নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি

ত্বায়েফ থেকে ফেরার কাছাকাছি ছয় মাস পরে ৯ম হিজরীর রজব মাসে প্রচন্ড গ্রীষ্মের মধ্যে এই অভিযান প্রেরিত হয় (ইবনু হিশাম ২/৫১৫-১৬)। তাবূক ছিল মদীনা থেকে ৭৭৮ কি. মি. উত্তরে সঊদী আরবের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত। তৎকালীন সময়ের অর্ধেক পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি রোম সম্রাটের সিরিয় গবর্ণরের বিরুদ্ধে ৮ম হিজরীর জুমাদাল ঊলা মাসে পরিচালিত ‘মুতা’ অভিযানে এক অসম যুদ্ধে রোমকদের পিছু হটার ফলে আরব উপদ্বীপে মুসলিম শক্তির শ্রদ্ধাপূর্ণ প্রভাব বিস্তৃত হয়। তাতে যুগ যুগ ধরে রোমকদের শাসন-শোষণে নিষ্পিষ্ট আরবদের মধ্যে স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগরিত হয়। বিশেষ করে আরব ভূখন্ডের সীমান্তবর্তী রোম শাসিত শাম রাজ্যের জন্য তা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দেয়।

এ সময় মদীনার আউস গোত্রের অন্যতম সাবেক নেতা এবং খাযরাজ গোত্রের উপরেও যার যথেষ্ট প্রভাব ছিল, ধর্মগুরু আবু ‘আমের আর-রাহেব ৮ম হিজরীর শেষ দিকে হোনায়েন যুদ্ধের পর সবদিক থেকে নিরাশ হয়ে অবশেষে শামে (সিরিয়া) চলে যান। কেননা এটি তখন ছিল আরব ভূমিতে খ্রিষ্টান শাসনের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি সেখানে গিয়ে ‘নাছারা’ হন। অতঃপর রোম সম্রাটকে মদীনা আক্রমণের জন্য প্ররোচনা দিতে থাকেন। এ উদ্দেশ্যে মদীনার মুনাফিকদের সাথে তিনি পুরা যোগাযোগ রাখেন এবং তাদেরকে দিয়ে তিনি মসজিদে ক্বোবার অদূরে ‘মসজিদে যেরার’ নির্মাণ করান। যাতে মসজিদের আড়ালে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র হিসাবে এটাকে ব্যবহার করা যায়। ত্বাবারী যুহরীর বরাতে ‘মুরসাল’ সূত্রে (ত্বাবারী হা/১৭২০০) বর্ণনা করেন যে, বনু ‘আমর বিন ‘আওফ গোত্রে মসজিদে ক্বোবা নির্মিত হ’লে তার প্রতি হিংসাবশে তার ভাই বনু গুন্ম বিন ‘আওফ গোত্রের লোকেরা এই মসজিদ নির্মাণ করে (কুরতুবী হা/৩৪৮৫)

রোম সম্রাটকে আবু ‘আমের বুঝাতে সক্ষম হন যে, মদীনায় মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে তার একটি বিরাট দল রয়েছে। যারা বাহ্যিকভাবে মুহাম্মাদের দলে মিশে আছে। বাইরে থেকে রোমকরা হামলা করলেই তারা ঘুরে দাঁড়াবে এবং রোমকদের সহজ বিজয় লাভ হবে। উল্লেখ্য যে, ওহোদ যুদ্ধে শহীদ এবং ফেরেশতারা যার লাশ গোসল করান, সেই বিখ্যাত ছাহাবী হানযালা ছিলেন এই ফাসেক আবু ‘আমেরের পুত্র। রাসূল (ছাঃ) তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলে সে অস্বীকার করে। ফলে রাসূল (ছাঃ) তার নামকরণ করেন আবু ‘আমের আল-ফাসেক্ব’(فَسَمَّاهُ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الفَاسِقَ)। তিনি তাকে বদদো‘আ করেন, যেন সে মদীনা থেকে দূরে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে নির্জন কোন স্থানে মৃত্যুবরণ করে। পরে তিনি শামের ক্বিন্নাসরীন (قِنَّسْرِين) যেলায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।[1]

একদিকে রাজনৈতিক বাস্তবতা অন্যদিকে আবু ‘আমেরের এই প্ররোচনা রোম সম্রাটকে মদীনা হামলায় উৎসাহিত করল। পূর্ণরূপে শক্তি সঞ্চয়ের পূর্বেই উঠতি ইসলামী শক্তিকে অংকুরে বিনাশ করার সংকল্প নিয়ে তারা ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্ত্ততি শুরু করে। যাতে রোম সাম্রাজ্য সংলগ্ন আরব এলাকা থেকে ভবিষ্যতে কোনরূপ বিদ্রোহের হুমকি সৃষ্টি না হয়।

রোমকদের উক্ত হুমকি মুকাবিলা করাই ছিল তাবূক অভিযানের প্রত্যক্ষ কারণ। দ্বিতীয় কারণ ছিল তাদের কুফরী আদর্শের হুমকি মুকাবিলা করা। কারণ তারা ছিল ইহূদীদের পরে আরবদের নিকটতম দুশমন শক্তি। আহলে কিতাব হ’লেও তাদের অধিকাংশ ত্রিত্ববাদের কুফরী আক্বীদায় বিশ্বাসী হয়ে গিয়েছিল। তাদেরকে প্রকৃত তাওহীদের দিকে আহবান করা এবং অন্যদেরকে তাদের মন্দ প্রভাব থেকে বাঁচানো এই অভিযানের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। আর এটাই হ’ল ইসলামী জিহাদের মূল রূহ। যেমন আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قَاتِلُوا الَّذِينَ يَلُونَكُمْ مِنَ الْكُفَّارِ وَلْيَجِدُوا فِيكُمْ غِلْظَةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের নিকটবর্তী কাফেরদের সাথে যুদ্ধ কর। তারা যেন তোমাদের মধ্যে কঠোরতা অনুভব করে। আর জেনে রেখ যে, আল্লাহ সর্বদা মুত্তাক্বীদের সঙ্গে থাকেন’ (তওবা ৯/১২৩)। যাতে এর মাধ্যমে আরব উপদ্বীপ কাফেরমুক্ত হয় এবং দ্বীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ বলেন,وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لاَ تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ ‘আর তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর যতক্ষণ না ফিৎনা (কুফরী) শেষ হয় এবং দ্বীন পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়’ (আনফাল ৮/৩৯)

প্রত্যক্ষ কারণ যেটাই থাক না কেন আল্লাহর ইচ্ছা ছিল সম্ভবতঃ এটাই যে, খন্দক, খায়বর, মুতা ও মক্কা বিজয় শেষে আরবের সমস্ত অঞ্চল থেকে যখন দলে দলে গোত্রনেতারা মদীনায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করছে, তখন বাকী শাম ও তৎসন্নিহিত খ্রিষ্টান শাসিত এলাকাগুলি ইসলামী খেলাফতের অধীনস্ত হৌক। আলহামদুলিল্লাহ সেটাই হয়েছিল এবং কোনরূপ রক্তপাত ছাড়াই তাবূক অভিযানে খ্রিষ্টান শাসকরা সন্ধিচুক্তি করতে বাধ্য হয়। অতঃপর খেলাফতে রাশেদাহর সময় সমস্ত আরব উপদ্বীপ কাফেরমুক্ত হয়। ফালিল্লাহিল হাম্দ

[1]. কুরতুবী হা/৩৪৮৫, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা তওবা ১০৭-০৮ আয়াত; আর-রাহীক্ব ২৫৮ পৃঃ; ইবনু হিশাম ২/৬৭; সনদ ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১০৯৫)।