা হয়।... (৩৫) শ্রেষ্ঠ আমল হ’ল শেষ আমল। (৩৬) নিকৃষ্ট গবেষণা হ’ল মিথ্যার উপর গবেষণা। (৩৭) যেটা ভবিষ্যতে হবে, সেটা সর্বদা নিকটবর্তী। (৩৮) মুমিনকে গালি দেওয়া ফাসেকী এবং (৩৯) তার সাথে যুদ্ধ করা কুফরী। (৪০) মুমিনের পিছনে গীবত করা আল্লাহর অবাধ্যতার অন্তর্ভুক্ত। (৪১) মুমিনের মাল অন্যের জন্য হারাম, যেমন তার রক্ত হারাম। (৪২) যে ব্যক্তি আল্লাহর উপরে বড়াই করে, আল্লাহ তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেন। (৪৩) যে ব্যক্তি ক্ষমা করে, তাকে ক্ষমা করা হয়। (৪৪) যে ব্যক্তি মার্জনা করে, আল্লাহ তাকে মার্জনা করেন। (৪৫) যে ব্যক্তি ক্রোধ দমন করে, আল্লাহ তাকে পুরস্কৃত করেন। (৪৬) যে ব্যক্তি বিপদে ধৈর্য ধারণ করে, আল্লাহ তাকে উত্তম বদলা দান করেন। (৪৭) যে ব্যক্তি শ্রুতি কামনা করে, আল্লাহ তার লজ্জাকে সর্বত্র শুনিয়ে দেন। (৪৮) যে ব্যক্তি ছবরের ভান করে, আল্লাহ তাকে দুর্বল করে দেন। (৪৯) যে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্যতা করে, আল্লাহ তাকে শাস্তি দিয়ে থাকেন। (৫০) অতঃপর তিনি তিনবার আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করেন ও ভাষণ শেষ করেন।[1]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উক্ত আবেগময় ভাষণে ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর ও দীর্ঘ সফরে ক্লান্তসেনাবাহিনীর অন্তরসমূহ ঈমানের ঢেউয়ে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। সকলে সব কষ্ট ভুলে প্রশান্তচিত্তে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে মনোনিবেশ করেন।


[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/৪৭৩-৭৪; আল-বিদায়াহ ৫/১৩-১৪; রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/১৩৮-৪০; আর-রাহীক্ব ৪৩৫ পৃঃ (সংক্ষিপ্ত); সিলসিলা যঈফাহ হা/২০৫৯।

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) ‘হাকেম’ থেকে উদ্ধৃত বলেছেন। কিন্তু আমরা হাকেম-এর কোন কিতাবে এটি পাইনি। শায়খ আলবানীও সিলসিলা যঈফাহ (হা/২০৫৯)-এর মধ্যে সূত্র হিসাবে বিভিন্ন হাদীছ গ্রন্থের নাম উল্লেখ করলেও হাকেম-এর কথা বলেননি। সম্ভবতঃ এটি ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ)-এর নিকট রক্ষিত হাকেম-এর কোন কিতাব থেকে হ’তে পারে। যা আমাদের নিকট পৌঁছেনি। অথবা মুদ্রণ প্রমাদ হ’তে পারে। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।