নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি

হোনায়েন-এর সংকটকালে যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পাশে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যতীত কেউ ছিলনা, তখন তাঁর বীরত্ব ও তেজস্বিতা ছিল অতুলনীয়। তিনি স্বীয় সাদা খচ্চরকে কাফের বাহিনীর দিকে এগিয়ে যাবার জন্য উত্তেজিত করতে থাকেন ও বলতে থাকেন, أَنَا النَّبِىُّ لاَ كَذِبْ * أَنَا ابْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبْ ‘আমি নবী। মিথ্যা নই’। ‘আমি আব্দুল মুত্ত্বালিবের পুত্র’।[1] অর্থাৎ আমি যে সত্য নবী তার প্রমাণ যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের উপরে নির্ভর করে না। এ সময় রাসূল (ছাঃ) ডানদিকে ফিরে ডাক দিয়ে বলেন,هَلُمُّوْا إلَيَّ أيها الناسُ، أنَا رَسُوْلُ الله، أنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللهِ ‘আমার দিকে এসো হে লোকেরা! আমি আল্লাহর রাসূল’। ‘আমি আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ’।[2]

এসময় রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে ১০ থেকে ১২ জন ছাহাবী ব্যতীত কেউ ছিল না। তন্মধ্যে ছিলেন চাচা আববাস ও তার পুত্র ফযল বিন আববাস, চাচাতো ভাই নওমুসলিম আবু সুফিয়ান বিন হারেছ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব ও তার পুত্র জা‘ফর, আবুবকর, ওমর, আলী ও রাবী‘আহ বিন হারেছ। তাছাড়া ছিলেন উসামাহ বিন যায়েদ এবং আয়মান বিন ওবায়েদ ওরফে আয়মান বিন উম্মে আয়মান। যিনি ঐ দিন শহীদ হয়েছিলেন (যাদুল মা‘আদ ৩/৪১১)। আবু সুফিয়ান বিন হারেছ রাসূল (ছাঃ)-এর খচ্চরের লাগাম এবং চাচা আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব খচ্চরের রেকাব টেনে ধরে রেখেছিলেন, যাতে সে রাসূলকে নিয়ে সামনে বেড়ে যেতে না পারে। অতঃপর চাচা আববাসকে নির্দেশ দিলেন ছাহাবীগণকে উচ্চৈঃস্বরে আহবান করার জন্য। কেননা আববাস ছিলেন অত্যন্ত দরাজ কণ্ঠের মানুষ। তিনি সর্বশক্তি দিয়ে ডাক দিলেন,أَيْنَ أَصْحَابُ السَّمُرَةِ ‘বায়‘আতে রিযওয়ানের সাথীরা কোথায়’?يَا مَعْشَرَ الأَنْصَارِ ‘হে আনছারগণ!’يَا بَنِى الْحَارِثِ بْنِ الْخَزْرَجِ ‘হে হারেছ বিন খাযরাজের বংশধরগণ!’ আব্বাস-এর উচ্চকণ্ঠের এই আওয়ায পাওয়ার সাথে সাথে গাভীর ডাকে দুধের বাছুর ছুটে আসার ন্যায়(عَطْفَةُ الْبَقَرِ عَلَى أَوْلاَدِهَا) লাববায়েক লাববায়েক ধ্বনি দিতে দিতে চারদিক থেকে ছাহাবীগণ ছুটে এলেন।[3] কারু কারু এমন অবস্থা হয়েছিল যে, স্বীয় উটকে ফিরাতে না পেরে স্রেফ ঢাল-তলোয়ার নিয়ে লাফিয়ে পড়ে ছুটে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে চলে আসেন (ইবনু হিশাম ২/৪৪৪-৪৫)। এসময় রাসূল (ছাঃ) বলেন,الْآنَ حَمِيَ الْوَطِيسُ ‘এখন যুদ্ধ জ্বলে উঠল’।[4]

ফলে মুহূর্তের মধ্যে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক মুষ্টি বালু উঠিয়ে কাফেরদের দিকে নিক্ষেপ করে বলেন,شَاهَتِ الْوُجُوْهُ ‘চেহারাগুলো বিকৃত হৌক’।[5] এই এক মুঠো বালু শত্রুপক্ষের প্রত্যেকের দু’চোখে ভরে যায় এবং তারা পালাতে থাকে। ফলে যুদ্ধের গতি স্তিমিত হয়ে যায়। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنْهَزَمُوْا وَرَبِّ مُحَمَّدٍ ‘মুহাম্মাদের প্রতিপালকের কসম! ওরা পরাজিত হয়েছে’।[6] নিঃসন্দেহে এটা ছিল আল্লাহর গায়েবী মদদ, যা তিনি ফেরেশতাগণের মাধ্যমে সম্পন্ন করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,ثُمَّ أَنْزَلَ اللهُ سَكِينَتَهُ عَلَى رَسُولِهِ وَعَلَى الْمُؤْمِنِينَ وَأَنْزَلَ جُنُودًا لَمْ تَرَوْهَا وَعَذَّبَ الَّذِينَ كَفَرُوا وَذَلِكَ جَزَاءُ الْكَافِرِينَ ‘অতঃপর আল্লাহ তাঁর রাসূল ও বিশ্বাসীগণের প্রতি তাঁর বিশেষ প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং এমন সেনাবাহিনী নাযিল করলেন, যাদেরকে তোমরা দেখোনি আর অবিশ্বাসীদের শাস্তি দিলেন। আর এটাই হল অবিশ্বাসীদের কর্মফল’ (তওবা ৯/২৬)

[1]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৪৩১৫; মিশকাত হা/৪৮৯৫, ৫৮৮৯। ছহীহ মুসলিমে আববাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে (হা/১৭৭৫) ফারওয়া আল-জুযামী প্রদত্ত সাদা খচ্চরের কথা বলা হয়েছে। ইবনু সা‘দ সহ অনেক জীবনীকার মুক্বাউক্বিস প্রদত্ত সাদা-কালো ডোরা কাটা ‘দুলদুল’ খচ্চরের কথা বলেছেন। ইবনু হাজার প্রথমটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন (ঐ)।

[2]. আহমাদ হা/১৫০৬৯, সনদ হাসান; গাযালী, ফিক্বহুস সীরাহ তাহকীক আলবানী, ৩৮৯ পৃঃ, সনদ ছহীহ।

[3]. মুসলিম হা/১৭৭৫ ‘হোনায়েন যুদ্ধ’ অনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/৫৮৮৮।

[4]. ইবনু হিশাম ২/৪৪৫, সনদ ছহীহ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৭৫০; মুসলিম হা/১৭৭৫।

[5]. মুসলিম হা/১৭৭৭; মিশকাত হা/৫৮৯১ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়-২৯, ‘মু‘জেযা’ অনুচ্ছেদ-৭।

[6]. মুসলিম হা/১৭৭৫; মিশকাত হা/৫৮৮৮।