নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি
হোনায়েন পরবর্তী যুদ্ধসমূহ (السرايا والغزوات بعد حنين)

৮২. সারিইয়া ক্বায়েস বিন সা‘দ(سرية قيس بن سعد) : ৮ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাস। হোনায়েন যুদ্ধ শেষে মদীনায় ফেরার পর রাসূল (ছাঃ) ক্বায়েস বিন সা‘দ বিন ওবাদাহ-এর নেতৃত্বে ৪০০ সৈন্যের একটি দলকে ইয়ামন সীমান্তবর্তী ছুদা অঞ্চলে প্রেরণ করেন। তখন তাদের নেতা যিয়াদ ইবনুল হারেছ ছুদাঈ রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে হাযির হন এবং অনুরোধ করে বলেন, আপনি সৈন্যদলকে ফিরিয়ে নিন। আমি আমার সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে দায়িত্ব নিচ্ছি’। তখন রাসূল (ছাঃ) সেনাদল ফেরত নিলেন।[1]

৮৩. সারিইয়া উয়ায়না বিন হিছন আল-ফাযারী(سرية عيينة بن حصن الفزاري) : ৯ম হিজরীর মুহাররম মাস। বনু তামীম গোত্রের লোকেরা অন্য গোত্রের লোকদের জিযিয়া প্রদান না করার জন্য প্ররোচিত করছিল। সেকারণ তাদের বিরুদ্ধে ‘ছাহরা’ (الصَّحْرَاء) এলাকায় ৫০ জন অশ্বারোহীর একটি দল প্রেরিত হয়। বনু তামীম পালিয়ে যায়। তাদের পুরুষ-নারী-শিশু মিলে ৬২ জনকে বন্দী করে মদীনায় আনা হয়। পরদিন তাদের ১০ জন নেতা মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করে। ফলে সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয়।[2]

৮৪. সারিইয়া কুত্ববাহ বিন ‘আমের(سرية قطبة بن عامر) : ৯ম হিজরীর ছফর মাস। তুরবার (ةُربة) নিকটবর্তী তাবালা (تَبَالَة) অঞ্চলে খাছ‘আম (خَثْعَم) গোত্রের একটি শাখার বিরুদ্ধে ২০ জনের এই দলটি প্রেরিত হয়। এরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল। যুদ্ধে তাদের অনেকে হতাহত হয়। মুসলিম বাহিনী উট, বকরী ও নারী সহ অনেক গণীমত নিয়ে ফিরে আসে। তবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের ছেড়ে দেন।[3]

৮৫. সারিইয়া যাহহাক বিন সুফিয়ান কেলাবী(سرية ضحاك بن سفيان الكلابي) : ৯ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস। বনু কেলাব গোত্রকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার জন্য এই দলটিকে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু বনু কেলাব তাতে অস্বীকার করে এবং যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ফলে তাদের একজন নিহত হয় (যাদুল মা‘আদ ৩/৪৫০; ইবনু সা‘দ ২/১২৩)

৮৬. সারিইয়া আলী ইবনু আবী ত্বালেব(سرية على بن أبى طالب) : ৯ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস। বিখ্যাত খ্রিষ্টান গোত্র ত্বাঈ (طَيِّئ)-এর ‘ফুল্স’ (الفُلْس) মূর্তিটি ভেঙ্গে ফেলার জন্য ১৫০ জনের এই বাহিনী প্রেরিত হয়। মূর্তি ভাঙ্গার পর দানবীর হাতেম তাঈ-এর পরিবার সহ অনেকে বন্দী হয়ে মদীনায় নীত হন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে সসম্মানে মুক্তি দেন। হাতেম তাঈ-এর বৃদ্ধা কন্যা সাফফানাহ (سَفَّانَةَ) মুক্তি পেয়ে পলাতক ভাই খ্যাতনামা বিদ্বান ও গোত্রনেতা ‘আদী ইবনে হাতেমকে পাবার জন্য সিরিয়ায় যান। পরে ‘আদী মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করেন (যাদুল মা‘আদ ৩/৪৫৩)

৮৭. সারিইয়া আলক্বামা বিন মুজাযযিয আল-মুদলেজী(سرية علقمة بن مجزّز المدلجي) : ৯ম হিজরীর রবীউল আখের। হাবশার কিছু নৌদস্যু জেদ্দা তীরবর্তী এলাকায় সমবেত হয়ে মক্কায় হামলা করার চক্রান্ত করছে জানতে পেরে ৩০০ জনের এই বাহিনী প্রেরিত হয়। আলক্বামা একদল সাথী নিয়ে সাগরে নেমে যান ও একটি দ্বীপে পৌঁছে যান। এ খবর পেয়ে দস্যুদল দ্রুত পালিয়ে যায়।[4]

অতঃপর পলাতকদের বিরুদ্ধে আব্দুল্লাহ বিন হুযাফাহ সাহমীকে পাঠানো হয়। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, তিনি ছিলেন বদরী ছাহাবী এবং তার মধ্যে ঠাট্টা করার মেযাজ ছিল। আমি ছিলাম উক্ত সেনাদলের সদস্য। অতঃপর সেনাদল রাস্তার এক স্থানে অবতরণ করে। সেখানে তারা শরীর গরম করার জন্য একটি অগ্নিকুন্ড তৈরী করে। তখন তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমার কথা শোনা ও মান্য করা কি তোমাদের উপর ওয়াজিব নয়? সবাই বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে কোন বিষয়ে আদেশ দিলে তোমরা কি তা পালন করবে? সকলে বলল, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, আমি চাই তোমরা এই আগুনে ঝাঁপ দাও। তখন লোকেরা দাঁড়িয়ে গেল। যখন তিনি ধারণা করলেন যে, তারা ঝাঁপ দিবে, তখন তিনি বললেন,أَمْسِكُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ فَإِنَّمَا كُنْتُ أَمْزَحُ مَعَكُمْ ‘তোমরা থাম। আমি তোমাদের সাথে স্রেফ হাসি-ঠাট্টা করতে চেয়েছিলাম মাত্র। পরে ঘটনাটি রাসূল (ছাঃ)-কে জানানো হ’লে তিনি বলেন,مَنْ أَمَرَكُمْ بِمَعْصِيَةٍ فَلاَ تُطِيعُوهُ ‘যে ব্যক্তি তোমাদের কোন পাপকর্মের নির্দেশ দিবে, তোমরা তা মানবে না’।[5]

ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, উক্ত ঘটনা উপলক্ষ্যে সূরা নিসা ৫৯ আয়াতটি নাযিল হয়। যেখানে বলা হয়, ‘তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর এবং আনুগত্য কর রাসূলের ও তোমাদের মধ্যকার আমীরের...’ (নিসা ৪/৫৯; মুসলিম হা/১৮৩৪)

অনুরূপ একটি ঘটনা আলী (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, যেখানে আমীর হিসাবে বলা হয়েছে, ‘আনছারের জনৈক ব্যক্তি’(رَجُلاً مِنَ الأَنْصَارِ)। তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে তার সেনাদলকে আগুনে প্রবেশের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন একদল তাতে প্রবেশ করার সংকল্প করল। অপর দল একে অপরের দিকে তাকাতে লাগল এবং বলল, আমরা আগুন থেকে বাঁচার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে এসেছিলাম’। তখন আমীরের রাগ ঠান্ডা হয়ে যায় ও আগুন নিভে যায়। অতঃপর মদীনায় ফিরে এসে ঘটনাটি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে বলা হ’লে তিনি বলেন,لَوْ دَخَلُوهَا لَمْ يَزَالُوا فِيهَا إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ ‘যদি তারা আগুনে প্রবেশ করত, তাহ’লে ক্বিয়ামত পর্যন্ত তারা সেখানেই থাকত’। তিনি আরও বলেন,لاَ طَاعَةَ فِى مَعْصِيَةِ اللهِ إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِى الْمَعْرُوفِ ‘আল্লাহর অবাধ্যতায় কোন আনুগত্য নেই। আনুগত্য কেবল ন্যায় কর্মে’।[6] ইমাম নববী বলেন, এটি আব্দুল্লাহ বিন হুযাফাহর ঘটনা নয়। বরং পৃথক ঘটনা (মুসলিম হা/১৮৪০-এর ব্যাখ্যা)

ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘যদি তারা আগুনে প্রবেশ করত’ এর অর্থ ‘যদি তারা আমীরের নির্দেশ মান্য করার জন্য এটাকে হালাল ভেবে করত, তাহ’লে তারা সেখান থেকে আর কখনো বের হ’তে পারত না’। যারা আগুনে প্রবেশ করেনি, তাদেরকে তিনি উত্তম কথা বলেন ও জানিয়ে দেন যে, আল্লাহর অবাধ্যতায় কারো প্রতি আনুগত্য নেই। আনুগত্য কেবল বৈধ কর্মে’ (ফাৎহুল বারী হা/৪০৮৫-এর ব্যাখ্য)। তিনি বলেন, নিসা ৫৯ আয়াতে বর্ণিত উলুল আমরের অর্থ ‘আমীরের আনুগত্য’ আলেমের আনুগত্য নয়। যা তাদের বিপরীত যারা উক্ত কথা বলে থাকেন। এর উদ্দেশ্য সামাজিক ঐক্য বজায় রাখা। নইলে বহু আনুগত্যের ফলে সমাজে বিভক্তি ও বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে’।[7]

উপরোক্ত ঘটনায় আমীরের প্রতি সর্বোচ্চ আনুগত্যের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। সেই সাথে উক্ত আনুগত্যের সীমা নির্দেশও জানা যায়। এছাড়া ইসলামী জিহাদের চিরন্তন বিধান পাওয়া যায় এই মর্মে যে, আমীরের নির্দেশে আত্মঘাতি হওয়া নিষিদ্ধ।

[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/৫৮০; আর-রাহীক্ব ৪৪৬ পৃঃ।

[2]. যাদুল মা‘আদ ৩/৪৪৬; ইবনু সা‘দ ২/১২১-২২।

চরিতকারগণ এই ঘটনাকে ৯ম হিজরীর মুহাররম মাস বললেও মুবারকপুরী এতে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। যদিও তিনি পৃথক কোন সাল বা তারিখ উল্লেখ করেননি (আর-রাহীক্ব ৪২৬ পৃঃ টীকা-১)।

[3]. যাদুল মা‘আদ ৩/৪৪৯; ইবনু সা‘দ ২/১২২-২৩।

[4]. যাদুল মা‘আদ ৩/৪৫১; আর-রাহীক্ব ৪২৬ পৃঃ; ফাৎহুল বারী ‘সারিইয়া আব্দুল্লাহ বিন হুযাফাহ ও আলক্বামা বিন মুজাযযিয’ অনুচ্ছেদ, হা/৪০৮৫-এর পূর্বে, ৮/৫৯ পৃঃ।

[5]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৫৫৮; আহমাদ হা/১১৬৫৭; ইবনু মাজাহ হা/২৮৬৩; ছহীহাহ হা/২৩২৪।

[6]. মুসলিম হা/১৮৪০; বুখারী হা/৭১৪৫, ৭২৫৭; যাদুল মা‘আদ ৩/৪৫০-৫১।

[7]. ফাৎহুল বারী, ‘আহকাম’ অধ্যায়, আল্লাহর বাণী ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যকার আমীরের আনুগত্য কর’ অনুচ্ছেদ; হা/৬৭১৮-এর ব্যাখ্যা।